রফিকুল ইসলাম জসিম
Advertisement
মণিপুরী সংস্কৃতির সবচেয়ে সমৃদ্ধ অংশ হচ্ছে মণিপুরী নৃত্য। এই নৃত্যকে বহির্বিশ্বে পরিচিত করেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি প্রথম সিলেটে এবং ত্রিপুরাতে এই নৃত্য অনুষ্ঠান দেখে মণিপুরী নৃত্যের প্রতি মুগ্ধ ও আকৃষ্ট হন। এরপর তিনি আগরতলা থেকে মণিপুরী নৃত্য শিক্ষক এনে এবং পরবর্তীকালে মণিপুর থেকে নৃত্য শিক্ষক এনে শান্তিনিকেতনে মণিপুরী নৃত্য শিক্ষার ব্যবস্থা শুরু করেন।
মণিপুরী নৃত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জানতে হলে মণিপুরীদের সংস্কৃতি, ইতিহাস, সাহিত্য ও পুরাণ সম্পর্কে কিছু জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। দেশ-বিদেশে সমাদৃত মণিপুরী নৃত্য, যা মণিপুরী সংস্কৃতির অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছে। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
মণিপুরী নৃত্যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাবমণিপুরী নৃত্য আজ এই উপমহাদেশের পাঁচটি শাস্ত্রীয় নৃত্যের অন্তর্গত। কত্থক, কথাকলি, ভরতনাট্যমের সঙ্গে এর স্থান। মণিপুরী নৃত্য যে আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে তার একক অবদান কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। সে জন্যই বলা হয় মণিপুরী নৃত্যকলাকে ধর্মীয় আচারের গণ্ডি থেকে বের করে এনে বিশ্বমণ্ডলে স্থান করে দিয়েছিলেন তিনি। মণিপুরী নৃত্য শুধু সংস্কৃতির বাহন নয়, এটা আয়-রোজগারেরও একটা মাধ্যম। অনেকেই এ শিল্পকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন এ শিল্প চর্চা করে। তারা নিজেরাও দেশ-বিদেশে মণিপুরী নৃত্যচর্চাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করছেন। মণিপুরী নৃত্যকে কেন্দ্র করেই সব মণিপুরী শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ হচ্ছে।
Advertisement
আরও পড়ুন: বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের বৈচিত্র্যময় বিবাহ প্রথা
মণিপুরী নৃত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটে ১৯১৯ সালে সিলেটে আগমনের ফলে। এল বীরমঙ্গল সিংহের এক লেখা থেকে জানা যায়, ‘মণিপুরী নৃত্যকলা সংস্কৃতিতে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ ১৯১৯ সালের শেষের দিকে মণিপুর ভ্রমণের জন্য উদ্যোগী হন। কিন্তু সেদিনের দেশিয় রাজ্য মণিপুরে প্রবেশের ক্ষেত্রে বিশেষ অনুমতি নিতে হতো। দরবারের প্রেসিডেন্ট তথা ব্রিটিশের পলিটিক্যাল এজেন্ট রবীন্দ্রনাথকে কবি হিসেবে না দেখে রাজনীতির দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। ১৯১৯ সালে মণিপুর যাওয়ার উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ শিলং হয়ে গুয়াহাটী পর্যন্ত যান। কিন্তু মণিপুরে প্রবেশের অনুমতি না পেয়ে তিনি গুয়াহাটী থেকে সিলেট এলেন।
মণিপুরী কাপড় দেখে মুগ্ধ হন রবীন্দ্রনাথ১৯১৯ সালের ৫ নভেম্বর, দিনটি ছিল বুধবার। খুব ভোরে সিলেটে পৌঁছান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সঙ্গে ছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। সুরমা নদীর ঘাট থেকে কবিকে শঙ্খধ্বনি বাজিয়ে শোভাযাত্রাসহ সিলেট শহরে আনা হয়। তিনি উঠেছিলেন শহরের নয়াসড়ক টিলার ওপরে ফাদার টমাসের বাংলোয়। বাংলোর দরজা-জানালার পর্দাগুলো ছিল মণিপুরী কোমরতাঁতের তৈরি। গবেষক নৃপেন্দ্রলাল দাস তার লেখায় প্রত্যক্ষদর্শী সুধীরেন্দ্রনারায়ণ সিংহের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, ‘বাংলোর বহির্দ্বারে টাঙানো ছিল মণিপুরীদের তৈরি প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরোনো একখানা আচ্ছাদন বস্তু। স্থানান্তর থেকে পর্দা খানা আনীত হয়েছিল। ওই আচ্ছাদন বস্ত্রে মণিপুরীদের শিল্প নৈপুণ্যের পরিচয় পেয়ে কবি মুগ্ধ হলেন।’ তাকে পর্দাটি শান্তিনিকেতনে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
