বাবর আলী। পেশায় চিকিৎসক, নেশায় পর্বতারোহী। সাইক্লিং, ম্যারাথন রানও তার সঙ্গী। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। সম্প্রতি তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে জয় করেছেন হিমালয়ের সাড়ে ২২ হাজার ফুটের ভয়ংকর চূড়া ‘আমা দাবালাম’। এর আগে হেঁটে ভ্রমণ করেছেন দেশের ৬৪ জেলা। সাইকেল চালিয়ে দেশের মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু কৃতিত্ব। এবার দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন বৈচিত্র্যময় দেশ ভারতে। ভূ-স্বর্গখ্যাত কাশ্মীরের শ্রীনগর থেকে বানিহাল, উধমপুর, জম্মু, পঠানকোট হয়ে দিল্লি ও আগ্রা। পরে মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র, ঝাঁসী পেরিয়ে প্রবেশ তেলঙ্গানায়। এর পরে অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক হয়ে তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারীতে সফর শেষ হবে। তার হিসাবে সব মিলিয়ে ৪৫ দিনে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার সফর করবেন তিনি।
Advertisement
এই সফরের প্রতিদিনের গল্প থাকবে জাগো নিউজে। আজ থাকছে ২৪তম পর্ব।
দিন ২২। ওষুধের ছোট্ট একটা বোঝা রাইডের প্রথম থেকেই সাইকেলের প্যানিয়ারে বইছি। অবশেষে প্রথমবারের মতো নিজের জন্য ওই ঝোলায় হাত দিতে হলো। অবশ্য বারতিনেক ধাবার ছোকরাদের অল্প-স্বল্প ওষুধ দিয়েছি। ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল আর হাঁটুর ছেঁড়ায় ভায়োডিন আয়োডিনটা কাজে লাগলো। রাতে ধাবার এক কোণে তাঁবুর ফেব্রিক বিছিয়ে তার ওপর চাদর মুড়িয়ে ঘুম।
সকালে সূর্য ওঠার আগেই ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পড়া। আড্ডাকাল পেরোতেই পাথুরে পাহাড়ের পেছন থেকে সূর্য উঁকি দিতে শুরু করলো। পাথরের পাহাড়গুলোর নিচে একসারি সবুজ গাছপালা। নিচের সবুজ লাবণ্য গিয়ে পাথুরে কাঠিন্য বিলীন হয়ে গেছে। কানিমেট্টা গ্রামে পৌঁছানোর অনেক আগে থেকে বিয়ের বাজনা কানে আসছিল। সম্ভবত পুরো রাত অনুষ্ঠান হয়েছে। বাড়ির ছাদে নারীদের দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে পুরুষদের ছোট দলের দুজন রাস্তায় টলোমলো পায়ে হাঁটছে। দ্রাক্ষারসের প্রভাবেই সম্ভবত।
Advertisement
সাতটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম কোথাকোতা। এই মিউনিসিপালিটিতে প্রবেশের মূল সড়ক দখল করে ধান শুকানো হচ্ছে। আর গাড়ির সওয়ারিরা ভাঙাচোরা সড়ক ধরে এগোচ্ছে। বাইপাসের মুখেই এক ঘোড়সওয়ারির ভাস্কর্য আছে। ঘোড়া, তলোয়ার, সওয়ারি সবাই গেরুয়া কাপড়ে ঢাকা। পর্দানশীনতার হেতু উদঘাটন করা গেলো না।
