বেকারত্ব বাংলাদেশের বড় বড় সমস্যা গুলোর মধ্যে একটি যা ক্রমবর্ধমান এবং প্রকট। যার পেছনের কারণগুলো কমবেশি সবার জানা। কিন্তু এমন অনেক কারণ আরও আছে যেই কারণ গুলো হয়তো আমরা জানিনা বা জেনে থাকলেও সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামাই না। এই লেখার মাধ্যমে বেকারত্বের সেসব কারণগুলো একটু দেখার চেষ্টা করব এবং বোঝার চেষ্টা করব যে এটা কি কোনো বাস্তব সমস্যা নাকি অজুহাত!
Advertisement
প্রথমে ধরে নেই বেকারত্ব একটি বাস্তব সমস্যা। কিছু যুক্তির মাধ্যমে এটিকে দাঁড় করানো যায়। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর একটি প্রতিবেদনের তথ্য মতে, বাংলাদেশ গত নভেম্বরে বেকারত্বের হার পৌঁছেছে ৬ দশমিক ৯১ শতাংশে যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বকালের সর্বোচ্চ। ২০১৭ অর্থবছরে এ সংখ্যা ছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২১ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৪৭ শতাংশে।
বেকারত্বের এই হারের পেছনে বেশ কিছু কারণ দেখানো হয়েছে, যেমনঃ • কাঁচামালের ঘাটতিতে শিল্পখাতে অস্থিতিশীলতা • গ্যাস বিদ্যুত জ্বালানি উচ্চমূল্যের কারণে ব্যবসা খরচ বেড়ে যাওয়া এবং • বিশেষজ্ঞদের মতে কোভিডের ধাক্কার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নেতিবাচক প্রভাবে ভোক্তাদের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে চাকরির ক্ষেত্র তৈরির ক্ষেত্রে সংকট।
করোনা বাংলাদেশের বেকারত্ব তৈরির ক্ষেত্রে একটা বিশাল অবদান রেখেছে। করোনার ধাক্কায় শুধু ২০২০ সালেই বাংলাদেশে কাজ হারিয়েছে প্রায় দেড় কোটি মানুষ, যাদের মধ্যে ৭২ শতাংশ মানুষ তাদের কাজ ফিরে পাননি অর্থাৎ সমাজের একটি বিশাল জনসংখ্যা বেকার হয়েছে শুধু করোনার সময়টাতেই।
Advertisement
আবার ফিরে আসি সংখ্যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর একটি জরিপে জানা গেছে বাংলাদেশে বর্তমানে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী ১২.২৮ মিলিয়ন তরুণের মধ্যে বেকার রয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। ২ মে ২০২৩ এ প্রকাশিত বিবিএসের একটি জরিপ মতে বাংলাদেশে বর্তমানে বেকার সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার। যেখানে গত তিন মাসে বেড়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার।
এবার আসি একটি মজার কথায়। গত ২৯ মার্চ রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ভবনে বিবিএসের আয়োজিত “শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২” এর একটি আলোচনা সভায় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন ‘বর্তমানে যে ব্যক্তি সপ্তাহে এক ঘন্টা কাজ করে না তাকে বলা হয় বেকার।’সপ্তাহে এক ঘন্টা কাজ করে এমন ব্যক্তিকে বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী বেকারত্বের ওই তালিকা থেকে বাইরে রাখা হয়েছে অর্থাৎ সপ্তাহে এক ঘন্টা কাজ করেনা এমন ব্যক্তির সংখ্যা বাংলাদেশে বর্তমানে ২৫ লাখ ৯০ হাজার। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বেকারত্বের জন্য কি শুধুই উপরোক্ত তিনটি কারণ দায়ী?
