মতামত

পাকিস্তান প্রত্যয় এখনও সজীব

একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি অনেকদিন, কিন্তু এখনও তেমন সদুত্তর পাইনি। সেটি পাকিস্তান সম্পর্কিত। আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে পাকিস্তান একটি দেশ শুধু নয় একটি প্রত্যয়। এ প্রত্যয়ের অন্তর্গত, সামরিকায়ন ও আমলাতন্ত্রের শাসন, ‘গণতন্ত্র’ পরিচালিত হবে তাদের নির্দেশে, ব্যাপক দুর্নীতি ও সম্পদ ভোগ করবে সামরিক আমলারা, ধর্মকে শুধু রাজনীতি নয়, মানুষ দমনে ব্যবহৃত হবে, জঙ্গিবাদ প্রাধান্য পাবে। এখানে যারা বসবাস করে তাদের মানসজগৎ এসব উপাদান দ্বারা প্রভাবিত। এরা নির্দয় ও হিংস্র, হাসতে হাসতে মানুষ খুন করে ও ধর্ষণ করে যেমন করেছিল ১৯৭১ সালে এবং সে সব খুনের বিচার হয় না। একজন মুসলমান সমান দুজন হিন্দু। বাঙালিরাও হিন্দু। এই হলো তাদের মানসজগৎ। পাকিস্তান প্রত্যয় যদি প্রাধান্য বিস্তার করে তাহলে সে দেশ ব্যর্থ হতে বাধ্য।

Advertisement

১৯৪৭ সালের আগে থেকে মুসলিম লীগ এই প্রত্যয় নির্মাণে সচেষ্ট থেকেছে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৪ মুসলিম লীগই দেশ শাসন করেছে এবং এ প্রত্যয়টি বাঙালির মানসিকতায় প্রোথিত করেছে। মুসলিম লীগের অবসান হয়েছে, তারা ফিরে আসেনি কিন্তু এ প্রত্যয়টির প্রভাব বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে যথাযথভাবে আছে। বঙ্গবন্ধু এ প্রত্যয় থেকে বেরুবার চেষ্টা করেছেন, জয়লাভও করেছেন। কিন্তু তাঁকে হত্যার পর যখন বামপন্থি, আওয়ামী লীগার, মুক্তিযোদ্ধারা জিয়ার দলে ভিড়লেন তখন বোঝা গেলো, ১৯৭১ সালও বাঙালিকে এ প্রত্যয় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে পারেনি।

গত কয়েক দশকে প্রমাণিত হয়েছে এরা অনেক শক্তিশালী। এবং গণতন্ত্রের নামে এরা প্রতিনিধিত্ব করছে বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় পার্টিতে। এরা বঙ্গবন্ধুর শহীদ দিবসে কেক কাটে, মশকরা করে, খুনিদের সঙ্গে বসবাস করে, গণহত্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, ঘাতক দালালদের বিচারে অনীহা প্রকাশ শুধু নয় সমালোচনা করে, পাকিস্তানের সব কিছু তাদের কাছে উত্তম, ধর্মনিরপেক্ষতা তাদের কাছে বিষবৎ, সব সময় তারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন তোলে, খুনিদের ক্ষমতায় বসায় এজন্য বাংলাদেশে তারা পরিচিত স্বাধীনতা বিপক্ষ শক্তি হিসেবে।

এরাই নিয়ত বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগকে সব সময় দোষারোপ করে। খালেদা জিয়া বিএনপি বা জিয়াউর রহমান ও এরশাদকে নয়, এরা ধর্মাশ্রয়ী দলকে সমর্থন করে এই বলে যে তারা আদর্শবাদী দল, মুক্তিবাহিনীর বিচার চায় তারা পাকিস্তানি বা পাকিস্তানপন্থিদের ১৯৭১ সালে হত্যা করেছে বলে। শিক্ষায়তনগুলোতে এরা শিক্ষক হিসেবে পাকিস্তানতত্ত্ব সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে সমর্থন জোগায়। এখন দেখছি স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধ যারা সমর্থন করে তাদের অনেকেও এই পাকিস্তান প্রত্যয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। আজ ৭৫ বছর কেন এই তত্ত্ব বাঙালিদের প্রভাবিত করছে তার উত্তর খুঁজছি।

Advertisement

সম্প্রতি অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমদের বই নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। তাঁরাই অনেক প্রশ্ন তুলেছেন যারা পাকিস্তান তত্ত্বে বিশ্বাস করেন না। প্রগতির তারা ধারক। ড. ইমতিয়াজের বইতে তারা পাকিস্তান প্রত্যয়ের এসব উপাদান খুঁজে পেয়েছেন এবং তা অসত্য নয়।

ড. ইমতিয়াজকে নিয়ে এতো বিতর্ক হতো না যদি না তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণহত্যা কেন্দ্র ও আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের প্রধান হতেন। অধ্যাপক এমাজউদ্দিনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন এবং এরকম আরও অনেকে। তারা প্রকাশ্যে বিএনপির সমর্থক ছিলেন এবং সবাই জানতেন তারা এরকমই বলবেন। ড. ইমতিয়াজের ব্যাপারে এটি কারও মনে হয়নি। কারণ, তাঁর পিতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ, তার বড় দুই ভাই কট্টর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। সুতরাং, এটি কেউ আশা করে না। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক বিদ্যা সংস্থা ও গণহত্যা কেন্দ্রের পরিচালক। বাংলাদেশ এখন গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাচ্ছে। সুতরাং এ সব পদে থাকা কোনো ব্যক্তি যদি বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ বা গণহত্যা নিয়ে অনভিপ্রেত মন্তব্য করেন তাহলে তা স্বীকৃতির প্রশ্নে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে; সমস্যা সেখানেই। না হলে এ নিয়ে সমস্যা হতো না। আরেকজন পাকিস্তানমনষ্কা অধ্যাপকের লেখা বলে বিতর্কে যেত না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একথা মনে রেখেই তাঁকে একাডেমিক কাজ থেকে বিরত রেখেছে। তবে, অধ্যাপক ইমতিয়াজ অবসরে যাওয়ায় অনেক ঝামেলা থেকে বেঁচে গেছেন।

২ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমদের বই ‘হিস্টোরিসাইজিং ১৯৭১ জেনোসাইড: স্টেট ভার্সাস পার্সন’ নিয়ে গত দুই মাস গণমাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে। মাত্র ৪৪ পৃষ্ঠার বই [ছবি, নামপত্র ইত্যাদি বাদ দিলে ৩২ পাতার বই], শক্ত মলাটের কারণে মোটাসোটা লাগে। বইটি ইউপিএল প্রকাশ করেছিল। ইউপিএলের তখন স্বত্বাধিকারী ছিলেন মহিউদ্দিন আহমদ, কট্টর মুক্তিযুদ্ধপন্থি। বইটি রিভিউয়ারের কাছ থেকে অনুমোদন পেয়ে প্রকাশনায় আসে। প্রয়াত মহিউদ্দিন ভাই বইটি পড়েছিলেন কি না সন্দেহ। ইউপিএল যাদের রিভিউ করতে দিয়েছিল তাদের আর রিভিউ বোর্ডে না রাখা উচিত। কেননা, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করলে তারা এ ধরনের বই অনুমোদন করতেন না।

