সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি আদালতে যৌন নির্যাতনকারী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং একই সঙ্গে আরেকটি ফৌজদারি মামলার আসামি। আর এ ঘটনা এমন সময়ে ঘটলো, যখন তিনি ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়ার প্রচারণা চালাচ্ছেন এবং রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থীদের মধ্যে জনপ্রিয়তার দৌড়েও অন্তত এখন পর্যন্ত তিনিই এগিয়ে।
Advertisement
গত মঙ্গলবার (৯ মে) নিউইয়র্কের একটি আদালতের জুরিরা রায় দিয়েছেন, ১৯৯০’র দশকে ম্যানহাটানে ই জিন ক্যারল নামে এক কলামিস্টকে যৌন নির্যাতন করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ক্যারলের অভিযোগ, ট্রাম্প তাকে একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ড্রেসিং রুমের ভেতর ধর্ষণ করেছিলেন। কিন্তু আদালতে সেটি প্রমাণিত হয়নি। তবে যৌন নির্যাতন ও মানহানি প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাম্পকে ৫০ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত।
আরও পড়ুন>> যৌন হেনস্থা প্রমাণিত: ট্রাম্পকে ৫০ লাখ ডলার জরিমানা
Advertisement
এর কিছুদিন আগে গত ৩০ মার্চ নিউইয়র্কে আরেক মামলায় একজন সাবেক পর্নো তারকাকে মুখ বন্ধ রাখার জন্য অর্থ দেওয়ার দলিলপত্র জালিয়াতির দায়ে ট্রাম্প অভিযুক্ত হয়েছেন। ওই মামলায় বলা হয়, ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ট্রাম্প ওই পর্নো তারকাকে অর্থ দেওয়ার জন্য তার ব্যবসায়িক কাগজপত্রে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন।
ই জিন ক্যারল
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কোনো সাবেক বা ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম।
ডোনাল্ড ট্রাম্প দুটি ক্ষেত্রেই নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন এবং বলেছেন, এসব অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
Advertisement
ট্রাম্প কি ফের নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন?প্রশ্ন উঠছে, এসব মামলার ফলে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করায় কোনো বাধা সৃষ্টি হবে কি না? আইন বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃত করে টাইম ম্যাগাজিন বলছে, এক কথায় এর উত্তর হচ্ছে, ‘না, তেমন কিছুই হবে না’।
যুক্তরাষ্ট্রে কেউ ‘ফেলোনি’ বা গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত হলেও তার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করার পথে কোনো সাংবিধানিক বাধা নেই, বলেছেন ইউসিএলএ ল’ স্কুলের নির্বাচনী আইন সংক্রান্ত অধ্যাপক রিচার্ড হ্যাসেন।
আরও পড়ুন>> যুক্তরাষ্ট্রে নতুন ইতিহাস: ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত ট্রাম্প
মার্কিন সংবিধান অনুসারে, কমপক্ষে ৩৫ বছর বয়সী যেকোনো নাগরিক, যার যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে জন্ম হয়েছে এবং যিনি দেশটিতে ১৪ বছর থেকেছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হতে পারবেন। যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলো এ আইনে কোনো পরিবর্তন আনতে পারে কি না তা স্পষ্ট নয়।
নির্বাচনে দাঁড়াতে বাধা নেই ট্রাম্পের
সুতরাং, ট্রাম্প তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা থাকলেও বা জেল হলেও তার নির্বাচনী প্রচারাভিযান চালিয়ে যেতে পারবেন। তাছাড়া, মামলার জুরিরা ই জিন ক্যারলকে যে ৫০ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, সেই অর্থও ট্রাম্পকে এখনই দিতে হচ্ছে না। মামলার আপিলের প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরেই দণ্ড বহাল থাকলে জরিমানা দিতে হতে পারে তাকে।
ইতিহাস কী বলেবিশেষজ্ঞরা বলছেন, কারাগারে থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অন্তত দুটি নজির রয়েছে।
১৯২০ সালে ইউজিন ডেবস নামে সোশ্যালিস্ট পার্টির এক ব্যক্তি গুপ্তচরবৃত্তি আইন লঙ্ঘনের দায়ে আটলান্টায় জেলে থাকা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হয়েছিলেন।
এছাড়া, লিন্ডন লা’রুশ নামে আরেকজন ১৯৯২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন কারাগারে থাকা অবস্থায়। তিনি ট্যাক্স জালিয়াতির মামলায় জেল খাটছিলেন।
আরও পড়ুন>>> কে এই স্টর্মি ড্যানিয়েলস, যার জন্য দণ্ডের মুখে ট্রাম্প?