আরও পড়ুন>> বাইকের ধাক্কায় হ্যান্ডেলবারের ওপর দিয়ে উড়ে পড়লাম রাস্তায়
আজ প্রথম রাস্তার ধারে অ্যালবিজিয়া গাছ পাওয়া গেলো। রাস্তার ধারে অসংখ্য ধাবা। এগুলো অবশ্য ফ্যামিলি ধাবা নামে নিজেদের প্রচার করছে। ধাবার অন্যতম বৈশিষ্ট্য চারপাই অনুপস্থিত এই তথাকথিত ধাবাগুলোতে। বদলে আছে এসি কেবিন। ওয়ানাপারতি হয়ে আমাদাবকুলা। কঠিন সব নামে দাঁত নড়বড়ে। কিছুটা এগোতেই পাথুরে পাহাড়গুলোর আকার ছোট হতে শুরু করলো। ক্ষণেক বাদে একেবারে টিলার আকার। কাদুকুন্তলা থেকে পথের ধারে লাল-হলুদ রঙের মিশেলে বানানো যাত্রী ছাউনি চোখে পড়ছে। তেলেঙ্গানার অন্য যাত্রী প্রতীক্ষালয়গুলো থেকে আকৃতিতে-রঙে বেশ ভিন্ন। এ অঞ্চলে জনবসতি যথেষ্ট ঘন। একের পর এক জনপদ রাস্তার ধারে। কলেবরেও বেশ বড় গ্রামগুলো। কোন্ডা থান্ডা ছাড়াতেই রাস্তার অপর পাশে হাজারটা ছাগলের পাল। এত বড় ছাগলের পাল চর্মচক্ষে আগে কখনো দেখিনি।
আজ রাস্তার দুই ধারই নিম গাছের দখলে। কাস্তের মতো বাঁকানো চিরল পাতার ফাঁকে কাচা সবুজ ফল এসেছে। এই একটা উদ্ভিদের মোটামুটি সব অংশই কাজে লাগে। কোনো কিছুই ফেলনা নয় এ ওষুধি বৃক্ষের। ডিভাইডার যথারীতি বাগানবিলাসের দখলে। ধাবাগুলোর নামে ‘ইউপি বিহার ধাবা’ নামের আধিক্য। কাজের টানে ভিন ভাষার রাজ্যে ছুটে আসা মানুষের সংখ্যা অনেক। টানা চালিয়ে পেববাইর। বেশ বড় শহর। মূলত এটি একটি মন্ডল। আমাদের দেশের উপজেলা পর্যায়কে এখানে তহসিল বলা হয়। আবার এই তহসিল নামটা দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে অচল। তহসিলের বদলে ব্যবহার করা হয় মন্ডল শব্দটি।
Advertisement
রঙ্গপুরম ছাড়িয়ে পড়লো কৃষ্ণা নদী। গঙ্গা আর গোদাবরীর পরে ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম নদী। প্রথমোক্ত দুটোর মতো এটিও পবিত্র নদী। পাপ ধুয়ে ফেলার উৎসব এই নদীতেও হয়। তবে সেটা বারো বছরে একবার। কেউ পাপ জমাতে চায় না। খালি শরীর থেকে মুছে ফেলতে চায়। ধুয়ে ফেলা পাপগুলো আসলে যায় কোথায়? সাগরে গিয়ে মেশে নাকি সেচকাজে ব্যবহৃত পানির সঙ্গে কৃষিজমিতে চলে যায়? এছাড়া দীর্ঘ এই নদীর খাত ধরেই অনেকগুলো তীর্থযাত্রা হয়। অন্ধ্রপ্রদেশেও এর বিশাল খাত। নদীপ্রবাহের মাঝে একটা গোটা পাহাড়ও আছে। পাহাড়ই পানির প্রবাহকে দ্বিধারায় বিভক্ত করেছে। সবুজ ওই পাহাড়ে দুর্গের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষও আছে। দুর্গের নাম নাজিম কোন্ডা। এটি এমন এক দুর্গ, যেখানে শুধু নৌকার সাহায্যেই পৌঁছানো যায়। নদীর দুই ধারার মাঝের অংশে বালুর চর আর তার মাঝে থোক থোক সবুজ মাথা তুলেছে।
