নিয়ামুর রশিদ শিহাব
Advertisement
শত বাধা জয় করে নিজে যেমন হয়েছেন সুশিক্ষিত, তেমনি এখন শিক্ষাদানের মাধ্যমে হাজারো শিশুকে করছেন প্রতিষ্ঠিত। যুদ্ধের পর বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলার চালিতাবুনিয়া গ্রামে জন্ম নেওয়া কন্যাশিশুটি এখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক আদর্শ সহকারী শিক্ষক। নাম লুৎফুন নাহার শিউলি।
শিউলি ফুলের মতোই নরম মেজাজ ও সুরেলা কণ্ঠের অধিকারী, সেই নারী হলেন আমার মা। মায়ের কাছ থেকে শোনা-বাড়ির পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সুনামের সঙ্গে প্রাথমিক পর্যায় শেষ করে ভর্তি হন আমতলী এ. কে. পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। বাড়ি থেকে প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা অতিক্রম করে প্রতিদিন যেতে হতো। সে সময় যানবাহন ছিল খুবই কম। যে কারণে পায়ে হেঁটে এতটা পথ অতিক্রম করতেন। বর্ষাকালে দুর্ভোগ বেড়ে যেত। তবুও দমে যাননি।
মাধ্যমিক স্তর পার হয়ে আমতলী ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হলেন। ১৯৮৯ সালে তার স্কুল থেকে কলেজে ভর্তি হওয়া একমাত্র ছাত্রী ছিলেন আমার মা। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি সবসময় ছিলেন প্রতিবাদী। কুসংস্কারের ভিড়ে যখন তার সহপাঠীদের এক এক করে বিয়ে হচ্ছিল, তখন তিনি সুশিক্ষিত হওয়ার পথে ছিলেন অটল। একই কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। এরপর জাতিকে শিক্ষিত করার কাজে যোগ দেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে।
Advertisement
বিয়ে হয় পার্শ্ববর্তী পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলার দক্ষিণ চরখালী গ্রামে। আমার বাবা হারুন অর রশিদ তখন ছিলেন এমএসএস শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। বর্তমানে তিনি গলাচিপা মহিলা ডিগ্রি কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের সিনিয়র প্রভাষক। তার সুদক্ষ পাঠদানের কারণে প্রতিবছর সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষার্থীরা জিপিএ-৫সহ শতভাগ পাশের নজির রয়েছে। এর পাশাপাশি তিনি দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার গলাচিপা উপজেলা সংবাদদাতা।
আমার মায়ের প্রথম কর্মস্থল ছিল গলাচিপার পানপট্টি বোর্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এটি আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে। দূরবর্তী বিদ্যালয়ে গিয়েও শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করেছেন। এরপর পর্যায়ক্রমে কয়েকটি বিদ্যালয়ে চাকরি করেছেন। সবশেষে বদলি হন রতনদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। অদ্যবধি তিনি এই বিদ্যালয়ে কর্মরত রয়েছেন। যোগদানের পরপরই বিদ্যালয়টি আলোর মুখ দেখেছে। প্রতিবছর বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেশ কয়েকটা জিপিএ-৫সহ বৃত্তি পেয়ে থাকে।
এছাড়া তিনি বিদ্যালয়ের অসহায় শিশুদের নানাভাবে সহযোগিতা করেন। সহকর্মীদের সঙ্গে তার খুবই ভালো সখ্যতা ও সহযোগিতার মনোভাব আছে। প্রধান শিক্ষক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা-ভক্তি। এই কারণে বিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে যেমন প্রিয়, তেমনি সেরা শিক্ষক হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছেন।
তিনি তার শিক্ষার্থীদের সঠিক শিক্ষাদানের পাশাপাশি নিজের সন্তানদের সঠিক পথের প্রদর্শকও। দুই ছেলে ও এক মেয়ের জননী আমার মা। তার বড় ছেলে (আমি) বর্তমানে বরিশাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টের ৭ম পর্বের শিক্ষার্থী। তার একমাত্র কন্যা ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। সে ২০২২সালে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় গলাচিপায় অবস্থিত বাংলাদেশ তুরস্ক ফ্রেন্ডশিপ স্কুল থেকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। ছোট ছেলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে।
Advertisement
আমার মা যেমন সেরা শিক্ষক, তেমনি সেরা মা। সাংসারিক কাজ তিনি খুব নিপুণভাবে সম্পন্ন করেন। তার মধ্যে কখনো অলসতার ছাপ দেখিনি। ধর্মীয় কাজেও তিনি সবসময় সদা সতর্ক। মায়ের হাতের প্রতিটি রান্নার স্বাদ মুখে লেগে থাকে। তাইতো আমার কাছে আমার মা’ই সেরা।
লেখক: শিক্ষার্থী, বরিশাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট।
কেএসকে/এমএস