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী বইটি পড়ে এতে উল্লেখিত নানা বিভ্রান্তির উল্লেখ করেন। ধারণা করেছিলাম, অধ্যাপক ইমতিয়াজের অবসরের পর এ নিয়ে আর কথাবার্তা হবে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিতর্ক বাড়ছে, অধ্যাপক ইমতিয়াজ বক্তব্য রাখছেন। সম্প্রতি ডয়েচে ভেলে বিষয়টি আবার উসকে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানেও এখন একই বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। ইমতিয়াজের বই নিয়ে নয়। তাঁর বইয়ে উল্লিখিত সিদ্ধান্তগুলোই তারা প্রচার করছে কয়েক বছর ধরে। অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম একাডেমিক ফ্রিডম [মুক্তবুদ্ধির চর্চা] নিয়ে কথা তুলেছেন, ফেসবুকেও এ নিয়ে তরুণ বুদ্ধিজীবীরা কিঞ্চিত বক্তব্য রাখছেন। পাকিস্তানে এখন এ ধরনের বই শুধু নয়, চলচ্চিত্র, ওয়েবসিরিজ প্রচারিত হচ্ছে। এই জাগো নিউজেই পুনম মুখার্জী এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। যেহেতু শুধু আমরা নই, সরকার এবং স্বয়ং অধ্যাপক ইমতিয়াজও বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দাবি করছেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাঁকে এ বিষয়ে বক্তৃতা দিতে নিয়ে গিয়েছিল লন্ডনেও, সুতরাং সবকিছু মিলিয়ে এ ধরনের বিতর্কের অবসান হওয়া উচিত।

Advertisement

প্রথমে নিজের ও আমার এই সহকর্মীদের প্রসঙ্গে বলি। অধ্যাপক সৈয়দ মনজুর ও আমি একই দিনে আজ থেকে ৪৯ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিই ও ২০১৬ সালে একই দিনে অবসর গ্রহণ করি।

আমাদের কালে মনজুর মেধাবী ছাত্র ও পরবর্তীকালে জনপ্রিয় এবং মেধাবী শিক্ষক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। প্রচুর লেখালেখি করতে পারতেন কিন্তু করেননি। এখনও তিনি আগের মতো জনপ্রিয় শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে প্রফেসর এমেরিটাস বা অন্য কোনো সম্মানে ভূষিত করেনি সেটি তাদের হীনম্মন্যতা। কারণ কর্তৃপক্ষ যারা ছিলেন বা আছেন তারা এভাবে পরিচিত নন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তিনি সব সময় থেকেছেন, আছেনও। তাই যখন তিনি এ প্রসঙ্গে মুক্তচিন্তার কথা বলেন তখন প্রশ্ন ওঠে এ ফ্রিডম কি বাংলাদেশ ইতিহাসবিরোধী হলেও মেনে নিতে হবে?

আরও পড়ুন>> পাকিস্তানি মানসিকতা বদলাবে না

অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমদও মেধাবী ও জনপ্রিয় শিক্ষক। বিদেশেও তিনি পরিচিত, আমাদের একদশক জুনিয়র হলেও তাঁকে আমরা শুধু স্নেহ নয়, তার বিদ্যাবত্তার জন্য প্রশংসাও করি। অধ্যাপক ইমতিয়াজের পরিবারের সঙ্গে আমি ঘনিষ্ঠ। তাঁর পিতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু,তার বড় ভাই কট্টর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলের সমর্থক এবং অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত।

মনজুর বা ইমতিয়াজের তুলনায় আমি নেহাতেই ম্লান। বিদ্যা-বুদ্ধিতে। গড়পড়তা অধ্যাপক যেমন হয়, তেমনি। তা সত্ত্বেও আমি এ বিষয়ে দু-একটি মন্তব্য করছি। এ কারণে যে গত অর্ধশতক অধ্যাপক ইমতিয়াজ উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ আছে।

প্রথমত বলি, অধ্যাপক ইমতিয়াজের বইটি আমি কিনেছিলাম অনেক আগেই। কয়েকপাতা পড়ে আর এগোইনি। কারণ, যে বিষয় নিয়ে তিনি চর্চা করেছিলেন তা নিয়ে তাঁর আগে প্রচুর প্রবন্ধ ও বই বাংলাভাষায় লেখা হয়েছে যার কোনো উল্লেখ সেখানে নেই। অবশ্য সে সব বইয়ে অনর্থক রবীন্দ্রনাথ, রণজিৎ গুহ, হেগেল, মিল, ফুকো, ডেসমন্ড টুটুর উল্লেখ নেই। এখানে আছে, ভুল ক্যাপশনে তাদের ও অন্য ছবিও আছে। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি বড় অংশ ঔপনিবেশকোত্তর ঔপনিবেশিক মানসিকতায় প্রভাবিত। শুনেছিলাম, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষ নিয়ম করেছেন, শিক্ষকদের ইংরেজিতে লেকচার দিতে হবে।

সম্প্রতি আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়েও নাকি এরকম নির্দেশ জারি করা হয়েছে। নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, সিলেটি উচ্চারণে যারা লেকচার দেন তা ক্লাসে শুনলে আপনারা কী মন্তব্য করবেন জানি না। ছাত্ররা ইংরেজি কতটুকু জ্ঞান অর্জন করে আসছেন তা আমরা জানি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও একদিন শিক্ষকদের আসতে হয় না। অনলাইনে ক্লাস নেন। সেটি কতখানি সমুচিত স্বাভাবিক সময়ে উচ্চতর কর্তৃপক্ষই বলতে পারবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও তথৈবচ।

আমার শিক্ষকরা বাংলায় আমার জ্ঞানচর্চাকে শুধু তাচ্ছিল্য নয়, পদ ও অন্য ক্ষেত্রে অধস্তন করে রেখেছিলেন এ কারণে। বঙ্গবন্ধু সারা জীবন বাংলা বাংলা বলে জান দিলেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করলেন। আর বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু করে যারা ভিসি হলেন তারা চাপিয়ে দিচ্ছেন ইংরেজি জোর জবরদস্তি। ইংরেজি ভাষার বিপক্ষে তো নই। কিন্তু কেউ বাংলা ব্যবহার করলে এবং তাকে বাধা দিলে তা সংবিধানবিরোধী কি না সেটি ভেবে দেখার বিষয়। এ অধস্তন, হীনম্মন্যতার প্রবণতা দেখবেন মানবিক ও সমাজবিজ্ঞানের শাখায় যেসব অধ্যাপক কাজ করেন তাদের মধ্যে। বাংলাদেশ বিষয়ে তাদের লেখালেখিতে বিদেশিদের তত্ত্ব, উদ্ধৃতি। বাংলাদেশে এসব বিষয়ে যা লেখা হয়েছে তার কোনো উল্লেখ নেই। বাংলাভাষা না জেনে সে দেশের ওদের গবেষণা কতটা উন্নত তা বলব না। কিন্তু তাচ্ছিল্যটি লক্ষণীয়। আমাদের মধ্যে এ ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম বদরুদ্দীন উমর।

