আন্তর্জাতিক

মণিপুর ছেড়ে পালাচ্ছে মানুষ, মিজোরামে শরণার্থীর ঢল

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে ছড়িয়ে পড়া জাতিগত সংঘাতে অন্তত ৫৪ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আতঙ্কে ঘর ছাড়ছে হাজার হাজার মানুষ। মণিপুর থেকে প্রায় ৬০০ জন পার্শ্ববর্তী মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছে, যারা প্রায় সবাই কুকি-চিন-মিজো জনগোষ্ঠীর মানুষ। অন্য রাজ্যগুলো তাদের বাসিন্দাদের মণিপুর থেকে জরুরি ভিত্তিতে সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বিশেষ প্লেন পাঠিয়ে তাদের নিজ নিজ রাজ্যে ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

Advertisement

গত বুধবার থেকে অগ্নিগর্ভ মণিপুরে পরিস্থিতি এখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে বলে জানাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। ভারতীয় সেনাবাহিনী ও আসাম রাইফেলস মিলে রোববার পর্যন্ত ওই রাজ্যের ২৩ হাজারেরও বেশি মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়েছে। এছাড়া মণিপুর থেকে নিজেদের লোকজন সরিয়ে নিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, সিকিম, অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, দিল্লি, মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যগুলো।

এদিকে মণিপুর পরিস্থিতি নিয়ে প্রথমবারের মতো মুখ খুলেছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তিনি বলেছেন, এ রাজ্যের মেইতেই সম্প্রদায়কে তফসিলি উপজাতির মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন>> ভারতের মণিপুরে জাতিগত সহিসংতা, নিহত বেড়ে ৫৪

Advertisement

প্রসঙ্গত, মেইতেই সম্প্রদায়কে তফসিলি উপজাতির মর্যাদা দেওয়ার সুপারিশ করে সম্প্রতি কেন্দ্রের আদিবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে চিঠি লিখতে মণিপুর সরকারকে নির্দেশ দেয় ভারতীয় হাইকোর্ট। এরপর থেকেই রাজ্যটিতে সহিংসতার সূত্রপাত হয়।

এরই মধ্যে হাইকোর্টের এই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে মণিপুরে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির এমএলএ ডিনগাংলুং গাংমেই সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন হয়েছেন। তার সেই আবেদনের ওপর সোমবারই শীর্ষ আদালতে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।

উদ্ধার অভিযানইম্ফলে কেন্দ্রীয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন পশ্চিমবঙ্গের এমন ১৮ জন শিক্ষার্থী সোমবার সকাল ১০টার দিকে কলকাতা বিমানবন্দরে নামেন।

কলকাতা বিমানবন্দরে মণিপুর-ফেরত ছাত্রছাত্রীরা। ছবি সংগৃহীত

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী এরপরই টুইট করেন, নবান্ন কন্ট্রোল রুমে ডিসট্রেস কল পাওয়ার পর এই ছাত্রছাত্রীদের সরকারি খরচে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিমানবন্দরে আমাদের কর্মকর্তারা তাদের রিসিভ করেছেন ও সেখান থেকে তাদের বাড়ি যাওয়ারও ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আরও পড়ুন>> থমথমে মণিপুর, রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি কংগ্রেসের

একইভাবে ত্রিপুরা সরকারও বিশেষ প্লেন ভাড়া করে মণিপুর থেকে তাদের ২০৮ জন ছাত্রছাত্রীকে ফিরিয়ে নিয়েছে। এদের বেশিরভাগই রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেসে ডাক্তারি পড়তেন। মণিপুরের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে তারা আরও ৩৭ জন শিক্ষার্থীকে পুলিশি পাহারা দিয়ে প্লেনে আগরতলায় নেওয়ার ব্যবস্থা করেছে।

অন্ধ্র প্রদেশের প্রায় দেড়শ শিক্ষার্থী এই মুহূর্তে মণিপুরে রয়েছেন। তাদের উদ্ধারের জন্য প্লেন ভাড়া করতে কেন্দ্রের বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাহায্য চেয়েছে রাজ্য সরকার।

