যারা একটু হলেও প্লেটো পড়েছেন, তাদের সম্ভবত রিয়েল আর আনরিয়েল জগতের একটা ধারণা থাকার কথা, যেখানে প্লেটো ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, আমরা আসলে একটা রিয়েল জগতের ছায়ার নিচে বাস করি। ছায়াটাকেই কায়া বা বাস্তব হিসেবে মানি, মানতে বাধ্য কারণ ছায়াকে কায়া হিসেবে জানার জন্য যে প্রজ্ঞা দরকার সেটা আমাদের নেই। একটা বড় গুহার ভেতর আমাদের হাত-পা বাঁধা আছে, যার ফলে সেই অন্ধকার থেকে কিছুতেই আলোয় আসতে পারি না। আর আলোয় না আসতে পারার কারণে আমরা বস্তুত সেই আনরিয়েল জগতেই থেকে গেছি। আমেরিকান কবি স্টিফেন ডান প্লেটোর ‘এলিগরি অব দ্য কেভ’কে নিয়ে কী আসাধারণ কবিতাই না লিখেছেন। সেই কেভ থেকে বিশ শতকে ফিরে আসা একজনের ভাষ্য নিয়ে স্টিফেন ডান কী অপূর্ব এক প্রশ্নের মুখোমুখি করেছেন আমাদের, কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা! যাকে সত্য বলে জানি, তা কি আসলেই সত্য? রবি ঠাকুরের মনের সেই প্রশ্ন, ‘একি সত্য সকলই সত্য, হে আমারও চিরভক্ত।।’
Advertisement
রিপাবলিকে কয়েকটা ডায়ালগের ভেতর দিয়ে নিজের কথাগুলো প্রকাশ করেছেন প্লেটো। তাঁর ধারণা ছিল, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ আমাদের ধারণার জগতের থেকে আলাদা। কারণ ধারণার জগতই হলো আইডিয়াল ফর্মের জগৎ। আর এ ক্ষেত্রে আমি যে জগতে বেড়ে উঠেছি, যে জগৎ আমাদের পরিপুষ্ট করে তুলেছে প্রতিদিন; সে জগতের বস্তুত কোনো জ্ঞানীয় মূল্য নেই। এ যেন, ‘ধরায় যখন দাও না ধরা হৃদয় তখন তোমায় ভরা, এখন তোমার আপন আলোয় তোমায় চাহি রে’। রবীন্দ্রনাথ ‘দ্য কিং অব দ্য ডার্ক চেম্বারে’ ঠিক তেমনি রূপের অন্তরালে অরূপ সৌন্দর্যকে খোঁজ করিয়েছেন সুদর্শনাকে দিয়ে। বলছেন মানব চেতনার সবটুকু তো রূপের ভেতর থাকে না! এর পেছনে রূপাতীত সৌন্দর্যটাই আসল। অর্থাৎ ‘রূপহীন জ্ঞানাতীত ভীষণ শকতি/ ধরিয়া আমার কাছে জননীমুরতি’। যাক, এ তো গেল রূপ-অরূপের আর রিয়েল-আনরিয়েলের কথা। কিন্তু পরের কথাটা কী? পরের কথাটা নিশ্চয়ই হাইপার-রিয়েলের গল্প। বাংলাটা অবশ্য পরাবাস্তব বা অধিবাস্তব করা যেত, কিন্তু হাইপার রিয়েল থাকলে মনে হয় এর আসল একটা স্বাদ পাওয়া যায়। তবে হাইপার রিয়েলের বাংলা তরজামা করতে নিশ্চিতভাবে অবাস্তব শব্দটা আনা যাবে না। কারণ অবাস্তব আর হাইপার রিয়েল এক নয়।
যা হোক, হাইপার-রিয়েলের ব্যাপারটা দেখা যাক। মানুষের পরিবৃত সাংস্কৃতিক বোধের একটা নতুন ব্যাখ্যা যা আমরা পেয়েছি এই প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ বাস্তবতায় বিশেষ করে উত্তর-আধুনিক চিন্তার প্রেক্ষাপটে। তবে বাস্তব চেতনা বা রিয়েলিটির থেকে তার সিমুলেশন বের করার মাঝেই আছে হাইপার-রিয়েলিটির গল্প। অনেকে জোর দিয়ে বলেছেন, হাইপার-রিয়েলিটি হচ্ছে বাস্তবের সাথে কল্পকথার এক নির্বিঘ্ন মিশ্রণ এবং সাথে সাথে এটাও যে কোথায় কল্পকথা শেষ হচ্ছে আর হাইপার-রিয়েলিটি শুরু হচ্ছে তার সীমানা নির্দেশনা না করতে পারার এক মধুর যন্ত্রণা। হাইপার-রিয়েলিটির ধারণা খুব বেশি পুরোনো নয়, বলা