দেশজুড়ে

আইলার দুর্বিষহ স্মৃতি কাঁদায় আজও

‘সেদিন সকাল থেকে ছিল গুমোট আবহাওয়া, আকাশে ছিল মেঘ, গাছের একটা পাতাও নড়ছিল না। প্রতিদিনের মতো নিজের মাছের ঘেরে কাজ করছিলাম। দুপুর ১২টার দিকে হঠাৎ ২০-২৫ ফুট উচ্চতার পানির ঢেউ এসে সব লন্ডভন্ড করে দিল। সেদিন সেই পানির মধ্য থেকে কীভাবে যে বেঁচে গেছি, তা একমাত্র আল্লাহ জানেন।’

Advertisement

২০০৯ সালে ঘুর্ণিঝড় আইলার দুঃসহ স্মৃতিচারণ করে এসব কথা বলছিলেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার সোরা গ্রামের বাসিন্দা মো. হাবিবুল্লাহ। তিনি বলেন, আইলার সেই জলোচ্ছ্বাসে আমি ও আমার পরিবারের সদস্যরা প্রাণে বাঁচলেও কয়েকজন আত্মীয় এবং প্রতিবেশির মৃত্যু হয়। আমাদের এলাকায় কয়েকটি জায়গায় উপকূলরক্ষা বেড়িবাঁধ ভেঙে টানা কয়েক মাস জোয়ার-ভাঁটা চলে। পরে এসব বাঁধের পাশে রিংবাঁধ দিয়ে পানি বন্ধ করা হয়। তবে অনেকের জমিজমা বেড়িবাঁধের বাইরে রয়ে গেছে। আমার পৈতৃক ভিটেসহ প্রায় পাঁচ বিঘা জমি এখনো বাধেঁর বাইরে। ১৪ বছর পেরিয়ে গেছে। এখনো সেখানে প্রতিদিন জোয়ার-ভাঁটা চলছে। বাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় সেই জমি উদ্ধার হয়নি। বর্তমানে বাঁধের পাশে সরাকারি জমিতে ঘর করে বসবাস করছি।

তিনি বলেন, এলাকায় অনেকেই জমিজমা হারিয়ে এখন নিঃস্ব। অনেকে এই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। আইলার আগে আমাদের গ্রামে প্রচুর ধান হতো। বিভিন্ন ফলের গাছ ছিল। তবে লবণাক্ততার কারনে এখন আর আগেরমতো গাছ-গাছালি জন্মায় না। বর্তমানে খাবার পানির সমস্যা সবচেয়ে বেশি। আইলার পর প্রতিবছরই নতুন নতুন ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এখানকার বাঁধগুলো। নষ্ট হয়ে গেছে রাস্তাঘাট। এককথায়, এখানকার পরিবেশ ধ্বংস হয়ে গেছে। হয়তো আগামীতে আর বসবাসও করা যাবে না।

নতুন ঘূর্ণিঝড় মোখার বিষয়ে জানতে চাইলে হাবিবুল্লাহ বলেন, মোবাইলে দেখেছি এবারের ঘুর্ণিঝড়ের নাম মোখা। এই ঝড় সিডরের মতো ভয়ংকর হবে। আমাদের উপকূলে আঘাত হানার ভয় নেই। তবে ভাঁটিখা গোন (অমাবশ্যার) থাকায় জোয়ারের পানি বেশি বাড়বে না। অতিরিক্ত জোয়ারের পানি বাড়লে বাঁধ ভাঙতে পারে। ঝড়টি কক্সবাজার ও মিয়ানমারের দিকে যাচ্ছে। আল্লাহ ওখানকার সবাইকে নিরাপদে রাখুন।

Advertisement

২০০৯ সালের ২৫ মে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলার তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের বিস্তীর্ণ জনপদ। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাটের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের কাছে সেই দিনটি এখনো আতঙ্কের। দীর্ঘ ১৪ বছর অতিবাহিত হলেও এখনো স্বাভাবিক হয়নি উপকূলের জনপদ। এলাকায় এখনো সুপেয় পানির সংকট প্রবল। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বাড়েনি সাইক্লোন শেল্টার, মেরামত করা হয়নি পাউবো’র ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ। তাই এখনো দুর্যোগ ঝুঁকিতে আতঙ্কিত অবস্থায় থাকেন উপকূলবাসী।

সেদিন ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার বেগে উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আইলা। সুনামির মতো নোনা জলে ভাসিয়ে নেয় উপকূলীয় অঞ্চলের হাজার হাজার বসতভিটা, আবাদি জমির ফসল, সম্পদ আর মানুষ। এ দিনে কেউ হারায় সহায়-সম্পদ, কেউবা স্বজন। সরকারি হিসাবে ওই ঝড়ে ৩৩২ জনের প্রাণহানি হয়।

গাবুরা ইউনিয়নের চাঁদনি মুখা গ্রামের রবিউল ইসলাম জাগোনিউজকে বলেন, আইলার পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো আমাদের এলাকায় মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই নাজুক। বর্ষার দিনে এসব এলাকায় চলাচলের জন্য নৌকা ও ট্রলারই একমাত্র ভরসা। আইলার পর এলাকায় কাজের সুযোগ কম, যে কারণে অনেকে এলাকা ছেড়েছেন। তাদের অধিকাংশ আজও নিজেদের বসতভিটায় ফিরে আসতে পারেননি। এছাড়া বেশিরভাগ এলাকার বেড়িবাঁধের অবস্থা খুবই খারাপ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপকূলরক্ষা বেড়িবাঁধগুলো সংস্কার হলেও নতুন করে নির্মাণ হয়নি। সামান্য ঝড়-বৃষ্টিতেও আমাদের ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হয়।

কেএএ/

Advertisement