অনেকে মনে করতে পারেন বিচারপতি মানিকই বোধহয় ইমতিয়াজের এ বই নিয়ে সমালোচনা করলেন। আসলে তা’নয়। ২০১৮ সালে ড. কৌস্তভ অধিকারী ও মোহাম্মদ এম রহমান জালাল এ বিষয় নিয়ে বিস্তারিত লেখেন। যারা একাডেমিশিয়ান (বিদ্বৎজন?) তারা বিচারপতি মানিকের লেখা গ্রহণ করতে না পারেন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত নন বলে, কিন্তু এ দু’জন যদ্দুর জানি একাডেমিশিয়ান। তারা যে লেখাটি লিখেছেন এটি আগে পড়া উচিত। তবে সেটি ইংরেজিতে লেখা দেখে আলোচনায় আসেনি। আমি সে লেখা পড়েছি কিন্তু ইমতিয়াজের বই নিয়ে আগ্রহ দেখাইনি। তাহলে বুঝতে পারতাম ইমতিয়াজ আসলে কী করতে গিয়ে কী করেছেন।

৩ইমতিয়াজের লেখায় সবাই যে বিষয়টিতে আগ্রহী তাহলো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। ইমতিয়াজ বলেছেন সেখানে বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা ও জিয়া পাকিস্তান বলেছেন। এর কারণ বর্তমান রাজনীতি। এখানে এখন মনে করা হয় বঙ্গবন্ধু বা জাতির পিতা না বললে বঙ্গবন্ধুর অবমাননা করা হয়। মহাত্মা গান্ধীকে গান্ধীজী, মি. গান্ধী, গান্ধী বলে গবেষণার বইগুলোতে উল্লেখ আছে। তাতে গান্ধী খাটো হয়ে যাননি বা তাঁকে অবমাননা করা হয়েছে বলে মনে করা হয় না। মহামান্য রাষ্ট্রপতি বা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী না বললে মনে করা হয় মহা অন্যায় করে ফেললাম। কিন্তু, মি. প্রেসিডেন্ট বা মি. প্রাইম মিনিস্টার বা এক্সেলেন্সি বললে বিদেশে কেউ মনে করা না মহা অপরাধ হলো। লেখালেখি তো বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা, মুজিব, শেখ মুজিবুর রহমান সবই ব্যবহার করা যেতে পারে। তাতে বঙ্গবন্ধুর অবমাননা হয় না। সুতরাং ইমতিয়াজ বঙ্গবন্ধু লেখেননি তা দেখে একটু অস্বস্তি লাগতে পারে কিন্তু তা মহাঅপরাধ নয়। যেটি বিতর্কের বিষয় তা হলো সেই ‘জয় বাংলা’ ও ‘জিয়ে পাকিস্তান’।

ড. ইমতিয়াজ লিখেছেন, তিনি ঐ সভায় ছিলেন, (অর্থাৎ তিনি শুনেছেন)। তাঁর বয়স তখন ১১/১২। ঐ সময় এটি শুনে মনে রাখা দুরূহ। হাইকোর্টের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণ যথাযথ কি না তা নিয়ে একটি কমিটি করা হয়েছিল। আমি ওই কমিটির সদস্য ছিলাম, সাব-কমিটির সমন্বয়ক হিসেবে প্রেস ইনস্টিটিউটের জাফর ওয়াজেদ বেতারের, টেপ, রেকর্ড, টিভির টেপ সব দেখে শুনে একটি শুদ্ধ পাঠ তৈরি করেছিলেন। তাতে দেখা যায় কিছু কিছু অংশ বাদ গেছে (গুরুত্বপূর্ণ নয়)। কিন্তু, জয় পাকিস্তান কোথাও পাওয়া যায়নি। যারা একথা বলেছেন তারা একটি বিষয় গুলিয়ে ফেলেছেন।

এটি অস্বাভাবিক নয়, বঙ্গবন্ধু ৩ জানুয়ারি রমনা রেসকোর্সে বিশাল জনসভা করেছিলেন যেখানে সংসদ সদস্যরা ৬ দফা কার্যকর করবেন বলে শপথ নিয়েছিলেন। সেখানে বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা ও জয় পাকিস্তান বলেছেন। ৩ তারিখের জনসভা ছিল ঐ সময়ে সবচেয়ে বড় জনসভা, মার্কিন কনসাল আর্থার ব্লাড তার বিস্তারিত বিবরণ রেখে গেছেন। ৭ মার্চে ‘জয় পাকিস্তান’ বঙ্গবন্ধু বাদ দেন কারণ এর প্রকৃতি ছিল অন্য রকম।

প্রয়াত ব্যারিস্টার না হুদা ওরফে নাজমুল হুদা প্রথম এ কথা উল্লেখ করেন এটি বোঝাতে যে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান ভাঙতে দিতে চাননি। অর্থাৎ তাকে যে জাতির পিতা বলা হয় এটি ঠিক নয়। তিনি পাকিস্তান ছাড়তে চাননি। তো ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ অব্দি আমরা কেউ তো তা অস্বীকার করিনি, আমরা বাঙালি ছিলাম, পাকিস্তানিও ছিলাম।

ব্যারিস্টার হুদা এই মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করে দীর্ঘ লেখা লিখেছিলাম যেটির উল্লেখ করতে চাই না। আচ্ছা, ধরে নিলাম বঙ্গবন্ধু ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছিলেন [আমরা যারা যুবক তারা কেউ তা শুনিনি, সৈয়দ মনজুরও বলেছেন শোনেননি] তাতে কী হলো? তাতে কি প্রমাণিত হলো বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান চেয়েছেন বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেননি? ২৫ বছর কী সংগ্রাম করেছিলেন বা ৬ দফাও কী ছিল? এগুলো অহেতুক তর্ক। কুতর্ক। এগুলোতে কিছুই প্রমাণ হয় না।

ড. ইমতিয়াজ বারবার বলেছেন বিচারপতি হাবিবুর রহমান ও শামসুর রাহমান একথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর লেখার পর এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকারও একথা বলেছিলেন। কিন্তু যে কথাটি ড. ইমতিয়াজ বলতে চেয়েছেন তিনি (শুনছেন): বিচারপতি হাবিব ও কবি রাহমান যা লিখেছেন তাতো ভুল নয়। আসলে ভুল। বিচারপতি হাবিবুর রহমান তাঁর লেখা বাংলাদেশের তারিখ গ্রন্থে এটি উল্লেখ করেছিলেন। অধ্যাপক ইমতিয়াজ উল্লিখিত বাংলাদেশের সন ও তারিখ বলে কোনো বই বিচারপতি লেখেননি। ১৯৯৮ সালে মাওলা ব্রাদার্স তা প্রকাশ করে। দ্বিতীয় মুদ্রণের সময় প্রকাশক ‘জিয়ে পাকিস্তান’ প্রত্যাহার না করলে বইটি মুদ্রণে অস্বীকার করেন। ২০০১ সালে দ্বিতীয় মুদ্রণের সময় বিচারপতি ‘জিয়ে পাকিস্তান’ বাদ দেন ও ভূমিকায় উল্লেখ করেন কিছু ভুল বাদ দেয়া হয়েছে।