যায় ফরাসি দেশে এর উদ্ভব গেলো শতাব্দির শেষের দিকে। জাঁ বোদ্রিয়াড হলেন এই ধারণার উদ্ভাবক। বোদ্রিয়াডকে বলা হয় উত্তর-আধুনিক চিন্তার অন্যতম এক পিলার। হাইপার রিয়েলিটি ছাড়াও জাগতিক চিন্তার এক অবশ্যম্ভাবী ধারা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন, যেটা শুধু দর্শনই নয়, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, শিল্পকলা, সিনেমা কিংবা আর্টের ক্ষেত্রেও সমান জরুরি। আমরা তাঁর দর্শনের গভীরতার খোঁজ নেওয়ার আগে জেনে নিতে চেষ্টা করি ব্যক্তিজীবন ও তাঁর জীবনাবস্থার সামগ্রিকতা যা তাঁর দর্শন চিন্তাকে প্রভাবিত করেছে।
বোদ্রিয়াড জন্মগ্রহণ করেন ফ্রান্সের রেমস শহরে ১৯২৯ সালে। অতি সাধারণ এক পরিবারে তাঁর জন্ম, যে পরিবারে কেউই উচ্চশিক্ষার দোরগোড়ায় পৌঁছাতে পারেনি বোদ্রিয়াড ছাড়া। ঠাকুর দাদা ছিলেন কৃষক এবং বাবা সরকারি চাকরিজীবী। ১৯৫৬ সালে হাইস্কুলে চাকরি নেন বোদ্রিয়াড। ৬০-এর দশকের পুরোটাই তাঁর জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। ফরাসি মার্কসিস্ট হেনরি লেফব্রের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হওয়ার পর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। এ সময় তিনি আরেক দার্শনিক রোঁলা বার্থের সংস্পর্শেও আসেন। বার্থের ভাষা সংক্রান্ত সেমিওটিসিয়ান ব্যাখ্যা তাঁর জীবনে খুবই কাজে লাগে। ১৯৬৬ সালে ইউনিভার্সিটি অব প্যারিসে ভাষা, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদি পড়ার সময় লেফেব্রর সহকারী হিসেবে কাজের সুযোগ পান। এই সালেই তিনি ‘দ্যা সিস্টেম অব অবজেক্ট’র ওপর একটা অভিসন্দর্ভ রচনা করে পিএইচডি শেষ করেন। তাঁর এই ডক্টরাল থিসিসের সুপারভাইজার ছিলেন রোলা বার্থ, হেনরি লেফেব্র ও পিয়েরে বরডিউ। ১৯৬৮ সালে ‘দ্য সিস্টেম অব অবজেক্ট’ নামে তাঁর প্রথম বই প্রকাশ হয়। আলজেরিয়া ও ভিয়েতনাম যুদ্ধে ফরাসি ও আমেরিকার নগ্ন আক্রমণের বিরুদ্ধে একজন কমিউনিস্ট হিসেবে বোদ্রিয়াড সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া দেখান। এ ছাড়া ফ্রান্সে ১৯৬৮ সালে যে নজিরবিহীন ছাত্র-আন্দোলন হয় তার অন্যতম এক সদস্য হিসেবে বোদ্রিয়াড নিজের নাম লেখান। এর ফলে দ্য গল সরকারের ভিত নড়ে যায়। ১৯৬০-এর দশকের পুরোটাই দর্শন, কনজ্যুমারিজম, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, সাইকো-অ্যানালিসিস, সেমিওলজি ইত্যাদি নিয়ে তিনি ব্যাপক লেখালিখি করেন। পরিপ্রেক্ষিতে এসব তাঁকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দেয়। এ সময়ের আরও কিছু বইয়ের ভেতর আছে ‘দ্য কনজিউমার সোসাইটি’, ‘ফর এ ক্রিটিক অব দ্য পলিটিক্যাল ইকোনমি অব দ্য সাইন’ ইত্যাদি। তাঁর প্রথমদিকের কাজের ধরনের মধ্যে ছিল সমসাময়িক মিডিয়া ও ভোক্তা গঠনকারী চিহ্ন এবং অর্থের একটা সিস্টেমের সাথে কীভাবে এনকোড করা হয় তার বিশ্লেষণ। বস্তুত সেমিওলজি বা সংকেত তত্ত্বের সাথে মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থনীতি, ভোক্তা সমাজের সমাজবৈজ্ঞানিক মনোভাবের সমন্বয় ঘটনাই