মণিপুরী নৃত্যের সজ্জা, সাবলীল ছন্দ ও সৌন্দর্যে বিমোহিত হন রবীন্দ্রনাথ। এই নৃত্য তাকে এতোটাই মুগ্ধ করে যে, শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েদের মণিপুরী নৃত্য শেখানোর আগ্রহ প্রকাশ তিনি। সিলেটে রবীন্দ্রনাথের সামনে যে মণিপুরী নৃত্য পরিবেশিত হয় তা পরিচালনায় ছিলেন মণিপুরী নৃত্যশিল্পী ইমাগো দেবী। ইমাগো দেবীকে কবিগুরু শান্তিনিকেতনে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু মণিপুরীদের কঠোর সামাজিক বিধিনিষেধের কারণে ইমাগো রাজি হননি। তবে এতেও ক্ষান্ত হননি রবীন্দ্রনাথ।
Advertisement
শান্তিনিকেতনে মণিপুরী নৃত্যশান্তিনিকেতনে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা থেকে নৃত্যশিক্ষাগুরু আনিয়ে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে নৃত্যশিক্ষা ও চর্চার উন্মুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলেন। দেবদাসী নৃত্য শেখানোর জন্য কোচিন থেকে নৃত্যশিল্পী আনিয়েছিলেন। কথাকলির জন্য নৃত্যগুরু আনিয়েছিলেন কেরালা থেকে। শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের মণিপুরী নাচ শেখানোর উদ্দেশ্যে কবিগুরুর আমন্ত্রণে প্রথমে মণিপুর থেকে তিনজন নৃত্যশিক্ষক শান্তিনিকেতনে আসেন , কিন্ত বাংলা জানা না থাকার কারণে তার ফিরে যান। এরপর ১৯২৬ সালে আগরতলা থেকে গুরু বুদ্ধিমন্ত সিংহ এবং ত্রিপুরা থেকে গুরু নবকুমার সিংহ শান্তিনিকেতনে যোগ দেন। প্রথমবারের মতো মনিপুরী নৃত্য ব্যবহার করে শান্তিনিকেতনে মঞ্চস্থ হয় ‘নটীর পুজা’ ও ‘ঋতুরঙ্গ’।
আরও পড়ুন: উট কেন বিষধর সাপ খায়?
শান্তিনিকেতনে মণিপুরী রাসরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেটে ভ্রমণের পর কবিগুরুর আমন্ত্রণে যোগ দেন সিলেটের কমলগঞ্জের বালিগাঁও গ্রামের বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী নৃত্যগুরু নীলেশ্বর মুখার্জ্জী। নীলেশ্বরকে রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করে ফেলেন। তার শান্ত স্বভাব ও গুণী শিল্পীর গুণ দেখে মুগ্ধ হন। নীলেশ্বরের অনুরোধে কবি ‘কোন দেবতা সে কী পরিহাসে’ গানটি চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যে সংযোজন করেন। ‘রোদনভরা এ বসন্ত’ ও ‘কুঞ্জ দ্বারে নব মল্লিকা’ এই দুটি রবীন্দ্রসংগীত মণিপুরী নৃত্যের তালে তালে সার্থকভাবে মঞ্চে নিয়ে আসেন নীলেশ্বর। ১৯৩৬ সালে পাটনা, এলাহাবাদ, দিল্লি, লাহোর ও মিরাটে ‘চিত্রাঙ্গদা’ মঞ্চস্থ হয়। সেই সব মঞ্চায়নে নীলেশ্বর অবিচ্ছেদ্য অংশ। নীলেশ্বরের নৃত্য দক্ষতায় ১৯৩৮ সালে শিলংয়ে এবং ১৯৪০ সালে আসানসোল, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুরে ‘চিত্রাঙ্গদা’ মঞ্চস্থ হয়। পরবর্তীকালে পুনর্মঞ্চায়িত ‘শাপমোচন’, ‘রথের রশি’ ইত্যাদি নাটকেও তিনি ছিলেন।
সিলেটে মণিপুরীপাড়ায় রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তিসিলেট নগরের মাছিমপুর এলাকার মণিপুরীপাড়ায় যে মণ্ডপে রবীন্দ্রনাথ এসে মণিপুরী নৃত্য দেখেছিলেন তার পাশেই উঁচু বেদীর ওপর কবিগুরুর আবক্ষ ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। ভাস্কর্যের কয়েক ফুট সামনেই মণ্ডপটি। পুরোনো মণ্ডপের টিনের চালে লাগানো সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে ‘শ্রী শ্রী গোপীনাথ জিউর আখড়া। স্থাপিত ১৮৮০ সন।’ সাইনবোর্ড জানান দিচ্ছে, মণ্ডপের বয়স ১৪২ বছর। এখানেই ১৯১৯ সালের ৬ নভেম্বর এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ২০১৮ সালে সিলেট সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত মাছিমপুরে নির্মিত হয় রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তি।
লেখক: ফিচার লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী
কেএসকে/এএসএম