শামসুর রাহমান তাঁর আত্মজীবনী কালের ধুলায় জিয়ে পাকিস্তানের উল্লেখ করলে একই ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়। এবং তিনি পত্রিকায় লিখে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এসব ঘটনা ঘটেছে ড. ইমতিয়াজের বই বেরুবার আগে। পরবর্তীকালে এ কে খন্দকারও প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন। সুতরাং গ্রন্থে, বিচারপতি হাবিবুর রহমান বা শামসুর রাহমানের সাক্ষ্য দেওয়া উচিত হয়নি। গবেষকদের এ বিষয়টি মনে রাখা উচিত। এটি একাডেমিক বিতর্ক বা একাডেমিক ফ্রিডম হতে পারে না। যে তথ্য সত্য নয়, ফ্যাক্ট নয় তা নিয়ে বিতর্ক অনভিপ্রেত।

বিচারপতি চৌধুরী যে বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন তাহলো, এ বক্তৃতা এখন পাঠ্য (অনেক ক্ষেত্রে) ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক তালিকার অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং, এ বিষয়ে তথ্য বিকৃতি হলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নানা প্রশ্ন উঠতে পারে। পাকিস্তানেও এটি উল্লেখ করে কিছু আলোচনা হচ্ছে বলে শুনেছি। সে ক্ষেত্রে অধ্যাপক ইমতিয়াজের অনুচিত হবে না বিষয়টি ভুল হয়েছে বলে প্রকাশ্যে স্বীকার করে নেওয়া। এতে একাডেমিশিয়ান হিসাবে তাঁর গুরুত্ব হ্রাস পাবে না। বিচারপতি রহমান, কবি শামসুর রাহমান বা এয়ার মার্শাল খন্দকারের তুলনায় ড. ইমতিয়াজ কিছুই না। তাঁরা ভুল স্বীকার করতে পারলে ড. ইমতিয়াজের ভুল স্বীকারে অসুবিধা কী? একাডেমিশিয়ান বা শিক্ষরাই তো শেখাবেন ভুল হলে ভুল স্বীকার করা জরুরি। তিনি যদি এটি না করেন তাহলে তা ‘অপরাধ’ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং বিষয়টি আদালতে গড়াতে পারে, যেখানে প্রকাশককেও অভিযুক্ত করা হতে পারে।

ড. ইমতিয়াজ একটি কথার ওপর বারবার জোর দিচ্ছেন। ৭ মার্চ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর একটি অনুষ্ঠান করতো সেখানে প্রধানমন্ত্রী থাকতেন। একজন মূল প্রবন্ধ পাঠ করতেন। সেখানে ড. ইমতিয়াজও প্রবন্ধ পড়েছেন। অর্থাৎ তিনি ইঙ্গিত করছেন, প্রধানমন্ত্রী কিছু বলেননি, বিচারপতি চৌধুরী কেডা? ড. ইমতিয়াজ বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং নিশ্চয় বলেছেন এটি ‘মাস্টারফুল স্ট্রোক’। কিন্তু তিনি কি বলেছেন প্রধানমন্ত্রীর সামনে যে বঙ্গবন্ধু ‘জিয়ে পাকিস্তান’ বলেছেন? বললে প্রধানমন্ত্রী তা অনুমোদন করতেন এটি বিশ্বাসযোগ্য? তিনি কেনো যারা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অতো উৎসাহী নন বা লেখেন নি তারা ও অনেকে প্রতিবছর এ সভায় বক্তৃতা দিয়েছেন, তাতে কী হলো? এরকম এক অধ্যাপক বাংলাদেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের এক অনুষ্ঠান বঙ্গবন্ধু বলেন নি বা বঙ্গবন্ধুর বিষয়টিতে তাচ্ছিল্য প্রকাশ করায় এমন হল্লা চিল্লা হয় যে তাকে মঞ্চ ছেড়ে আসতে হয়। তিনিও বক্তৃতা দিয়েছেন এ সভায় এবং মঞ্চে তখন বঙ্গবন্ধু ছাড়া কিছু বলেন নি।

বিচারপতি চৌধুরী বলছেন ড. ইমতিয়াজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স ও সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক। তিনটিই গুরুত্বপূর্ণ পদ। সে জন্যও বিষয়টি বিবেচনায় আসে।

আমি ড. ইমতিয়াজের অগ্রজ সহকর্মী ও সুহৃদ হিসেবে বলব, বিষয়টি বিবেচনায় আনতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে একাডেমিক কাজে বিরত রাখছেন, তাহলে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও তখন বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে। এটি আমাদের কারো জন্য সুখকর নয়।

৪বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য বিষয় যা অধিকারী ও জালাল এবং শামসুদ্দিন চৌধুরী উল্লেখ করেছেন [তাদের নামের আগে ব্যবহৃত অধ্যাপক/ বিচারপতি বারবার উল্লেখ না করলে আশাকরি অপরাধ হবে না]। অন্য যারা এ বিষয়ে মতামত প্রকাশ করেছেন তারা বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেছেন অন্যান্য বিষয়ে নয়। অন্যান্য বিষয়গুলি আরো গুরুত্বপূর্ণ।

আমার মনে হয়, এ সমস্যাগুলোর উদ্ভব হয়েছে তার অকারণ তত্ত্ব তৈরির কারণে। রবীন্দ্রনাথ থেকে মিলের বক্তব্যগুলো দিয়ে তত্ত্ব নির্মাণ চেষ্টাটা একলেকটিক। তারা একই পথে সবাই হাঁটেননি। তাদের লেখার কোনো একটি উদ্ধৃতি শুধু দিয়ে তত্ত্ব নির্মাণ জটিল হয়ে ওঠে, যা হয়েছে তার ক্ষেত্রে। আমাদের বিদ্বৎজনরা এসব করছেন পাঠকদের ইমপ্রেস করার জন্য। তারা অনেক জানেন, অনেক পড়েছেন এ কথা বোঝার জন্য। শামসুদ্দিন লিখেছেন, ডা. স্বপ্নীল লিখেছেন, ইমতিয়াজ তাঁকে বলেছিলেন, তাঁর বইটির মতো কোনো বই আজ পর্যন্ত লেখা হয়নি এবং একজন মন্ত্রী তার বইটি বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছেন। এটি ঠিক নয় যে তার থেকে উৎকৃষ্ট বই কেউ লেখেননি।