ছিল তাঁর সারাজীবনের দার্শনিক প্রচেষ্টা। আমরা প্রাত্যহিক জীবনে ভোগের উদ্দেশ্যে যে বস্তুগুলো বিনিয়োগ করি এবং আধুনিক সমাজে তার যে একটা কাঠামোগত পদ্ধতি তৈরি হয় সেগুলোর অর্থ নিরূপণের জন্য তিনি ব্যাপক কাজ করেন। রোঁলা বার্থের মতো তিনিও মনে করেন ফ্যাশন, স্পোর্টস, মিডিয়া ও অন্য উপাদানগুলো সুনির্দিষ্ট আইন, যুক্তি এবং কোডের মাধ্যমে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। বোদ্রিয়াড মনে করেন, আমাদের সব ধরনের সমাজিক বাস্তবতা এবং অর্থকে প্রতীক ও চিহ্ন দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। মানুষের অভিজ্ঞতা এই বাস্তবতারই অনুকরণ।
Advertisement
১৯৭০ এর দিকে তিনি মার্কসীয় বৈপ্লবিক ধারণা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। পরিবর্তে তিনি ‘অপ্রত্যাশিত অথচ নির্দিষ্ট’ আকারের ভোক্তা সমাজের বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহের ইঙ্গিত দেন। ৬০-এর দশকের শেষ নাগাদ একটা বৈদ্ধিক সমাজের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন বোদ্রিয়াড। এর নাম ছিল ‘ইউটপি’। এসময় তিনি ফরাসি মার্কসিস্ট গাই ডেবোর্ট-এর সিচুয়েশানিস্ট থিওরি দ্বারা ব্যাপক প্রভাবিত হন। সিচুয়েশানিস্ট থিওরি হচ্ছে এমন যে, মানুষ যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে সেই পরিবেশ থেকেই তার চিন্তার আকার তৈরি হয়। বাইরের পরিবেশের প্রভাব এখানে বিশেষভাবে কাজ করে। এ সময় তিনি প্রচলিত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আবহের বাইরে গিয়ে ইডিওসিংক্রেটিক ও মার্জিনাল ডিসকোর্সের ওপর নিজস্ব ঘরানা তৈরি করেন। তাঁর চিন্তাধারার মধ্যে বিপুল পরিমাণ মার্কসিজমের প্রভাব ছিল। এজন্য অনেকেই তাঁকে নিও-মার্কসিস্ট নামে অভিহিত করেন। কারণ তাঁর ধারণা ছিল পুঁজিবাদ মানুষের সক্ষমতা, সৃজনশীলতা, মানবিক শক্তি, সময় এবং সামর্থ নষ্ট করে দেয়। একজন মুক্তচিন্তক ও স্বাধীনচেতা মানুষ হিসেবে তিনি মনে করতেন মানুষের স্বকীয়তা গড়ে ওঠে ভাষা, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অবয়বের মধ্য দিয়ে। এ কারণেই তাঁকে উত্তর-আধুনিক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
১৯৭০ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান, ১৯৭৩-এ যান টোকিও-তে। ১৯৮৬ সালে ফ্রান্সের বিখ্যাত শরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। বোদ্রিয়াড ৮০-র দশক থেকেই বিশ্ববাসীর কাছে স্বনামধন্য একজন দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী বিশেষ করে উত্তর-আধুনিক চিন্তক হিসেবে সবার কাছে পরিচিত হয়ে আসছেন। বোদ্রিয়াড তাঁর লেখালিখিতে সব সময় ব্যবহার করতেন টাইপ-রাইটার। এর কারণ হিসেবে তিনি বলতেন, লেখালিখির সাথে নিজের আত্মিক সংযোগের জন্য কম্পিউটার ঠিক প্রাণের জায়গা হয়ে ওঠে না। এ জন্য তাঁর ধারণা ছিল হাতের সাথে লেখার সংযোগ দরকার। বোদ্রিয়াড দুবার বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রী লুস্লি বোদ্রিয়াডের ছিল দুসন্তান। ১৯৯৪ সালে ৬৫ বছর বয়সে তিনি আবার বিয়ে করেন মেরিন ডিউপিস নামে ২৫ বছরের এক মেয়েকে। ২০০৫ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে প্যারিসে ৭৭ বছর বয়সে বোদ্রিয়াড মারা যান।
গভীরভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে, বোদ্রিয়াডের চিন্তার ধরন ফরাসি অন্য চিন্তক যেমন, জিল দল্যুজ, জ্যাঁ ফ্রাঙ্ককুইস-লিওতার্ড, মিসেল ফুঁকো, জ্যাঁক দেরিদা, কিম্বা জ্যাঁক লাকার মতো। জেমস এম রাসেল লিখেছেন, ‘বোদ্রিয়াডের চিন্তা চেতনা সব উত্তর-কাঠামোবাদীর মতোই। কোনো বিষয়ের তাৎপর্য বুঝতে হলে তাতে ব্যবহৃত নির্দিষ্ট শব্দ বা চিহ্ন কীভাবে পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়েছে তা বুঝতে হবে’। সব উত্তর-কাঠামোবাদীই মনে করেন, কোনো বিষয়ের অর্থ বুঝতে হলে তাতে ব্যবহৃত চিহ্নের কায়দা দেখে। যেমন ‘কুকুর’ শব্দটা বুঝতে হয় এমনভাবে যে যেটা বিড়াল নয়, যেটা ছাগল কিংবা গাছ নয়। এই পার্থক্যটা আমি জানি বিধায় কুকুরকে আমি বিড়াল কিংবা অন্য কোনো প্রাণীর সাথে গুলিয়ে ফেলি না। অর্থাৎ এখানে একটা সেলফ রেফারেনসিয়ালিটির ব্যাপার ঘটে। মনুষ্য সমাজকে বুঝতেও এই সেলফ-রেফারেনশিয়ালিটি লাগে। একটা বিষয়ের অর্থ তাই সঙ্গতভাবে অন্যের সাথে মিলিয়ে বুঝতে হয়। মিসেল ফুঁকো যেমন বলছেন, জ্ঞানের সংগঠনকে বুঝতে হলে সেটাকে বুঝতে হবে ক্ষমতার সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে।
সিমুলেশন ও সিমুলাক্রাসিমুলেশন শব্দটা আগেই উল্লেখ করেছি। বোদ্রিয়াড এই শব্দ দুটোকে দারুণভাবে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। বাস্তবতা, প্রতীক ও সমাজ–এদের মধ্যে সম্পর্ক বোঝাতে তিনি শব্দ দুটো ব্যবহার করেন। সম্ভবত ১৯৭০ সালের দিকে প্রথম এই শব্দ ব্যবহৃত হয়। সিমুলেশন হচ্ছে বাস্তব জগতের অনুকরণকৃত একটা প্রক্রিয়া। শ্রোতা বা দর্শক মিডিয়া বা গণমাধ্যমের প্রতিনিধিত্বকে যেভাবে উপলব্ধি করে। অন্যদিকে সিমুলাক্রা হচ্ছে মূল বিষয়ের কপি। এটি মূল চিত্রের অনুকরণকৃত। বোদ্রিয়াড বলছেন, নকল আইফেল টাওয়ার কিংবা স্ট্যাচু অব লিবার্টি আমাদের কাছে এমনই নকল চিত্র তুলে ধরে। এটাই তাঁর মতে সিমুলাক্রা। বোদ্রিয়াড দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেন, আমাদের সমাজ এখন এতো পরিমাণ মডেল বা মানচিত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে যে তাতে আমরা বলতেই পারি মডেল বা মানচিত্র প্রকৃত জগতের পূর্বগামী হয়ে পড়েছে। বাস্তবতা এখন শুধু ওই মডেলের অনুসরণ করে মাত্র! অর্থাৎ কোনো একটা জায়গা বা অঞ্চল তার মানচিত্রের অনুগামী; এ যেন রামের জন্মের আগেই রামায়ণ রচনার মতো ব্যাপার।
Advertisement
