মতামত

বুশরার সাফল্যেই আমাদের স্বস্তি

ফেসবুক একটা অদ্ভুত জগত। আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বললেও আসলে ফেসবুক আমাদের আরো বেশি অসামাজিক করে তুলছে। আমরা কাছের প্রিয় মানুষের পাশে বসে মোবাইলের পর্দায় দূরের প্রিয় মানুষের সাথে যোগাযোগ করছি। মা হয়তো পাশের রুমে অসুস্থ, তার খবর না নিয়ে আমরা মা দিবস নিয়ে আবেগঘন স্ট্যাটাস দিচ্ছি। স্বামী-স্ত্রী এক বিছানায় শুয়ে দুজন দুদিকে ফিরে দুই মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত।

Advertisement

আমাদের অ্যাকচুয়াল আবেগ কমে যাচ্ছে, ভার্চুয়াল আবেগে ভেসে যাচ্ছি সবাই। তবে ফেসবুক আমাদের ভেতরের মানুষটাকে বের করে আনছে আমাদের অজান্তেই। আমাদের সবিরোধিতা, অশ্লীলতা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা, হিংস্রতা; এক কথায় ভদ্রতার মুখোশ পরে থাকা আমাদের মুখোশটাকে উড়িয়ে দিচ্ছে ফেসবুক। বাস্তবে যে কথাটা উচ্চারণ করতেই আমাদের বাধে, ফেসবুকে সেই গালিটা দিয়ে দেই অবলীলায়।

গত সপ্তাহে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে একজন চিফ হিট অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এই নিয়োগ নিয়ে ফেসবুকে যে ঝড় বয়ে গেল, তা আবারও উড়িয়ে নিয়ে গেল আমাদের নিয়ে গেল আমাদের মুখোশ। আমরা যে কতটা নারীবিদ্বেষী, কতটা সেক্সিস্ট, পুরুষতন্ত্র যে আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তা আবারও প্রমাণিত হলো। নতুন নিয়োগ পাওয়া চিফ হিট অফিসার একজন নারী এবং মোটামুটি সুশ্রী, এটাই যেন তার অপরাধ।

বুশরা আফরিন নামের এই নারীর পদ আর ছবি মিলিয়ে ফেসবুকে যতরকম অশ্লীল ট্রল হলো, তা দেখে আবারও নেতিবাচক সৃষ্টিশীলতায় আমরা যে কত পারদর্শী তা প্রমাণিত হলো। হিট অফিসারকে হট অফিসার অভিহিত করা, তিনি গরম কমাবেন না বাড়াবেন; তা নিয়ে রগড় তো হলোই; বুশরা আফরিনের মুন্ডুপাত করতেও বাধেনি। পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা এই সংবাদ ছেপেছে ছবিসহ, শিরোনাম দিয়েছে ‘আহা উত্তাপ কত সুন্দর…’। এই রগড় আর অশ্লীলতায় হারিয়ে গেছে আসল প্রসঙ্গ।

Advertisement

গত বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে এক অনুষ্ঠান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আর্শট-রক ফাউন্ডেশনের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ঢাকার তাপমাত্রা কমানোর চেষ্টায় যৌথভাবে কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে স্বাক্ষরিত এই চুক্তির আওতায় আগামী দুই বছরে ঢাকা উত্তরে ২ লাখ গাছ লাগানো হবে। একই অনুষ্ঠানে বুশরা আফরিনকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ‘চিফ হিট অফিসার’ হিসেবে নিয়োগ দেয়ার ঘোষণা আসে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্ব ক্রমশ উষ্ণ হচ্ছে। এবার আমরা সেই উষ্ণতা বাড়ার প্রভাব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এবারের এপ্রিলে ঢাকার তাপমাত্রা বারবার রেকর্ড ভেঙ্গেছে। আর এটাও আমরা জানি, তাপমাত্রা কমাতে গাছ লাগানোর কোনো বিকল্প নেই। রমনা পার্কের সাথে মতিঝিলের তাপমাত্রার পার্থক্য থাকে বেশ কয়েক ডিগ্রি। তাই নগদে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য গাছ লাগানোর চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প নেই। আর একজন কর্মকর্তা আমাদের তাপমাত্রা কমানোর কথা ভাববেন, এটাই আনন্দেরই খবর। কিন্তু আনন্দের খবরকে আমরা অশ্লীলতার পাঁকে ফেলে দিয়েছি।

সমালোচনার তোড়ে ভেসে যেতে যেতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন একদিন পর জানালো বুশরা আফরিন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের চিফ হিট অফিসার বটে, তবে তাকে তারা নিয়োগ দেয়নি। তিনি উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে বেতন-ভাতা, গাড়ি-বাড়ি বা কোনো ধরনের সুযোগ সুবিধা পাবেন না। বুশরা আফরিন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের চিফ হিট অফিসার বটে, তবে তাকে নিয়োগ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাড্রিয়েন আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টার (আর্শট-রক)।

বাংলাদেশে চিফি হিট অফিসার পদটি নতুন হলেও রকফেলার ফাউন্ডেশন ২০২১ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন শহরে চিফ হিট অফিসার নিয়োগ করছে। বুশরা আফরিনের আগে বিশ্বের আরো ৬টি শহরে চিফ হিট অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বুশরা আফরিনসহ ৭ জন চিফ হিট অফিসারই নারী। তাপমাত্রায় যেহেতু নারী ও শিশুদের ভোগান্তি বেশি হয়, তাই এই পদে নারীদেরই নিয়োগ দেয়া হয়।