আরও পড়ুন>> ইডলি-সাম্বারে পেটপুরে দক্ষিণে প্রবেশের প্রস্তুতি নাগপুরে
কৃষ্ণা নদীর বিশাল সেতুর ওপর অনেকগুলো অতি ধীরগতির গো-শকট। দুই বিশাল বলদে টানা গাড়ির পেছনে বালু বোঝাই। সামনে বেত হাতে বসা শকটের চালক। সেতু ছাড়িয়েই চে গুয়েভারা ফুড কোর্ট। পাশের এক টিফিন সেন্টারে পুরি আর নারকেলের চাটনি সহযোগে সকালের নাশতা তথা টিফিন সারলাম। মুড়ি ভাজার মতো একটা খাবারও চাখলাম। পুলিহারা টাইপ কিছু একটা উচ্চারণ করেছে বিক্রেতা। ভাষার বোধগম্যতার অক্ষমতায় সঠিক নাম জানা হলো না। এররাভাল্লি থেকে এগিয়ে জিনকাকা পল্লি। রাস্তার ধারের টিফিন সেন্টার, জুস পয়েন্টসহ নানান ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ‘সাই’ নামের বহুল ব্যবহার। বোরাভাল্লি পেরোতেই মহাসড়কের সঙ্গে সেঁটে থাকা বসতিগুলো এবার দূরে সরেছে। সংযোগকারী রাস্তা ধরে বেশ ভেতরে গেলে তবেই গ্রাম। পরের গ্রাম মোনাপাডু। প্রতিটা বসতির কাছের যাত্রী ছাউনিতে বাসের অপেক্ষায় থাকা যাত্রীদের ভিড়। তেলেঙ্গানার সরকারি বাস থামছে ছাউনির সামনে। আর পিলপিল করে উঠে যাওয়া যাত্রীদের পেটে ধরে নিয়ে গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছে বাস।
পরের জনপদের নাম জাল্লাপুরম। দক্ষিণের এই অংশে গ্রামের নামের শেষে পুরম, পাডু, পল্লি কিংবা ভাল্লি নামের প্রাচুর্য। ঘুরেফিরে যে কোনো নামের সঙ্গে এগুলোই যুক্ত হয়। গত কদিনের অভিঘতা তা-ই বলে। নিমের ওষুধি গাছ এখনো পাশের রাস্তা দখল করে রেখেছে। চলতে চলতেই এক মোটরসাইকেল আরোহীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তার কৌতূহলী জিজ্ঞাসা, ‘Will you get preference for govt. job after finishing the ride?’ আমি তাকে জানালাম, আমি ভিনদেশের নাগরিক।
আজও গাড়ির বেপরোয়া গতি কমেনি। এর সাক্ষ্য। মহাসড়কে পড়ে থাকা নানান স্টাফ করা প্রাণী। মাংস শুকিয়ে চামড়াটাই সেঁটে আছে সড়কের ওপর। কাঠবিড়ালি, কুকুর, বেড়াল, ব্যাঙ, সাপ- কিছুই বাদ নেই। সদ্য প্রাণ হারানো বিশালাকার এক ব্যাঙ নেতিয়ে পড়ে আছে। এর মাঝেই পরিচয় হলো রবির সঙ্গে। ভারতের ফুডপান্ডা তথা ‘জোমেটো-এর ফুড ডেলিভারির কাজ করে ও। আমার সাইকেলের গতিতে সমান্তরালে মোটরবাইক চালালো অনেকক্ষণ। ওর সঙ্গে গল্পে গল্পেই তুঙ্গভদ্রা নদী। এই সেই শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের তুঙ্গভদ্রা নদী! কত শুনেছি আর কল্পনা করেছি। তুঙ্গ আর ভদ্রা- এই দুই ধারার মিলনেই তুঙ্গভদ্রা। কথায় আছে, ‘গঙ্গার জলে স্নান, তুঙ্গার জল পান।’ দুটোই সমান পুণ্যের কাজ। অবশ্য নদীর খাতের দিকে তাকিয়ে মনে হলো এই জল পান করলে উদরের ব্যামো হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আগ্রাসী শিল্পদূষণের শিকার এই নদী। অবশ্য দুনিয়ার কোনো নদীই আজকাল দূষণ থেকে মুক্ত নয়। বিশাল এই নদীর দুই কূলকে বেঁধে ফেলা সেতু পেরিয়ে প্রবেশ করলাম আমার এই যাত্রার নবম প্রদেশে। তেলেঙ্গানা ছাড়িয়ে অন্ধ্রপ্রদেশ।
জেলার নাম কারনুল। কারনুলের নাম প্রথম শুনি বেসিক মাউন্টেনিয়ারিং কোর্সের আমার রোপমেট চেতন সাইয়ের কাছ থেকে। অন্ধ্র প্রদেশের এই শহরেই ওর আবাস। কোর্স করার সময় ওর বয়স ছিল ষোল। একটু ঝুঁকি নিয়ে বলে ফেলাই যায়, পুরো কোর্সে মাউন্টেনিয়ারিং নিয়ে ওর মতো নিরুৎসাহী, নিরুদ্যম ছেলে আর ছিল না। পড়াশোনায় অসম্ভব ভালো চেতনের মূল আগ্রহ মেডিকেলে পড়া নিয়ে। এনসিসি করার সুবাদে ও এই কোর্স করার সুযোগ পেয়েছে। বলা বাহুল্য, পড়াশোনায় টপার চেতন এনসিসিতেও টপার। ওর বাবা ডাক্তার। ভাইও তখন মেডিকেলে পড়ছে। আমাকে পেয়ে ব্যাটা জ্বালিয়ে খেয়েছে। হাসপাতাল থেকে ছুটি ম্যানেজ করে এসেছি মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স করতে; ব্যাটা আমাকে এখানেও হাসপাতালের গণ্ডি থেকে বেরোতে দিতো না। নিমের ডর্মে আমার ওপরের বাংক বেডেই শুতো ও। আর হাজারটা প্রশ্ন ছুড়তো মেডিকেল, কারিকুলাম আর হাসপাতাল নিয়ে।
আরও পড়ুন>> রুক্ষ ভোপালে ধাবায় রাত্রিযাপনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা
প্রথমদিকের কোনো একদিন ওকে মানবদেহের হাড়গুলো সহজে মনে রাখার সূত্র শিখিয়েছিলাম। ও বিষয়টাতে আনন্দ পেয়ে আমার জীবন প্রশ্নবাণে ত্যানা ত্যানা করে দিয়েছে! তার ওপর রোপে ইংরেজিভাষী আছি নিতেশ, অনিল আর আমি। আর চেতনের হিন্দি জ্ঞান হিমাঙ্কের নিচের কাঁটায়। যাই হোক, বয়সে সবার চেয়ে ছোট হওয়ায় ওকে ‘ছোটু’ নামে ডেকে বেশ প্রশ্রয় দিতাম সবাই। কারনুল আসার দিনতিনেক আগেই ওর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। কিন্তু ওর পাত্তা নেই। সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে ওর অ্যাকাউন্ট থাকলেও সেগুলো ও বছরে দুই ঈদের নামাজ আদায় করা মুসল্লিদের মতো ব্যবহার করে। স্বাভাবিকভাবেই এ যাত্রায় দেখা হলো না।