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, দণ্ডিত অবস্থায় বা ধরা যাক জেলে থাকা অবস্থায় কোনো প্রার্থী যদি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতে যান, তাহলে কী হবে- তার কোনো ব্যাখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের আইনে নেই।
আবার, ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে করা কোনো মামলার বিচার চলবে কি না বা তা কীভাবে হবে, মামলায় প্রেসিডেন্ট দণ্ডিত হলেই বা কী হবে– এসব প্রশ্নে ব্যাপক আইনি জটিলতা দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ট্রাম্পের জন্য বিপৎসংকেত২০২০ সালের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের উপশহরগুলোর ভোটাররা, বিশেষ করে নারীরা ট্রাম্পের রাজনীতি থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সবশেষ দুটি মামলা হয়তো এই শ্রেণির ভোটারদের তার কাছ থেকে আরও দূরে সরিয়ে নেবে।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ তুলেছেন সাবেক পর্নো তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলস। ছবি সংগৃহীত
এতদিন পর্যন্ত ট্রাম্প বেশ সুশৃঙ্খলভাবেই ২০২৪ নির্বাচনের জন্য প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। তার নির্বাচনী দল গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলোর প্রাইমারিতে তৃণমূল পর্যায়ে সমর্থন গড়ে তুলছিলেন। এমনকি, সাবেক পর্নো তারকাকে অর্থ দেওয়ার মামলাটিকেও ট্রাম্প তার প্রতি সমর্থন বাড়াতে কাজে লাগাচ্ছিলেন।
তবে এখন যৌন নির্যাতনের মামলাটি হয়তো তার প্রতিপক্ষের সামনে পাল্টা আক্রমণ চালানোর রাস্তা খুলে দিতে পারে।
আরও পড়ুন>> ক্ষমতা হারানোর পর বিচার হয়েছে যেসব দেশের সরকারপ্রধানের
তাছাড়া, যদিও ট্রাম্প এতদিন ধরে এসব মামলা ও আইনগত সমস্যাকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অপচেষ্টা বলে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন, কিন্তু এখন সাধারণ মার্কিনিদের মনে এই ধারণা তৈরি হতে পারে যে, সাবেক প্রেসিডেন্ট আসলেই অপরাধ করেছেন।
কিছু বিশ্লেষকের মতে, এবারের মামলাটি অন্যগুলোর মতো নয়। একজন নারীকে যৌন নির্যাতনের ঘটনা খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। তাই এটিকে উড়িয়ে দেওয়া ট্রাম্পের জন্য অত সহজ হবে না।
ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, এটি এমন একটি ইস্যু যার প্রতি মার্কিন জনগণের প্রতিক্রিয়া অন্য কিছুর তুলনায় বেশি বিরূপ হতে পারে এবং আগের কিছু জনমত জরিপে এমন আভাসও পাওয়া গেছে।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আরও কিছু মামলা রয়েছে, যেমন- মার্কিন কংগ্রেস ভবনে আক্রমণের ঘটনায় জড়িত ছিলেন কি না, হোয়াইট হাউস ছাড়ার পর গোপনীয় দলিলপত্র নিয়ে কী করেছিলেন, ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের (যাতে তিনি পরাজিত হন) ফলাফল উল্টে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন কি না- এমন বেশ কিছু অভিযোগের এখনো তদন্ত চলছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব মামলার জন্য ট্রাম্পকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু এগুলো তার জন্য ভবিষ্যতে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
সূত্র: বিবিসি বাংলাকেএএ/