বিষয়টাকে তিনি মনে করছেন না যে এটা একটা অনুকরণ বা প্রতিবিম্বকরণ অথবা প্যারডি বরং এটা বাস্তবের চিহ্ন যা বাস্তব থেকে অধিক বাস্তব। বোদ্রিয়াড মনে করেন উত্তর-আধুনিক সংস্কৃতি হচ্ছে কৃত্রিম। কারণ প্রাকৃতিক ও কৃত্রিমতাকে আলাদা করার মতো আমাদের সামর্থ নেই। তিনি সিমুলাক্রার দুটো ধাপের কথা উল্লেখ করেনঃ প্রথম ধাপ হিসেবে তিনি প্রি-মডার্ন সময়ের ইঙ্গিত দিয়েছেন যেখানে ইমেজ বা প্রতিরূপায়ণকে মনে করা হতো বাস্তবের নকল। সেখানে ইমেজকে ধরা হতো এক ধরনের অধ্যায় হিসেবে। কিন্তু দ্বিতীয় পর্বের সিমুলাক্রা যেটা কি না ইউরোপের উনিশ শতকের শিল্প বিপ্লবের পরে মানুষের মনোজগতে প্রভাব ফেলেছে। সেখানে ইমেজ ও তার প্রতিরূপায়ণের মাঝে পর্দা উঠে গেছে। কারণ এই সময়ে ব্যাপক শিল্প উৎপাদন ও তার বৈজ্ঞাপনিক বিস্তার পণ্যের ধারণা পাল্টে দিয়েছে। তবে তখনো মানুষের মন থেকে বাস্তবতার ধারণা উবে যায়নি। কিন্তু তৃতীয় পর্বে এসে সিমুলাক্রার এই ধাপে বাস্তবতার থেকে বেশি বাস্তব হয়ে উঠেছে প্রতিনিধিত্বকারী গল্প! জীবনানন্দের ‘স্বপ্নের হাতে’র মতো হয়তো বলতে ইচ্ছে করছে—পৃথিবীর বাধা—এই দেহের ব্যাঘাতেহৃদয়ে বেদনা জমে; স্বপনের হাতেআমি তাইআমারে তুলিয়া দিতে চাই।যেই সব ছায়া এসে পড়ে দিনের রাতের ঢেউয়ে—তাহাদের তরেজেগে আছে আমার জীবন;সব ছেড়ে আমাদের মনধরা দিতো যদি এই স্বপনের হাতেপৃথিবীর রাত আর দিনের আঘাতেবেদনা পেত না তবে কেউ আর—থাকিত না হৃদয়ের জরা— সবাই স্বপ্নের হাতে দিতো যদি ধরা।
সেই স্বপ্নের হাতে পরাবাস্তব যুগে আমরা সবাই দিলাম ধরা! বোদ্রিয়াড উত্তর-পর্বের এই জীবনে বাস্তবতা ও সিমুলাক্রার ভেতর পার্থক্য দেখাতে কয়েকটা জায়গা চিহ্নিত করেন, যেমন- মিডিয়া কালচার, বিনিময় মূল্য, বহুজাতিক পুঁজিবাদ, নগরায়ন কিংবা ভাষা ও আদর্শ। আমরা সমকালে যেসব মিডিয়ার সাথে পরিচিত যেমন- ইন্টারনেট, টেলিভিশন, ফিল্ম বা ম্যাগাজিন–এসব মাধ্যম শুধু ঘটনার নির্মোহ বর্ণনাই দিচ্ছে না বরং এগুলো আমাদের জীবনের একান্ত বারান্দায় ঢুকে পড়ে আমাদের ইচ্ছেগুলো বের করে আনছে। আর এর ফলে একটা বাণিজ্যিক ইচ্ছে তৈরি করে আমাদের জীবনকে সাংঘাতিক প্রভাবিত করছে। আমরা পুঁজিবাদী সমাজ বাস্তবতায় দেখেছিলাম কোনো বস্তুর মূল্য নির্ধারিত হয় তার ব্যবহার মূল্যের পরিবর্তে প্রকৃত মূল্যের ওপর। কিন্তু এই পর্বে এসে আমরা দেখলাম পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হচ্ছে তার বিনিময় মূল্য বা উপযোগিতার মূল্যের ওপর। বোদ্রিয়াড পরিষ্কার করে ঘোষণা দিচ্ছেন, এখন আমরা এই উপযোগী মূল্যের ধারণা হারিয়ে ফেলেছি। এখন সবকিছু পুঁজি। একসময় ভাবাদর্শকে মনে করা হতো বস্তুর আড়ালে লুকিয়ে থাকা চিন্তাবোধ যা একটা মিথ্যা চেতনা তৈরি করে। অর্থাৎ বস্তুর আগে চেতনার কোনো জায়গা নেই, অন্তত মার্কসবাদে তাই ধারণা করা হতো। কিন্তু বোদ্রিয়াড উল্টে দিলেন সে ধারণা। বললেন, উত্তর-পর্বের জীবনে আমাদের আদর্শ আমাদের বাস্তবতাকে নির্ধারণ করে দেয়। প্রতিটা বাস্তবতা নির্ধারিত হয়ে পড়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। একটা গ্লাসে অর্ধেক জল থাকলে আপনি অর্ধেক খালিও বলতে পারেন, অর্ধেক ভর্তিও পারেন বলতে। এটাকে তাঁর নিজের ভাষায় বলা যেতে পারে, ‘Because we are so reliant on language to structure our perceptions, my representation of reality is always already ideological, always already constructed by simulacra’.