কারনুল বাইপাস হয়ে শহরে ঢুকে পড়লাম। মাসা মসজিদের পুষ্কর ঘাট থেকে তুঙ্গভদ্রাকে আরেকটু কাছ থেকে দেখার ইচ্ছে। ঘাটে গিয়ে কৃষ্ণা নদীর সেতুর ওপর এত এত গরুর গাড়ি দেখার রহস্য উদঘাটন করতে পারলাম। গো-শকটগুলো সোজা নামানো হয় নদীর পানিতে। গরুকে কোমর পানিতে নামিয়ে পিঠের বড় ক্যারিয়ারটা বোঝাই করা হয় বালু দিয়ে। একেবারে প্রাকৃতিক ড্রেজিং যাকে বলে আর কী! অসংখ্য গরুর গাড়ি তুঙ্গভদ্রার জলে।পুষ্কর ঘাটে মূলত লোকে আসে অলস সময় কাটাতে। চরের বালুময় অংশে ডেকোরেটারের কাপড় শুকানো হচ্ছে। বেরিয়ে এগোলাম কারনুল শহরের দিকে। ছিমছাম, গোছানো শহর এই কারনুল। আমার অসম্ভব ভালো লাগলো শহর। পথে এক জায়গায় পিস্তা মিল্ক খেলাম। দুধে বাদাম মেশানো এই পানীয় খেয়ে প্রাণ ভরে গেলো। ফ্রুট সালাদটাও খেতে খুব ভালো।
এগিয়ে শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে কোন্ডা রেড্ডি ফোর্ট। দ্বাদশ শতাব্দীতে নির্মাণ শুরু হয় এই দুর্গের। ধাপে ধাপে পাথুরে এই কেল্লা নির্মাণের কাজ শেষ হয় ষোড়শ শতাব্দীতে। এত ছোট দুর্গ এই রাইডে আর চোখে পড়েনি। পাথরের এই দুর্গ মূলত ব্যবহার করা হতো পর্যবেক্ষণের কাজে। কারনুলের শেষ রাজা কোন্ডা রেড্ডির নামে সবাই চেনে একে। জনশ্রুতি আছে, নবাবরা আক্রমণ করার পর রাজা কোন্ডা রেড্ডি দুর্গের অভ্যন্তরে থাকা সুড়ঙ্গপথে পালিয়ে বেঁচেছিলেন। প্রাণে বাঁচলেও হারাতে হয় রাজত্ব। তিন তলা এই দুর্গের নিচের তলা দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত নয়। কে জানে, সেই সুড়ঙ্গকে রক্ষা করতেই কি না এই আয়োজন! দ্বিতীয় এবং তৃতীয় তলায় সবার প্রবেশাধিকার। প্রচুর স্থানীয় লোকের ভিড় দুর্গজুড়ে। এতক্ষণ আবছা আলো দেওয়া সূর্যটা হঠাৎ প্রখর হয়ে উঠলো। মনে পড়লো, চেতন বলতো কারনুলে ৪৬/৪৭ ডিগ্রি তাপমাত্রা বেশ সাধারণ ঘটনা!
পরের গন্তব্যের দিকে এগোচ্ছি। শহরজুড়ে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান-তিন ধর্মের লোক এবং তাদের উপাসনালয়গুলো চোখে পড়ছে। হান্দ্রি নদীতটে শুয়ে আছেন কারনুলের প্রথম নবাব আব্দুল ওয়াহাব খান। চারশ বছরের পুরোনো কবরখানার ওপরে বিশাল দুটো গম্বুজ। সংলগ্ন জায়গায় আরও অসংখ্য কবর। পাথর আর সিমেন্টের তৈরি পুরো স্থাপনাটাই বেশ দৃষ্টিনন্দন। জায়গাটা অবশ্য স্থানীয় মুসলিম মহল্লার খুদে ক্রিকেটারদের দখলে। আমাকে ঘিরে ওদের কৌতূহলের অন্ত নেই। ‘ইয়ে গিয়ার সাইকেল হ্যায় কিয়া’, ‘এক হুইলি মারো না আন্না’, ‘রেস করতে হে আপ’- ইত্যাদি হাজারটা প্রশ্ন।
বেরিয়ে হান্দ্রি নদীর ওপর সেতু। আজকের দিনে অল্প জায়গার মধ্যে দেখা এটি তিন নম্বর নদী। মূলত তুঙ্গভদ্রার শাখা নদী এই হান্দ্রি। এত অল্প দূরতে তিন-তিনখানা নদী এই রাইডে প্রথম দেখা। বাংলাদেশের তুলনায় ভারতে এমনিতেই নদীর সংখ্যা কম।
