ফিচার

রত্নগর্ভা মণিপুরী মা মঞ্জুশী সিনহা

রফিকুল ইসলাম জসিম

Advertisement

সন্তানকে সফল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার অন্যতম কারিগর হলেন মা। তেমনি একজন সফল কারিগর মনিপুরী মা মঞ্জুশী সিনহা। এই রত্নগর্ভা মায়ের সন্তানরা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। এ যেন এক সাধারণ নারীর অসাধারণ গল্প। মা দিবসে সব মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা আজ জানাবো এই মণিপুরী মায়ের জীবনের গল্প।

সমাজে সন্তানদের সুশিক্ষিত এবং আগামী দিনের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার নিপুণ স্থপতি এবং সত্য ও সুন্দরের প্রতীক তিনি। এই সফল মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং ত্যাগ শিকারকে স্বীকৃতি জানাতে মণিপুরী সম্প্রদায়ের মঞ্জুশী সিনহাকে ২০২০ সালে ‘সফল জননী নারী’ বিভাগে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা দেন কমলগঞ্জ উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের পাথারী গাঁও গ্রামের হাইস্কুল শিক্ষক প্রফুল্ল কুমার সিংহের স্ত্রী মঞ্জুশ্রী সিনহা। নানা প্রতিকূলতার মাঝে তিনি সন্তানকে উচ্চশিক্ষত করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার বড় ছেলে প্রভাত কুমার সিংহ সহকারী কাস্টমস কমিশনার এবং ছোট ছেলে প্রবাস কুমার সিংহ সহকারী পুলিশ সুপার পদে কর্মরত। তাদের পরিবারে বড় পুত্রবধূ সরকারি কলেজে প্রফেসর ও ছোট পুত্রবধূ মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করছেন।

Advertisement

আরও পড়ুন: শিক্ষার্থী মায়েদের গল্প

একজন সফল মায়ের পাশাপাশি তিনি একজন স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন। অফুরন্ত জীবনীশক্তি তার। অক্লান্তকর্মী এই মা ৬২ বছর বয়সেও সবকিছু করে চলেছেন সীমাহীন দক্ষতায়। সন্তানদের সব সময় তিনি বুঝিয়েছেন শুধু অর্থ উপার্জন করে প্রকৃত মানুষ হওয়া যায় না। লেখাপড়া হচ্ছে স্থায়ী সম্পদ। লেখাপড়া শিখে নিজে আলোকিত হয়ে সমাজকে আলোকিত করা যায়। অশ্রুসজল নয়নে এই মঞ্জুশী সিনহা বলেন, ‘শুধু টাকা খরচ করে ও শাসন করে সন্তানদের মানুষ করা যায় না। পাশাপাশি ভালোবাসাও দিতে হয়’।

কমলগঞ্জ উপজেলার তিলকপুর গ্রামে এক মণিপুরী গরীব কৃষক পরিবারে বাবা সূর্যমণি সিংহ ও মাতা কুঞ্জ রানী সিনহার ঘর আলোকিত করে ১৯৬১ সালের ৫ মে জন্মগ্রহণ করেন মঞ্জুশী সিনহা। ছোটবেলায় পড়াশোনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, অভাব অনটনের মধ্যে নিজেকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে অনেক বাধা বিপত্তিতে পড়েছেন। কিন্তু স্বপ্ন বাস্তবায়নে পিছু পা না হননি। বাধ্য হয়ে মামার বাড়িতে স্থানান্তর হন। সেখানে থেকেই ১৯৭৮ সালে তিনি এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান শাখা থেকে দ্বিতীয় বিভাগে পাস করেন। এরপর নার্সিংয়ে ভর্তি হলেও নানা সমস্যার কারণে অসমাপ্ত রেখে বাবার বাড়িতে ফিরে আসেন। কিছুদিন পর উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের পাথারী গাঁও গ্রামের হাইস্কুল শিক্ষক প্রফুল্ল কুমার সিংহের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় তার। বিয়ের পর তিনি পিটিআই ট্রেনিংয়ে ১৯৭৯-১৯৮০ ট্রেনিং বর্ষে ভর্তি হয়ে সফলতার সঙ্গে সমাপ্ত করেন। এরপর ১৯৮২ সালের ১৬ আগষ্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহ-শিক্ষিকা পদে চাকরিতে যোগদান করেন। চাকরি থেকে অবসরে যান ২০২০ সালে।

