ধর্ম

ঐক্য ও নেতৃত্বে জামাল উদ্দীন আফগানি

গত দুইশ’ বছরে সারা মুসলিম বিশ্বে যে কয়জন মহান মুসলিম মনীষী জন্ম নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে জামাল উদ্দীন আফগানি অন্যতম। তার রাজনৈতিক জীবন ও কর্ম সম্পর্কে না জানলে কেউ বুঝতেই পারবে না যে তিনি কত বড় ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ১৮৩৮ মতান্তরে ১৮৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ৯ই মার্চ ১৮৯৭ সালে ৫৮-৫৯ বছর বয়সে বর্তমান তুরস্কের ইস্তাম্বুলে মারা যান।জামাল উদ্দীন আফগানির জীবন ও কর্ম সম্পর্কে জানতে হলে সে সময়কে বোঝা দরকার। তিনি এমন এক সময়ে জন্মগ্রহণ করেন যখন ভারতীয় উপমহাদেশ ইংরেজদের পদানত হয়ে গেছে, ১৭৫৭ সাল থেকে শুরু করে ১৮৫৭ সালের দিকে। যখন ভারত উপমহাদেশে সিপাহী বিদ্রোহ অর্থাৎ স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয় তখন তিনি সতের-আঠারো বছরের যুবক। তখনই ভারতের রাজত্ব কেড়ে নেয় ব্রিটেন (ইংরেজরা) দখলদাররা। জামাল উদ্দীন আফগানি সাম্রাজ্যবাদের উত্থানের ঠিক সে সময়ই জন্মগ্রহণ করেন এবং বেড়ে ওঠেন।আফগানিস্তানে তার জন্ম হলেও তিনি হিন্দুস্থানে আসেন। তৎকালীনর সময়ে গোটা মুসলিম বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশই ভারতীয় উপমহাদেশে বাস করত। এর মধ্যে ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে বেশি এবং মধ্যভাগে বিক্ষিপ্তভাবে মুসলিমরা বাস করত।তারপর তিনি ফ্রান্স হয়ে মিশরে চলে যান। মিশন তখন মুসলিম বিশ্বের মোড়ল। সেখানে তিনি কাজ করেন। তুরস্কে যান এবং তুরস্কের খেলাফত ও রাজনীতিকে প্রভাবিত করেন। তারপর ইরানে যান এবং সেখানেও ইসলাম ও জাতীয়তাবোধের ব্যাপারে কাজ করেন। পাশাপাশি হিন্দুস্থানের রাজনীতিকে তিনি প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন।তিনি তার জীবনে মিসরে মুফতি আবদুহুর মতো একজন নেতা পান। মুফতি আবদুহু’ই তার চিন্তাধারাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার চিন্তা করেন। কাজেই তিনি প্রথম মিসরকেন্দ্রিক সাংবাদিকতা শুরু করেন মুফতি আবদুহু’র সহায়তায়। এরপর তিনি ফ্রান্সে গিয়ে ‘আল উরওয়াতুল-উছকা’ বা শক্ত রজ্জু নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন।জামাল উদ্দীন আফগানি তখন তার লেখায় মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্রীয় সমস্যাগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেন। তিনি তার যুগকে সামনে রেখেই কথা বলেছেন। যেমন আমরা আমাদের যুগকে সামনে রেখে কথা বলে থাকি। তিনি দুটি বিষয়ের প্রধান অভাববোধ করেন।একটি হলো অনৈক্য। তিনি বলেছেন, বিদেশি শক্তি আমাদের অনৈক্যের সুযোগে ঢুকে পড়েছে। আর দ্বিতীয় যে বিষয়ের ওপর তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন সেটি হলো নেতৃত্ব। তিনি বললেন, মুসলিমদের মধ্যে নেতৃত্বের অভাব ঘটেছে এবং শক্ত নেতৃত্ব নেই।যদিও বলা যায়, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারীর অধিকার এসব বিষয় তিনি আনেননি। সে যুগে এগুলো বড় প্রশ্ন ছিল না। তখনকার সময় বড় প্রশ্ন ছিল মুসলিম জাতিকে রক্ষা করা। তাই তিনি দুটি জিনিস—অনৈক্য ও নেতৃত্বকে সার্বিকভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন।তিনি আবার বলেছেন, ‘ঐক্য ও নেতৃত্ব ইসলামী সুউচ্চ প্রাসাদের দুটি প্রধান স্তম্ভ। এগুলোকে অটুট রাখার জন্য চেষ্টা করা ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি ব্যক্তির ওপর ফরজ।তিনি এভাবেই ঐক্য ও নেতৃত্বকে কল্পনা করতেন। একথা একবিংশ শতাব্দীর আজকের দিনেও সত্য যে আমরা পাশ্চাত্য থেকে যেসব কারণে পিছিয়ে আছি তার মধ্যে রয়েছে ঐক্যের এবং যোগ্য নেতৃত্বের অভাব। বিভিন্ন দেশে মুসলমানরা যেভাবে মার খাচ্ছে সেখানেও আমরা শক্তিশালী কোনো অবস্থান এখনও তৈরি করতে পারিনি।জামাল উদ্দীন আফগানি একজন অত্যন্ত জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তার কালের প্রধান মুসলিম রাষ্ট্র ও তার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন এবং সেখানে তিনি কাজ করেছেন।তিনি সাংবাদিকতার গুরুত্ব বুঝেছিলেন এবং তার মাধ্যমে তিনি কাজ করেছিলেন। তিনি নিজে ফারসি ভাষাভাষী হওয়া সত্ত্বেও আরবির গুরুত্ব উপলব্ধি করেন এবং আরবিকে তার সাহিত্যের এবং লেখার ভিত্তি করেন।তিনি বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, প্রথম সমস্যা ঐক্য আর দ্বিতীয় সমস্যা হলো নেতৃত্ব দেয়ার লোক না থাকার কারণে ভারতীয় উপমহাদেশে পরাধীনতার শৃঙ্খল পরানো হয়েছে। এছাড়াও তিনি শিক্ষার জ্ঞানের কথা বলেছেন, ভ্রাতৃত্বের ও বীরত্বের কথা বলেছেন।জামাল উদ্দীন আফগানির এসব কথা আজকের মুসলিম জাতির জন্যও প্রযোজ্য। আল্লাহ তাআলা জামাল উদ্দিন আফগানিকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। আমিন।এমএমএস/আরআইপি

Advertisement