আসলে যে জগাখিচুড়ি তত্ত্ব তৈরি করে তিনি বইটি লিখেছেন তা কেউ লিখবে না। ইমতিয়াজের ধারণা হয়েছিল, খুবই উৎকৃষ্ট মানের বই। তাঁর তত্ত্ব রাষ্ট্র ও ব্যক্তির দ্বন্দ্ব নিরসন? এটি প্রমাণের জন্য ফুকো, হেগেল, হেজিমনি, ডিসকোর্স, কাউন্টার ডিসকোর্স, সাবঅলটার্ন অনেক শব্দের ব্যবহার। শুধু ইংরেজি-ফরাসি (ইংরেজি অনুবাদ) বই থেকে এসব যারা উদ্ধৃত করেন, তারা বোঝাতে এ শব্দগুলোর মাহাত্ম্য। যদিও এসব শব্দের প্রতিটি আলাদা অর্থ বহন করে। ১৯৭১-এর গণহত্যা বোঝার জন্য এসব তত্ত্ব অনাবশ্যক। ‘স্ট্যাটিস্ট ডিসকোর্স’ ও পার্সনোগ্রাফির মধ্যে তিনি একটি সমন্বয় করতে চান। এ ধরনের লেখা যারা লিখেছেন তারা বারবার একটি কথা বলতে চান যে তৃণমূলের কথা অগ্রাহ্য করা হয়েছে, সেটি যেন না হয়। ইমতিয়াজ যদি বাংলায় লেখা গণহত্যার বিষয়গুলি পড়তেন তা’হলে দেখতেন সব আখ্যান তৃণমূল নিয়েই, কারণ সেটি ছাড়া গণগত্যার বিবরণ হয় না।

সমস্যাটা হচ্ছে ৩০ লাখ শহীদ নিয়ে। ইমতিয়াজ একটা কথা ভালো লিখেছেন, সংখ্যা নিয়ে এমনভাবে বলা হচ্ছে একেকজনের একেক রকম ভাষ্য “ ইট ডিড হ্যাভ এ ফ্লেভার অব ট্রাইভিলাইজিং দি ইস্যু অব জেনোসাইড।” কিন্তু পরক্ষণেই বলেছেন, যারা এটা মানেন না তারা আবার ইস্যুটি সরগরম করে তুলেছেন আবেগী হয়ে চিন্তা করে নয়। তা’হলে সে প্রতিক্রিয়া হয়ে যাচ্ছে ‘স্ট্যাটিস ডিসকোর্স’ যা এখন আরো রাজনীতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ব্যাপার চলছে।

এখানে আপত্তি দু’টি। ইমতিয়াজ বলছেন, ৩০ লাখ সংখ্যাটি ভারতীয় ও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ থেকে। এখানে ভুলটি হলো ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কখনও সংখ্যার কথা বলেনি। এ সংখ্যার উল্লেখ প্রথম করেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের মুখপাত্র প্রাভদা। হতে পারে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ সে অনুসারে বলেছে। বাংলাদেশের হিসাবটাও এরকম এখন, গণহত্যার সুনির্দিষ্ট হিসাব কখনও কেউ দিতে পারে না। সরকার যে হিসাব দেয় সেটিই মেনে নেওয়া হয়। এবং সেটি সমস্ত বিচার করে আনুমানিক হিসাব। আমাদেরও সেটি মেনে নিতে হবে। এখানে সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অর্থ্যাৎ রাষ্ট্রীয় ডিসকোর্স অস্বীকার করা। এটাকে অ্যাকাডেমিক ফ্রিডম বলতে পারেন কিন্তু সে অ্যাকাডেমিক ফ্রিডম মানুষের বিশ্বাস বা যন্ত্রণা প্রশ্নবিদ্ধ কারা। হলোকাস্টের সংখ্যা নিয়ে কেউ এখন প্রশ্ন করে না। কেউ কেউ একসময় করেছিলেন তখনই তারা ‘রিভিশিনিস্ট’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রেও তারা গুরুত্ব হারিয়েছেন। ডেভিড বার্গমান একসময় বাংলাদেশের কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীকে নিয়ে তথচিত্র নির্মাণ করে আদৃত হয়েছিলেন। মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের সময় হঠাৎ তিনি জামায়াত-বিএনপি-পাকিস্তানিদের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে কিনা, ৩০ লক্ষ শহীদ হয়েছে কিনা এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলছিলেন।

ট্রাইব্যুনাল তাঁকে সর্তক করে দিয়েছিল। হঠাৎ তিনি একদিন আমাকে ফোন করে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য দেখা করতে চাইলেন। আমি বললাম, ডেভিড আমি আপনার বক্তব্য জানি, আপনি আমার বক্তব্য জানেন। আপনি যদি জার্মানী বা ইসরায়েল বা ইউরোপ নিয়ে বলতে পারেন, হলোকাস্ট হয়নি তখন আমি আনার সঙ্গে কথা বলতে পারি। এরপর আলাপ আর এগোয়নি। আমি অনেক সময় লিখেছি এবং বলেছি যে, ১৯৭১ সালে যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি তিনি বুঝবেন না ১৯৭১ কী। যার স্ত্রীকে তার সামনে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে, পিতাকে বেয়নেটবিদ্ধ করা হয়েছে, বোন ও কন্যাকে তুলে নেয়া হয়েছে তিনি সংখ্যাতাত্ত্বিক প্রশ্ন তুলতেন না।

কোনো শহীদ পরিবারের সদস্যরাও তোলেননি, তাদের পরিবারের যারা শিক্ষক বা গবেষণা সংস্থার সঙ্গে জড়িত তারাও তোলেননি, তোলেন, তারাই যারা ক্ষতিগ্রস্ত হননি বা বিদেশি তত্ত্ব আত্মস্থ করতে পারেন নি। তারাই এসব কুতর্ক করেন। তবে, ইমতিয়াজ তাঁর অবস্থান এখন পরিবর্তন করেছেন। বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বা যখন তাকে গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য পদাধিকার বলে বাইরে নেয়া হয়েছে, তাদের প্রকাশনাতে এ বিতর্ক তোলেননি। তবে, পুরোটা এখনও মেনে নেননি। গত গণহত্যা দিবসেও তাদের সেন্টারের ব্যানারে লেখা হয়েছে প্রায় ৩০ লক্ষ।

আচ্ছা ত্রিশ লক্ষ শহীদ না হয়ে থাকলে তাদের সমস্যাটা কোথায়? বা ১৫ লাখ হলে কি খুনিদের দায়ভার কমে? যেমন, ধর্ষণের সংখ্যা এখন সরকারীভাবে বলা হয় ২ লক্ষ। সে সময়কার আমাদের বা সরকারের মনে হয়েছে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তাদের অপমান। কিন্তু যারা এ বিষয়ে গবেষণা করেছেন তারা বলছেন, ও সংখ্যা কম, এ সংখ্যা পাঁচ লাখেরও ওপর। এটি বিতর্ক নয়, দু’লক্ষ মেনে নিয়েই সংখ্যা বলা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের প্রখ্যাত ভাষ্যকার এম. এ. নকভীর কথা মনে হচ্ছে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি আমাকে বলেছিলেন, টিক্কা খান ঢাকা থেকে ফিরে এর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলছিলেন, বাংলাদেশে মাত্র তিন হাজার ধর্ষিত হয়েছে। মানে বিষয়টা তুচ্ছ। নকভী চোখে পানি নিয়ে আমাকে বলেছিলেন, যারা রাষ্ট্রের রক্ষক তারা যদি একজনকেও ধর্ষণ করে সেটিও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ।