রাস্তার ধারের এক বেকারিতে ১০ রুপির ক্রিম বান নিলাম একটা। স্বাদকোরকে আন্দোলন তোলায় আরো একটা পাতে তুলতেই হলো। কারনুলের বাজারে সজারু সদৃশ ফল কাঁঠাল বিক্রি হচ্ছে বয়ামে করে। পাকা কাঁঠাল এভাবে বিক্রি হতে আগে দেখিনি। কারনুল শহর দেখায় মশগুল থাকাতে রাস্তা ভুল করলাম। এনএইচ-৪৪ এর বদলে কারনুল-চিত্তোর মহাসড়কে উঠে এই গরমে অতিরিক্ত পাঁচ কিলোমিটারের মাশুল দিতে হলো।
ঠিক রাস্তায় উঠে ডুপাডু ছাড়াতেই রাস্তা হয়ে গেলো বিস্তৃত। দুপাশে বসতি নেই। দিগন্তে ফের টিলাগুলো মাথা তুলেছে। আর রাস্তাও অনেকটুকু ফাঁকাই। পাতলা যান চলাচলের সুবিধা নিয়ে বিশাল এক গুইসাপকে রাস্তা পেরোতে দেখলাম। টানা চালিয়ে ভেল্ডুরথি। আমাদের দেশের মতো মাইক বাজিয়ে পয়সা তুলছে স্থানীয় মন্দিরের গেরুয়া রঙের কাপড় পরিহিত পুরোহিত। হুবহু বাংলাদেশের দৃশ্য। শুধু দেশ আর ধর্মটা বদলেছে। আজ হাইওয়ের ধারে অনেক মাদরাসা চোখে পড়ছে। এমনকি মেয়েদের জন্য আলাদা মাদরাসাও দেখলাম দুটো। আমাকাথাডূ টোল প্লাজা পেরোতেই রাস্তার ধারের জমিগুলো পাথরের দখলে চলে গেলো। বিশালাকৃতি পাথরের জন্যই চাষবাস হয় না। কিছুদূর এগোতেই কন্যাকুমারী অবধি দূরত্বকে প্রথম তিন সংখ্যায় দেখলাম। এখান থেকে দূরত্ব ৯৯৪ কিলোমিটার। এদিকে শহর থেকে দূরে রিয়েল এস্টেট ব্যবসার রমরমা। হলদে পিলার দিয়ে প্লটের নাম্বারিং করা আছে বিশাল সব জমিতে। উদুমুলাপাদুর মন্দিরের সঙ্গেই একই নামের চেরুভু তথা লেক। টানা চালিয়ে ধোনে। এদিকে পাথুরে জমিতে চাষ না হলেও সবুজ ছাউনি দিয়ে সূর্যের তীব্র গরমকে আড়াল করে কিছু জায়গায় চাষ হয়। প্রকৃতির বিরূপতার বিরুদ্ধে যুঝতে মানুষ কত কিছুই না করে!
অনেকক্ষণ যাবত থাকার উপযোগী ধাবার খোঁজে চোখ রাখছি। ধাবার সংখ্যা এদিকে হাতেগোনা। হোটেল নামধারী যেগুলো আছে, সেগুলো আসলে টিফিন সেন্টার। ঘড়ির কাঁটা প্রায় ছয়টা ছুঁই ছুঁই। অবশ্য আরও এক ঘণ্টা সূর্যের আলো পাওয়া যাবে। তাও মরিয়া হয়ে একটা টিফিন সেন্টারেই কথা বললাম। ভাষার ভিখারি হয়েও মালিক আন্নাকে কীভাবে যেন বুঝিয়ে ফেললাম রাত কাটানোর ব্যাপারটা। ইশারাতেই কাজ সেরে গেছে। একটু বাদেই পাশের চেকপোস্ট থেকে কফি খেতে পুলিশ এলো। চার পুলিশ সদস্যের অনর্গল তেলেগুর যন্ত্রণায় শিরঃপীড়া শুরু হওয়ার উপক্রম। ইশারা কার্যক্রম অব্যাহত রেখে রাতের খাবারের ব্যাপারটাও বোঝানো গেছে। দেখা যাক ‘সমঝদারো কে লিয়ে ইশারাই কাফি হ্যায়’ কতদূর অবধি নিয়ে যায়!
চলবে…
এএসএ/জিকেএস