হাইপার রিয়েলিটিবোদ্রিয়াডের হাইপার রিয়েলিটির ধারণা তাঁর বিখ্যাত সিমুলাক্রার তত্ত্বের মতন। নির্ভেজাল সিমুলাক্রাই হলো হাইপার রিয়েলিটি। তত্ত্বটা হলো, সিমুলাক্রা কোনো সময় সত্যকে গোপন করে না বরং সত্যই গোপন করে যে সেটা সেখানে নেই। সিমুলাক্রাই সত্য। এটা যেন, ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি ঘটে যা তা সব সত্য নয়’র মতন। বিষয়টা একটু গোলমেলে লাগলেও একটু পরে পরিষ্কার হবে। আসলে হাইপার রিয়েলিটি দিয়ে বোঝাতে চাইছেন যে আমরা যে জগতে বাস করি সেটা আদতে একটা সত্যের প্রতিনিধিত্বকারী জগৎ। মানে আপনি আমি যে জগতে বাস করি তা আর অন্য কিছুই নয় যা আমাদের মিডিয়া বা রিপ্রেজেন্টেশিন প্রকাশ করে তা ছাড়া। আমার মাথার ভেতর যে বোধ কাজ করছে তা ওই মিডিয়ার তৈরি। যেমন বাংলাদেশের মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করা হচ্ছে যে, এই দেশের স্বাধীনতা ছিল অর্থহীন! কারণ ভাত কাপড়ের কোনো নিশ্চয়তা নেই এখানে। ছোট্ট একটা শিশুকে দশটা টাকা দিয়ে বলানো হচ্ছে এসব কথা। বাংলাদেশের বাস্তবতা আর মিডিয়ার মাধ্যমে উপস্থাপিত বাংলাদেশের চিত্র এ দুয়ের পার্থক্য বুঝতে হবে যেখানে প্রকৃত চিত্র বেমালুম গায়েব করা হয়েছে। প্রতিদিন আপনি রাশিয়া আর ইউক্রেন যুদ্ধের যে খবর পাচ্ছেন সেগুলো পশ্চিম মিডিয়া থেকে পাওয়া। বোদ্রিয়াড স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, যাকে আমরা বাস্তব বলছি তা হচ্ছে একটি যুগের কিছু চিহ্নের পরিবর্তন। তিনি দাবি করছেন, ১৯৯০ সালে উপসাগরীয় যে যুদ্ধ হয়েছিল সেটা মিডিয়ার বানানো। মিডিয়া যুদ্ধের যে রূপ দিয়েছে মানুষ সেটাই বিশ্বাস করেছে।
একটা ছোট্ট চুটকি মনে পড়ছে। আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিক তত্ত্ব বিশ্ববাসীর কাছে বুঝিয়ে যাচ্ছেন সেখানে গিয়ে গিয়ে। একবার যেখানে যাচ্ছেন; সেখানে আইনস্টাইনকে সরাসরি কেউ দেখেনি। ইতোমধ্যে শুনে শুনে আইনস্টাইনের ড্রাইভারও আপেক্ষিক তত্ত্বের মূল বিষয়বস্তু জেনে গেছেন। তাই ড্রাইভার আইনস্টাইনকে অনুরোধ করলেন, স্যার আপনাকে তো এখানে কেউ চেনে না আর আমিও আপেক্ষিক তত্ত্বের বিষয়বস্তু বুঝে গেছি। কাজেই এবারের মতো আমি আপনার হয়ে বক্তৃতাটা দিতে চাই। যদি বক্তৃতাটা ড্রাইভার দিতো এবং লোকজন ড্রাইভারকে আইনস্টাইন হিসেবে জানতো। তাহলে ওই লোকজনের কাছে বিষয়টাই হতো হাইপার রিয়েল। বোদ্রিয়াড আদতে এটাই বলতে চাইছেন, আমরা এমন একটা সমাজে এখন বাস করি; যেখানে সবকিছু আসলের প্রতিনিধিত্ব করা বস্তুকেই