সুভাষ বোসের নাতনী শরমিলা বোস বোধহয় টিক্কার সংখ্যাটিকে মেনেই বই লিখেছিলেন। লিবারেল পাকিস্তানিরা বা যারা গণহত্যার প্রতিবাদ করেছিলেন, তারা এটি শুনে হাসেন, বলেন, তাকে জেনারেলরা সব কিছুতেই এত তুষ্ট করেছেন যে তিনি তাদের বলা সংখ্যাটিই মেনে নিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের ক্ষমা করে নিয়ে অনেক কথা বলেছেন ইমতিয়াজ। পাকিস্তানী অপরাধীদের সংখ্যা ৪০০ থেকে কমে ১১৪ হলো এবং বিচার হলো না। ইমতিয়াজ এটি বলতে ভুলে গেলেন কেনো যে, দেশি কাদের আটকে রাখা হয়েছিল। যারা অগ্নিসংযোগ থেকে ধর্ষণ খুন করেছিলেন তাদের ছাড়া হয়নি। জিয়া কেনো এই ঘাতকদের ছেড়ে দিলেন সেটিও উল্লেখ করেন নি। জিয়া তখন ঘাতকদের মুক্তি দিয়ে পাকিস্তানিদের ইচ্ছা ও তাদের সঙ্গে মিত্রতা করে রাজনীতি করার অভিলাষ পূরণ করেছিলেন। পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীরা তখন পাকিস্তানে। বাস্তবে কি তাদের বিচার সম্ভব ছিল?

নির্মূল কমিটি সম্পর্কেও কিছু বক্তব্য আছে। আমি এর একজন প্রতিষ্ঠাতা, দীর্ঘদিন এর সঙ্গে যুক্ত। এখানে তার বক্তব্য- ‘দি সিভিল বডি কুড নট রেজিস্ট দা টেম্পটেশন অব বিং পার্টিজান’ এর অর্থ কি? ঘাতকদের বিচার চাওয়া কি পার্টিজান হওয়া? আওয়ামী লীগ এর সমর্থন করে কি অপরাধ করেছে। এই সব বিদ্বৎজনারা যারা কখনও বাংলাদেশে স্বৈরাচার বা মানবাতাবিরোধী অপরাধ বিচারে অংশগ্রহণ দূরে থাক সমর্থন করেতেও এগিয়ে আসেননি তারা ভুলে যান- আন্দোলনটি পরিচালিত হয়েছিল সমন্বয় কমিটির নেতৃত্বে যেখানে বিএনপি-জামায়াত ছাড়া অনেক রাজনৈতিক দল ও সাংস্কৃতিক সংস্থা যুক্ত ছিলেন। যে কারণে, এই আন্দোলন জোরদার হয়েছিল।

নব্বই দশকে বিএনপি-জামায়াতপন্থি সমর্থকরা প্রায়ই বলতেন ইমতিয়াজের মতো যে, জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ কৌশলগত মৈত্রী করেছিল। কৌশল ঠিক করার জন্য তাদের কি লিয়াজোঁ কমিটি ছিল? আওয়ামী লীগ তাহলে তাদের ‘মিত্র’ জামায়াতকে নিয়ে সরকার গঠনে অগ্রসর হয়নি কেনো বা সরকারের সমর্থন চায়নি কেনো? নির্মূল কমিটির কার্যক্রম তখন থেকে প্রায় বন্ধ ছিল বরং ‘পার্টিজান’ অর্থাৎ আওয়ামী লীগের কারণে ব্যবহৃত হয়েছে। ঐ সময় নির্মূল কমিটির কার্যক্রম বিন্দুমাত্র বন্ধ হয়নি। ঐ সময়ের সংবাদপত্র দেখলেই তা স্পষ্ট হবে। নির্মূল কমিটি ঘাতকদের বিচার চায়, আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে বামপন্থিরা বিচার চেয়েছে এটি ‘স্ট্যার্টিস্ট ডিসকোর্সের’ অন্তর্গত হলো কি করে?

কাব্যিক ভাষায় তিনি জানতে চেয়েছেন এখানে ভিকটিমদের অবস্থান কী? গণআদালত রমনা সোহরাওয়ার্দীতে যারা মিলিত হয়েছিলেন তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ কি ভিকটিম ছিলেন না? যদি গণতন্ত্র মানে রাজনৈতিক দলই তো প্রতিনিধিত্ব করবে জনগণের [বা ভিকটিমের]। সেখানে কি ভিকটিমরা কি বিচারের দাবি করছে না? ভিকটিমদের দাবির কারণেইতো নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে সব দল বিচারের দাবিকে সমর্থন করেছিল। এভাবেই তো ভিকটিমরা অংশগ্রহণ করেই তো তাদের দাবি সজিব রাখতে পেরেছিল।

‘ডিসকোর্স অব দি পার্সন’- এ শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যদিও আলোচনায় বাংলাদেশ। এটি একটি ‘কেস স্টাডি’ বললে আরো যথার্থ হতো। অনেক তত্ত্ব কথার পর ইমতিয়াজ কিন্তু শেষে ঘাতকদের বিচারই চেয়েছেন। এবং বলেছেন, বিচার না হলে হত্যা ‘ন্যাশনাল ট্রেজারে’ পরিণত হবে। ধন্যবাদ এই বোধের জন্য। আমাদের আন্দোলনের কারণটিই তা।

৪০ পৃষ্ঠায় তিনি যে সব বক্তব্য দিয়েছেন ধর্ম, ভাষা, জাতি নিয়ে যে সব কথা বলেছেন তাতে সত্যিই অবাক হয়েছি। এ বিষয়ে শামসুদ্দিন চৌধুরী, অধিকারী ও জালাল লিখেছেন। আমি আর পুনরায় করব না।একজন পণ্ডিত অধ্যাপক তাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কীভাবে বলতে পারেন, এ গণহত্যার ধর্মীয় ভিত্তি ছিল না? ১৯৭১ সালের পশ্চিম পাকিস্তানি যাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম তারা প্রত্যেকে বলেছেন, বাঙালিরা পুরোপুরি মুসলমান নয়, সৈন্যদের বলা হয়েছিল কাফেরদের হত্যা করতে হবে।

এটির ভিত্তি জাতিগত ছিল না এর মানে কি? পশ্চিমাদের সঙ্গে ‘ইন্টার-কালচারাল’ রিলেশন কি ছিল? আন্ত-বিবাহ কয়টি হয়েছিল? ভাষাগত ছিল না মানে কি? রাষ্ট্রের একটি ভাষা ছিল বটে বাংলা কিন্তু বাংলা কি সব সময় বলা হয়নি হিন্দুর ভাষা? বাংলার অবয়ব বদলের চেষ্টা কি সব সময় ছিল না? এই গণহত্যায় ‘আইডলিজিকাল’ কারণ না থাকলে কি কারণ ছিল? পাকিস্তানিরা হঠাৎ এসে হত্যা শুরু করলো?