এদিক থেকে তেলেঙ্গানা সরকার একধাপ এগিয়ে। তারা এরই মধ্যে ইম্ফলে বিশেষ প্লেন পাঠিয়ে দিয়েছে। তাদের ছাত্রছাত্রীরাও মণিপুর থেকে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন।

গত কয়েকদিনের সহিংসতায় বহু বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছবি সংগৃহীত

মেঘালয়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আম্পারিন লিংডো জানিয়েছেন, তাদের রাজ্যের ৬৭ শিক্ষার্থী গত শুক্রবার রাতে গুয়াহাটিতে নেমেছেন। দ্বিতীয় দফায় আরও অনেককে ফেরানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।

নাগাল্যান্ড সরকার মণিপুরে বসবাসরত তাদের ৬৭৬ জনকে আসাম রাইফেলসের সাহায্যে উদ্ধারের ব্যবস্থা করেছে।

সিকিমের যারা মণিপুরে পড়াশুনা করতেন, তাদেরও প্রায় সবাই কলকাতা হয়ে নিজেদের রাজ্যে ফিরে গেছেন।

দিল্লি এবং মহারাষ্ট্র সরকারও একই ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। এদিন সকালে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথাও বলেছেন।

মিজোরামে শরণার্থীর ঢলমণিপুরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই সেখানকার কুকি জনগোষ্ঠীর মানুষেরা দলে দলে পার্শ্ববর্তী মিজোরামের দিকে যেতে শুরু করেন।

দুর্গতদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছে স্থানীয় কিছু এনজিও। ছবি সংগৃহীত

মিজো, কুকি ও চিন’রা নিজেদের একই জাতিগোষ্ঠীর অংশ বলে মনে করে এবং ঐতিহাসিকভাবেই তারা একে অন্যের বিপদে প্রাণ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে মণিপুরের কুকিরা এবারও মিজোরামে আশ্রয় পাচ্ছেন।

আরও পড়ুন>> মণিপুরী নারীরা খালি হাতেই যেভাবে ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধ করেন

মিজোরাম সরকার জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার (৪ মে) থেকে রোববার (৭ মে) পর্যন্ত প্রায় ৬০০ মানুষ মণিপুর থেকে তাদের রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছে। বিভিন্ন অস্থায়ী শরণার্থী শিবিরে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

রাজ্যটির রাজধানী আইজল সংলগ্ন জেলায় আশ্রয় নিয়েছেন ১৫১ জন। এছাড়া আসাম সীমান্তের কাছে কোলাসিব জেলায় আরও ২২৮ জন ও মণিপুর লাগোয়া সাইতুয়ার জেলায় আরও ২১৭ জনকে আশ্রয় দিয়েছে মিজোরাম।

অমিত শাহর বক্তব্যমণিপুরে সহিংসতা শুরুর প্রায় ছয়দিন পরে রাজ্যটির পরিস্থিতি নিয়ে মুখ খুলেছেন ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। গত কয়েকদিন তিনি মূলত দক্ষিণের রাজ্য কর্ণাটকে নির্বাচনী প্রচারণাতেই ব্যস্ত ছিলেন।

মণিপুরে এখন চলছে সেনা টহল। ছবি সংগৃহীত

ভারতের একটি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অমিত শাহ দাবি করেছেন, মণিপুরের পরিস্থিতি এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। তিনি রাজ্যের সব অধিবাসীকে শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।

হাইকোর্টের যে আদেশ ঘিরে এই বিরোধের সূত্রপাত, সে বিষয়েও সরকার তড়িঘড়ি করে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না বলে জানিয়েছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

তিনি বলেন, আদালত একটি আদেশ দিয়েছে। এখন এটি নিয়ে সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বিশদ আলোচনা হবে এবং তারপরেই মণিপুর সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। আমি বলবো, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীরই আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই।

সূত্র: বিবিসি বাংলাকেএএ/