আসল হিসেবে জানি। বোদ্রিয়াড গভীরভাবে নিরীক্ষণ করে বলেছেন, বর্তমান বিশ্বটা একটা সিমুলাক্রার বিশ্ব। আমরা ডিম কিনতে গিয়ে যেমন সন্দেহ করি, এ ডিম আসল নাকি নকল! চাল কিনতে গিয়েও সন্দেহ চাল পাস্টিকের নয় তো! প্রায় প্রতিটা জিনিস কিনতে আমাদের এখন সন্দেহ হয়। কী সন্দেহ হয়? সন্দেহ হয় আমরা নকল যুগে বাস করছি। মানে নকল আর ফাঁপার যুগ। ঠিক এরকম না ভাবলেও বোদ্রিয়াড মনে করেন, সত্যটা নকল পরিবেশনার ভিড়ে তলিয়ে গেছে। এর ফলে আসল আর নকলের পার্থক্য করা সম্ভব নয়। এসব বলতে বলতে বোদ্রিয়াড সবচেয়ে বিতর্কিত একটা মন্তব্য করে বসেছেন উপসাগরীয় যুদ্ধ নিয়ে। তিনি মনে করতেন, উপসাগরীয় যুদ্ধ হচ্ছে মিডিয়ার সৃষ্টি যা ঠিক আসল যুদ্ধ নয়।
বোদ্রিয়াড তাঁর বই সিমুলাক্রা অ্যান্ড সিমুলেশনসে চিহ্নের চারটা ঐতিহাসিক পর্বের কথা উল্লেখ করেছেন। বিশ শতকের ইংরেজ পেইন্টার লরেন্স স্টিফেন লরির (১৮৮৭-১৯৭৬) চিত্রকর্মে সে সময়ের ইংরেজ একঘেয়েমি জীবনের চিত্র ফুটে উঠেছে। এটা একটা মৌলিক বাস্তবতা। এটাকে একটা বিশেষ পর্ব হিসেবে চিন্তা করা যেতে পারে, যেখানে জীবনের প্রতিচ্ছবি অবিকৃতভাবে উপস্থাপিত। ভিক্টোরিয়ান চিত্রশিল্পী জন অ্যাটকিনসন গ্রিমসো (১৮৩৬-১৮৯৩) লিভারপুল এবং হালের জীবনযাত্রার ছবি ফুটিয়ে তুলেছিলেন ভীষণ বিকৃতভাবে। তিনি তাঁর চিত্রকর্মের মাধ্যমে এই দুটো অঞ্চলের মানুষের জীবনকে ভীষণভাবে রোমান্টিসাইজড ও আনন্দময় করে তুলির আঁচড়ে তুলে ধরেছিলেন যেটা ছিল সত্যের একেবারে উল্টো। কারণ সে সময় এখানের মানুষের জীবন ছিল বেশ নিরানন্দ ও দুর্দশায় ভরা। বোদ্রিয়াড তৃতীয় ধাপে বলেছেন, বাস্তবতা বলে কিছু নেই। এটাকে যখন রিপ্রেজেন্ট করা হয়েছে তখন বাস্তবতাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। বিশ শতকের বেলজিয়ান আর্টিস্ট রেনে ম্যাগ্রিথের চিত্রকর্ম এর একটা অনন্য ভাষ্যকার। তাঁর ইডিওসিংক্রেটিক প্রবণতা ছিল সুরেরিয়েলিস্টের মতন। তিনি যেটা প্রকাশ করেছেন তাঁর চিত্রকর্মে সেটা বাস্তব নয়। চতুর্থ ধাপ হিসেবে বোদ্রিয়াড বলছেন বাস্তবতা ও তার প্রতিনিধিত্বের মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই। আমেরিকান শিল্পী মার্ক রথকোর চিত্রকর্ম দেখলে বোঝা যাবে তাঁর চিত্রের ভেতর বিমূর্তে ভরা। আগামাথা কিছু বোঝার উপায় নেই। যা আছে তা চূড়ান্ত আবেগীয় ভাবনার এক নিখুঁত বহিঃপ্রকাশ। এক্সপ্রেশনালিজম ও সুরেরিয়েলিজমের এক অদ্ভুত মিশ্রণে গড়ে ওঠা ক্যানভাস।