৫যাক, আগে বইটি পড়িনি, ভালোই হয়েছে। বৃদ্ধ বয়সে রক্ত শীতল হয়ে যায় সেটি একদিক থেকে উত্তম। কিন্তু লিখতে হলো সর্বশেষ একটি ভাষ্য নিয়ে, জার্মানির ডায়চে ভেলের বিবরণ। তাদের শিরোনাম ‘ঢাবিতে অধ্যাপক ইমতিয়াজের ‘শাস্তি’। অর্থাৎ তাকে প্রশাসনিক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে যা শাস্তি। অধ্যাপক ইমতিয়াজ আগে যা বলেছেন এখনও তাই বলেছেন। এখানে বন্ধু অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। তিনি বলেছেন-অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম বলেছেন, “অবশ্যই ইতিবাচকভাবে এর সমাধান করা যেতো। অধ্যাপক ইমতিয়াজ জেনোসাইড নিয়ে যে কাজ করেছেন তা অনেকেই করেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ গঠনেও তার ভূমিকা আছে। এনিয়ে তিনি প্রচুর পরিশ্রম করেছেন। তবে হ্যাঁ, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আমিও ছিলাম। অধ্যাপক ইমতিয়াজ ছিলেন কিনা আমি জানি না। একজন বিদেশি সাংবাদিকের দোভাষী হিসেবে কাজ করার জন্য আমি সেখানে গিয়েছিলাম।

বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান বলেননি। যদিও বিচারপতি হাবিবুর রহমান, কবি শামসুর রহমানও এই কথাটা বলেছেন। তারা কোথায় পেয়েছেন সেটা আমি জানি না। কিন্তু অধ্যাপক ইমতিয়াজ যদি এই কথাটা লিখেও থাকেন, আমি বিশ্বাস করি তিনি বঙ্গবন্ধুকে খাটো করার জন্য এটা বলেননি।

বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনিক আলোচনা হতে পারে। আমি মনে করি, কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল, অধ্যাপক ইমতিয়াজকে ডেকে কথা বলা। তখন বোঝা যেতো, তিনি ১৪ বছর আগের সেই অবস্থানে আছেন কিনা? বিশ্ববিদ্যালয় হল মুক্ত বুদ্ধির চর্চার জায়গা। সবাই যে একমত হবেন বিষয়টি তো এমন না-ও হতে পারে। বরং আমি মনে করি, বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করে জেনোসাইড নিয়ে অধ্যাপক ইমতিয়াজকে আরো বেশি কাজে লাগালে সেটি ভালো হতো।”

হ্যা, আমি তাঁর সঙ্গে একমত তাকে [তদন্ত কমিটি ডাকতে পারতেন। কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তিবুদ্ধি চর্চার কেন্দ্র সেটি আমিও মানি। মনজুর পুরো বইটি পড়েছেন কিনা জানি না। শিক্ষক বিভ্রান্ত হলে, ছাত্র বিভ্রান্ত হয়; শিক্ষক সত্য নয় এমন তথ্য ব্যবহার করলে ছাত্রও তা শেখে, মুক্তিবুদ্ধি চর্চা বা একাডেমিক ফ্রিডম] ও বিভ্রান্তি ছড়ানো কি পরস্পর বিরোধী নয়? মনজুর শুধু রেসকোর্সে বক্তৃতার গুরুত্ব দিয়েছেন। আমি বলব, সেটি একটি বক্তব্য মাত্র। এ ধরনের বহু বক্তব্য আছে। আসলে আমিও মনে করি না, অধ্যাপক ইমতিয়াজ বাংলাদেশ বা বঙ্গবন্ধু বিরোধী। অতিরিক্ত তত্ত্বকথা বলে একটি ‘আধুনিক’ তাত্ত্বিক ফ্রেম তৈরি করে ইচ্ছেমতো লাগসই বক্তব্য দিয়েছেন। তত্ত্বের ব্যাপারটাও যেমন আত্মস্থ করতে পারেন নি। সমস্যা এখানে। সমস্যা আরো কঠিন হয়ে দাঁড়ায় যখন দেখা যায় তিনি এমন দুটি সংস্থার প্রধান যা বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে কাজ করবে। কিন্তু, মনজুর যে প্রশ্নটি তুলেছেন, তা বিচারপতি মানিকও তুলেছেন এবং আমরাও তুলছি তাহলো তিনি আগের অবস্থানে আছেন কিনা?

তিনি কিন্তু ইমতিয়াজ সেটি কখনও বলছেন না। সবাই বঙ্গবন্ধুর অবমাননাতেই বিষয়টি সীমিত রাখছেন। আমি এক যুগ আগে যে অবস্থানে ছিলাম এখন সে অবস্থানে নাও থাকতে পারি এবং তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সে ক্ষেত্রে সৎসাহসের সঙ্গে বলতে হবে, যে তত্ত্ব দিয়েছিলাম, যে বিবরণ দিয়েছিলাম তা সঠিক নয়, বিভ্রান্তিকর। সে জন্য দুঃখিত। এবই আর প্রকাশিত হবে না ও বইয়ের প্রকাশক ইউপিএল কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও কথা হয়েছে তারা জানিয়েছে এ বই তারা প্রকাশ করবেন না। ইমতিয়াজ [বা অন্যান্য যারা] কাজ করছেন গণহত্যায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য তাঁর পূর্বেকার অবস্থান বর্তমান অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ক্ষেত্রে অন্তরায়। সেটি কারো পক্ষে মেনে নেয়া কঠিন।