Advertisement

কানাডায় গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে লেখাপড়া করা বুশরা আফরিনের যোগ্যতা সম্পর্কে আমি জানি না। চিফ হিট অফিসার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি বুশরা আফরিনের নামই শুনিনি। তাই তিনি যোগ্য না অযোগ্য সেটাও আমি জানি না। বাংলাদেশে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা শক্তি ফাউন্ডেশনে একজন নির্বাহী হিসেবে কাজ করারও অভিজ্ঞতা আছে তার।

তিনি জানিয়েছেন চিফ হিট অফিসার হিসেবে শুরুতে তিনি মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করবেন, ‘আমরা হিট মেসেজিং নিয়ে কাজ করব, সচেতন করব। কারণ সচেতনতা প্রতিরোধের প্রথম ধাপ। বয়স্ক, শিশু, গর্ভবতী নারী এবং যারা শারীরিকভাবে অসুস্থ মানুষ, তারা যেন নিরাপদে থাকে। এগুলো আমাদের এখানে মানুষ জানে না।’

ধরে নিচ্ছি রকফেলার ফাউন্ডেশন জেনেবুঝে, খোঁজখবর নিয়েই বুশরা আফরিনকে বাংলাদেশের তো বটেই, এশিয়ার প্রথম হিট অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। এই পদের জন্য পুরোপুরি যোগ্য হলেও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের চিফ হিট অফিসার হিসেবে বুশরা আফরিনের নিয়োগ নিয়ে আমার প্রবল আপত্তি আছে। কারণ তার পিতার নাম আতিকুল ইসলাম, যিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র। বুশরা আফরিন কানাডায় পড়ালেখা করে দেশে ফিরে এসেছেন, দেশের জন্য কাজ করতে চাইছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে দেশের মানুষকে বাঁচাতে চাইছেন; এটা খুবই আনন্দের খবর। তাকে আমি আন্দরিক অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু যত যোগ্যই হোন, পিতা যে সিটি করপোরেশনের মেয়র, সে সিটি করপোরেশনে কোনো কিছুর সাথে নিজেকে না জড়ালেই ভালো করতেন তিনি।

কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের সংঘাত বলে একটা ব্যাপার আছে। আমরা অনেকে সেটা মানি না বা মানতে চাই না। আতিকুল ইসলামের ব্যাপারে যারা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন, মেয়েকে নিজের সিটি করপোরেশনে একটি কাজ পাইয়ে দেয়ার মত দুরবস্থা তাদের নয়। মেয়র হওয়ার আগেই তিনি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। আতিকুল ইসলামের এক ভাই তাফাজ্জাল ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি। আরেক ভাই অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মইনুল ইসলাম সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তাই একমাত্র মেয়েকে কোনো সুবিধা পাইয়ে দিতে আতিকুল ইসলাম তাকে নিজের সিটি করপোরেশনে চিফ হিট অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। অন্তত আমি তেমন মনে করি না। তারপরও স্রেফ মেয়রের কন্যা বলে বুশরা আফরিনকে অনেক অন্যায় সমালোচনা সইতে হয়েছে। রকফেলার ফাউন্ডেশন যদি বুশরা আফরিনকে ঢাকা দক্ষিণ বা দেশের অন্য যে কোনো সিটি করপোরেশনের চিফ অফিসার নিয়োগ করতো; তাহলে বিষয়টা অনেক শোভন হতো।

রকফেলার ফাইন্ডেশন এশিয়ার প্রথম চিফ হিট অফিসার হিসেবে বাংলাদেশের একজন নারী এবং শহর হিসেবে ঢাকা উত্তরকে বেছে নিয়েছে এটা আমাদের জন্য আনন্দের এবং গর্বের। বুশরা আফরিন মেয়রের কন্যা না হলে ভালো হতো। কিন্তু শুধুমাত্র মেয়রের কন্যা, এই অপরাধে নিয়োগ হয়ে যাওয়ার পর সেটা বাতিলের দাবি আমি করছি না। বরং আমি বুশরা আফরিনের সাফল্য কামনা করছি। তিনি যদি তার চেষ্টায় সতি সত্যি ঢাকা উত্তর সিটির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন, তাহলে সেটা হবে আমাদের সবার জন্যই স্বস্তির। আর ঢাকা উত্তরের তাপমাত্রা কমলে সেটার সুফল পাবে ঢাকা দক্ষিণের মানুষও।

তবে কাজটা সহজ নয়। গোটা বিশ্বই যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলার উপায় খুজেঁ পাচ্ছে না, সেখানে বুশরা আফরিনের মত একজন নারী রাতারাতি ঢাকার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ফেলবেন, এমনটা আশা করা অন্যায়। তবু তিনি যদি চেষ্টা করেন, দুই বছরে যদি সত্যি দুই লাখ গাছ লাগানো যায়, যদি গাছ কাটা বন্ধ হয়, যদি জলাশয় ভরাট বন্ধ হয়; তাপমাত্রা না কমুক, অন্তত যদি নিয়ন্ত্রণে থাকে তাও অনেক বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হবে।

তবে বুশরা আফরিনকে মেয়রের কন্যা বলে, নারী বলে তাকে সবসময় সমালোচকদের কঠোর নজরদারিতে থাকতে হবে। ব্যর্থ হলেই সমালোচনার অশ্লীল আক্রমণ তাকে ঘিরে ধরবে। তবে সাহসীরাই স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে পারে। বুশরা আফরিনের সাফল্য কামনা করছি। কারণ তাতে আমাদেরই স্বস্তি মিলবে।

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/জেআইএম