বোদ্রিয়াড মনে করেন, পশ্চিমা সমাজ এই চতুর্থ ধাপের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করছে। এই হাইপার রিয়েলের পর্বে ইমেজ বা সিমুলেশনের আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়। উৎপাদনের এই যুগে দেখা যাবে প্রোডাকশনের আগেই সব বিক্রি হয়ে গেছে। ডেভেলপারের কাছ থেকে হরেক রকম চাকচিক্যের ছবি দেখে যে ফ্ল্যাট আপনি কিনেছেন, তার হয়তো জমিই কেনা হয়নি, অথচ বিক্রি শেষ! বাড়িতে এখন পাঁচ-দশ জন লোক থাকলে দেখবেন কেউ কারো সাথে কথা বলছে না, সবাই ব্যস্ত অন্যদের সাথে চ্যাটিংয়ে। অন্য যারা তারা হয়তো কেউ কাউকে চেনেই না। অর্থাৎ এক অজানা নকল সম্পর্কের ভেতর মানুষ বুঁদ হয়ে আছে। সামনে যে আছে সে তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না। ইন্টারনেটের চ্যাটিং রুমে নতুন সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে ভেঙেও যাচ্ছে। কাজেই এই ভার্চুয়াল বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে বাস্তব থেকেও বেশি শক্তিধর। তাহলে স্বাভাবিকভাবে একটা প্রশ্ন এসে যায়, আমরা কি একটা বাস্তবতাহীন জগতের কানাগলির ভেতর ঢুকে পড়লাম? বোদ্রিয়াড যখন একথা বলেন, তখন সন্দেহটা আরও ঘনিভূত হয়। তিনি বলছেন, ‘We live in a world where there is more and more information, and less and less meaning’.
উপসংহার শেষ করি কয়েকটা বিষয় দিয়ে। বর্তমান গোটা দুনিয়া ভেঙে পড়েছে একটা অধিবাস্তব অধরা অস্পর্শের নাভিমূলে। এটা এমন একটা দুনিয়া যেটা মানুষের কাছে ছিল অকল্পনীয়, অভাবনীয় ও স্বপ্নালু। জাঁ বোদ্রিয়াড এটাই বলতে চেয়েছেন তাঁর হাইপার রিয়েলিটির গল্পে যে, আমরা এখন আর রিয়েল আর আন-রিয়েলের পার্থক্য করতে ভুলে গেছি। গোটা দুনিয়া যেমনি ছোট হয়ে গেছে ঠিক তেমনি মানুষের আবেগ ও বিস্ময় বলে কিছু নেই। একটা শিশু এখন আর বিস্মিত হয় না। তাঁর হাতের ভেতর ছোট্ট একটা স্মার্ট ফোনে তামাম দুনিয়া! তাজমহল দেখতে গিয়ে এখন আর মানুষ বিস্ময় প্রকাশ করে না। কারণ সে আগেই সব আশ্চর্যের সীমানা ডিঙিয়েছে। রংধনুর সাতটা রং যেমন শুরু আর শেষ হয়, একটা রঙের শেষের দিকে আরেকটা রং যেভাবে শুরু হতে থাকে ঠিক তেমনি রিয়েল আর আনরিয়েলের বিভাজন করা আজকে অসম্ভব। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি গিলে খেয়েছে বড় আদরের সম্পর্কগুলো। তাই সত্য সম্পর্কে চরম সন্দিহান হয়ে বোদ্রিয়াড বলে ফেলেছেন, ‘The secret of theory is that truth does not exist.’
লেখক: অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
এসইউ/জেআইএম