ডয়েচে ভেলে এ প্রসঙ্গে শাহরিয়ার কবিরেরও সাক্ষাৎকার নিয়েছিল, কিন্তু সেটি প্রচার করেনি কারণ তা তাদের বক্তব্যের [যাতে ইঙ্গিত করা হয়েছে ঢাবির পদক্ষেপ বা অন্যদের সমালোচনা] পক্ষে নয়, সেটিই বোধ হয় কারণ। ইউটিউবে দেখেছি, ডয়েচে ভেলের এ ধরনের অনুষ্ঠান বিশেষ ব্যক্তি, সরকার ও দলকে লক্ষ্য করে প্রচণ্ড সমালোচনা করা হয় এবং তা অত্যন্ত আগ্রাসী। এটি নিরপেক্ষ সংবাদ মাধ্যমের বিপরীত। বাংলাদেশকে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার আগে নিজেদের অবস্থান ঠিক করা উচিত। ৬বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে গণহত্যা বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিদ্বৎজনের সভাও বলেছে বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছে। ইমতিয়াজের তত্ত্ব মানলে বলতে হবে গণহত্যা হয়নি। আইএসআই একইভাবে শর্মিলা বোস ও জুনায়েদ আহমদ-কে দিয়ে এ ধরণের তত্ত্ব প্রচার করেছে। ইমতিয়াজও স্বীকার করেছেন পাকিস্তান থেকে টাকা পেয়েছেন। এ ক’পাতা বই লেখার জন্য পাকিস্তান থেকে টাকা নেওয়ার দরকার ছিল না। সে জন্যই কি তার তত্ত্ব আইএস আইয়ের তত্ত্বের মতো? এতত্ত্বের আরো প্রতিফলন দেখি যখন তিনি বলেন ৫০ হাজার বিহারি হত্যা করা হয়েছে এবং যারা করেছে তাদের বিচার হওয়া দরকার। ৫০ হাজার বিহারি হত্যা হলো এখানকার কোনো গণমাধ্যমে তা লেখা হলো না, লেখা হলো শুধু ১৯৭১ সালে প্রকাশিত পাকিস্তানেরর শ্বেতপত্রে? হ্যা, ইয়াসমিন সাইকিয়া নামে আরেকজন গবেষকও একই ধরনের মন্তব্য করেছেন। দাঙ্গাকারী সবারই বিচার হওয়া উচিত, খালি বাঙালিদের বিচার দাবি এটি কোন ধরনের মুক্তি।

আমার মূল বক্তব্য, যে কারণে এ লেখা তাহলো- ইমতিয়াজের বই গণহত্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে যা অস্বীকারের সামিল। গণহত্যা নিয়ে প্রশ্ন বা অস্বীকার এক ধরনের অপরাধ। জেনোসাইড সেন্টারের প্রধান হয়ে একথা অস্বীকার না করা আরো নৈতিকতা বিরোধী কাজ। ফ্রান্সে যখন হলোকাস্ট ডিনাইল অ্যাক্ট করা হয় তখন নোয়াম চমস্কি এর বিরোধিতা করেছিলেন, বলেছিলেন, ভলতেয়ারের দেশে এ কি হচ্ছে? ফরাসী বুদ্ধিজীবীরা বলেছিলেন, গণহত্যা অপরাধ, কোনো যুক্তি দিয়ে তা অস্বীকার করা যাবে না, ভলতেয়ারের দেশ হলেও। পাকিস্তানিরা, পশ্চিমা অনেকে ১৯৭১-কে গৃহযুদ্ধ বলে, পাকিস্তানিরাও বলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, যেখানে মর্মান্তিক সব হত্যা হয়েছে ১৯৭১ সালে তিনি কেনো পাকিস্তানিদের তত্ত্বের প্রতিধ্বনি করবেন? এখনও?

অধিকারী ও জালাল যে মন্তব্যটি করেছেন সেটি প্রণিধানযোগ্য। তাঁরা বলেছেন এধরণের বই উপেক্ষা করতে পারেন, কিন্তু করলে ক্ষতি। কারণ ইমতিয়াজ আহমদতো রামশ্যাম নন, তিনি বাংলাদেশের প্রাচীন ও শীর্ষ স্থানীয় বিশ্ববিদ্যায়ের অধ্যাপক ও দুটি সেন্টারের পরিচালক, এতো যাতা ব্যাপার নয়। আমার ৪৫ বছর চাকুরি জীবনে কোনো উপাচার্যের প্রিয়ভাজন না হতে পারার দরুন এ ধরনের কোনো সেন্টারেই নিয়োগ পাইনি।

সুতরাং, এটি হেলাফেলার ব্যাপার নয়। অধিকারী ও জালাল লিখছেন, “সবচেয়ে বড় অপরাধ, যার জন্য গ্রন্থাকারকে দায়ী করতে হবে, তাহলে তার বিকৃত ডিসকোর্স সমর্থন করার জন্য, ইচ্ছাকৃতভাবে তথ্য বিকৃতি যাতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বঙ্গবন্ধুর কোনো কৃতিত্ব না থাকে। মুক্তিযুদ্ধকে তিনি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে চিত্রিত করে দেখিয়েছেন, ভারতই সব কিছু করেছে, বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না। ÒAnd with some adept surgery he is able to make it appear so to a lay reader.”

প্রতি অধ্যায়ের প্রতি প্যারাতেই ইমতিয়াজ এ ধরনের বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করেছেন, তথ্য বিকৃতি ঘটিয়েছেন। আমি বুঝতে অক্ষম কেনো তিনি এমনটি ভাবলেন বা লিখলেন? কেনো তার চিন্তা সব সময় পাকিস্তান প্রত্যয়ের সঙ্গে মিলে যায় বা বিএনপি-জামায়াত তত্ত্বের সঙ্গে।

এ বই নিয়ে এসব আলোচনা যখন চলছে তখন সাংবাদিক স্বদেশ রায় আমাকে বলছিলেন, আপনার একটি ঘটনার কথা মনে আছে কিনা। তখন বাংলা ভাই নিয়ে খুব হৈ চৈ চলছে। ড. ইমতিয়াজ তখন দুটি সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, বাংলা ভাই বা জঙ্গীদের সঙ্গে সরকারের উচিত আলোচনা করা। তো আসাাদুজ্জামান নূর তখন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। আপনি আমাকে নিয়ে তাঁকে দেখতে গেছিলেন। সেখানে ড. ইমতিয়াজও ছিলেন। কথা প্রসঙ্গে আপনি তাঁকে বলেছিলেন, ইমতিয়াজ এসব ইস্যুতে সব না জেনে মন্তব্য করো না তাতে জটিলতা বাড়ে।

জঙ্গীবাদকে বিএনপি প্রশয় দেওয়ার কারণে কী ঘটেছিল তা সবাই জানে, আফগানিস্তানেও তালেবানদের বা অন্য জঙ্গীদের প্রশ্রয় দেওয়ার কারণে আজ কী অবস্থা সেখানে দেখুন। তো এইসব বুদ্ধিজীবীর পরামর্শ সরকার শুনলে আজ কী অবস্থা হতো।

প্রশ্ন হচ্ছে, পাকিস্তান থেকে গবেষণার টাকা পেয়ে গবেষণার সহকারী পেয়ে ৪০-৪৪ পৃষ্ঠার একটি বইয়ে এত ভুল থাকবে কেনো? আর যদি সেগুলি ভুল না হয়, তাহলে এগুলি ইচ্ছাকৃত। ইচ্ছাকৃত ভুল মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা বা একাডেমিক ফ্রিডম নয় বা মুক্তবুদ্ধির চর্চাও নয়। অতি উৎসাহী বুদ্ধিজীবী ও মুক্ত মনা বুদ্ধিজীবী যারা এধরনের মন্তব্য করেন তাদের আগে বইটি পড়ে মন্তব্য করতে বলব। একাডেমিক ফ্রিডম স্বেচ্ছাচারী গবেষণা নয়, ইতিহাসের তথ্য বিকৃতি নয়, পাঠককে বিভ্রান্ত করাও নয়।

লেখক: ইতিহাসবিদ, বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/এমএস