সন্তানদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে কীভাবে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার স্বামী ছিলেন মাধ্যমিক স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। তার অনুপ্রেরণায় এবং উৎসাহে সন্তানদের শিক্ষিত করা সম্ভব হয়েছে। তিনি আরও জানান, সন্তানদের জন্ম হওয়ার পর তাদের স্বপ্নগুলো অন্যধারায় প্রবাহিত হয়। স্বামী-স্ত্রীর অল্প আয়ে সংসার সামাল দেওয়া যেখানে কষ্টকর, সেখানে তিনি সন্তানদের সুশিক্ষিত এবং উচ্চশিক্ষা প্রদানের মনস্থির করেন। এজন্য নিজের সোনার গহনা বন্ধক দিয়েছেন, এমনকি নিজের নামের ভূ-সম্পত্তি বিক্রিও করেছেন।

Advertisement

আরও পড়ুন: আদর্শ মা থেকে সেরা শিক্ষক

তৎকালীন সময়ে গ্রামাঞ্চলে নারীদের চাকরি এবং সন্তানদের এমন উচ্চশিক্ষা গ্রহণকে অন্য দৃষ্টিতে দেখা হতো। এজন্য তাকে বিভিন্ন কটুক্তিও শুনতে হয়েছে। তবে তাতে তিনি থেমে যাননি, বরং লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে গেছেন নিজের গতিতে। সফল মা মঞ্জুশী সিনহার ভাষায়, আমার সন্তানরা খুব ভালো, খুব ভদ্র। ওরা অনেক লেখাপড়া করেছে। আমি সবসময় চাইতাম আমার সন্তান যেন মানুষের মতো মানুষ হয়। আমি ওদের সন্তান হিসেবে না, মানুষ হিসেবে বড় করেছি। পাশাপাশি আমি আমার সন্তানদের বাইরে অন্যদেরও নিজের সন্তান মনে করি। তাদের সাফল্যে গর্ববোধ করি।’

সন্তানদের কাছে আপনার কী চাওয়া পাওয়া জানতে চাইলে মঞ্জুশী সিনহা জানান, আমি চাই সন্তানরা সমাজ ও দেশের কাজে এসে মানুষের কল্যাণে নিবেদিত থাকুক। নিজের আলোয় সমাজকে আলোকিত করুক। এছাড়া আমার সন্তান ও পুত্রবধূরা নিয়মিত আমাদের খোঁজখবর নেন। তারা সবসময় ভালো থাকুক এই কামনা করি।

ছোট ছেলে সহকারী পুলিশ সুপার প্রবাস কুমার সিংহ বলেন, আমরা মাকে অনেক ভালোবাসি। মা আমাদের গর্ব। আমার মায়ের সাহসিকতা ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের ফলে পরিবারে সুখ এসেছে। মায়ের জন্য আজ আমরা প্রতিষ্ঠিত ও তিনিই আলোকিত মা। আমার মায়ের সাফল্যে আমরা সবাই গর্বিত।

একজন মা-ই পারেন পুরো পরিবারকে বদলে দিতে। পুরো এলাকায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে। এজন্য সততা, অধ্যবসায় ও পরিশ্রম এবং ধৈর্য লাগবে। মঞ্জুশী সিনহার মতো এমন মহীয়সী নারী জন্মালে জন্ম নেবে এমন আলোকিত সন্তানরা। এই আলোকিত সন্তানরা সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবে। স্যালুট জানাই মঞ্জুশী সিনহার মতো রত্নগর্ভা মায়েদের। তার এই দৃষ্টান্ত অন্য মায়েদের অনুপ্রাণিত করবে যুগে যুগে।

লেখক: ফিচার লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী

কেএসকে/এএসএম