এবার একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করা যাক। একটা জরিপে দেখা গেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৭০% থাকে বেকার। কিন্তু কেন? উত্তরটা হলো, আমাদের দেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলোর প্রয়োগ চাকরির ক্ষেত্রে তেমন একটা দেখা যায় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে সংস্কৃত, পালি, ইসলামের ইতিহাস, এমনকি বাংলা বা ইংরেজি ইত্যাদি বিষয় গুলোর কথা। এই বিষয়গুলো নিয়ে পড়ে কেউ খুব ভালো নাম্বার নিয়ে পাস করলেও বিষয়গুলোর প্রয়োগ চাকরির ক্ষেত্রে যেহেতু কম সেহেতু এই বিষয়ে পাস করা শিক্ষার্থীদের একটি সংখ্যা থেকে যাচ্ছে বেকার।
একটি জরিপে দেখা গেছে আমাদের দেশে বেকার যুবকদের ৬২% ব্যবসায় প্রশাসন ছাড়া অন্যান্য বিভাগের। এখন প্রশ্ন হতে পারে তাহলে উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো থেকে পড়বো না? অবশ্যই, যে কেউ চাইলেই সে বিষয়গুলো পড়তে পারেন চর্চার ক্ষেত্রে চাকরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তা আছে এমন কোনো বিষয়ের পাশাপাশি কিন্তু আপনি এমন বিষয়ে তিন থেকে চার বছরের স্নাতক বা ১/২ বছরের স্নাতকোত্তর কেন করবেন যার কর্মক্ষেত্রই আপনার দেশে নেই বা থাকলেও খুবই সামান্য? তবে অর্থোপার্জন যদি আপনার জীবনের লক্ষ্য না হয়ে থাকে তাহলে ভিন্ন বিষয়।
Advertisement
অপরদিকে, টার্গেটবিহীনভাবে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর করে চাকরির ক্ষেত্র খুঁজে না পেয়ে ঘরে বসে থাকা বেকারত্বের একটি বড় কারণ। আর এটার জন্য শুধু নিজেরাই দায়ী। অর্থাৎ, বেকারত্ব এক্ষেত্রে ব্যক্তিপর্যায়ের সমস্যা।
এবার আসি বিসিএস প্রেমিকদের প্রসঙ্গে। বাংলাদেশ তরুণদের মধ্যে এক বড় সংখ্যক বিসিএস প্রেমিক। গ্রাজুয়েশনের পর বিসিএস এর প্রস্তুতি নিতে শুরু করে বা বিভিন্ন সরকারি চাকরির প্রস্তুতির জন্য শৈশবকালে মুখস্ত বিদ্যা চর্চা করতে শুরু করে। বিসিএস এর পেছনে ছুটতে ছুটতে কখন জীবনের পাঁচ-ছয় বছর পেরিয়ে যায় সেই হিসাবও পরে করবার সময় পায় না এবং এই পাঁচ থেকে ছয় বছর সে থাকে স্বেচ্ছায় বেকার। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও বেকারত্ব কৃত্তিম বা ব্যক্তিপর্যায়ের।
এদিকে আবার সরকারি ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা না দেখে যখন মুখস্তবিদ্যাকে চরম মূল্যায়ন করা হচ্ছে সেখানে বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রগুলোতে চাওয়া হচ্ছে অভিজ্ঞতা। বেশিরভাগ বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে চাওয়া হয়ে থাকে ন্যূনতম দুই বছরের অভিজ্ঞতা। এখন কথা হচ্ছে যেই ছেলে বা মেয়ে বিসিএসের পেছনে জীবনের পাঁচ থেকে ছয় বছর দৌড়ে ব্যর্থ হলো সে যখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির চেষ্টা করছে এবং সেখান থেকেও ফিরছে খালি হাতে। দক্ষতার অভাব অথবা সরকারি ও বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রগুলোতে চাকরি পাওয়ার যোগ্যতার রিকুয়ারমেন্ট এর অসামঞ্জস্যতা বেকারত্বের জন্য দায়ী চরমভাবে। যেটিও একটি কৃত্রিম সমস্যা এবং মানব সৃষ্ট।
বাংলাদেশের ব্যক্তিপর্যায় থেকে কৃত্রিম বেকারত্বের আরেকটি অন্যতম কারণ হলো আমাদের দেশের শিক্ষিত বেকার যুবকদের মধ্যে নাক সিঁটকানো স্বভাবটা। ব্যাখ্যা করে বলি। চাকরির ক্ষেত্র ছাড়াও বাংলাদেশে ২টি উন্নয়নশীল খাত আছে যেখানে প্রচুর দক্ষ জনবল দরকার। খাত দুটি হল- উৎপাদন ও কৃষিশিল্প। কিন্তু আমাদের দেশের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের মতে এই কাজগুলো করে অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত বা অশিক্ষিত মানুষ।
শিক্ষিত হয়ে তারা কৃষিখাতে কাজ করাকে নিজেদের জন্য অপমানসূচক মনে করে। যেখানে বাংলাদেশ কৃষি খাতে বিশ্বের মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থানে রয়েছে। ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচার এর তথ্য মতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৫ কোটি ২৯ লাখ টন চাল উৎপাদন করে বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ স্থানে আছে। ইলিশ রপ্তানিতে প্রথম, রেডিমেড গার্মেন্টসে দ্বিতীয় আর সবজি উৎপাদনে তৃতীয়। উৎপাদনশীল খাতে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে শুধু শিক্ষিত তরুণদের অনাগ্রহের কারণে। এই অনাগ্রহ বেকারত্বের জন্য ব্যক্তিপর্যায়ে থেকে দায়ী।
আমরা যদি একটু অন্য দেশের কথা চিন্তা করি আমরা দেখতে পাই যে আমেরিকা-কানাডার মত দেশেও প্রচুর শিক্ষিত যুবক রেস্টুরেন্টে, হোটেল কিংবা ফার্মিং এর কাজগুলো করছে। এতে একদিকে সেসব দেশের উন্নতি ও যেমন হচ্ছে তেমনি বেকারত্বও ঘুচছে।
একটি তুলনামূলক চিত্র যদি দেখি বাংলাদেশের গ্রাজুয়েট করা বেকার আছে ৪৭%, আমেরিকাতে এই সংখ্যা ৪ দশমিক ১ শতাংশ, কানাডাতে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ, প্রতিবেশী দেশ ভারতেও এই সংখ্যা বাংলাদেশের থেকে কম, মাত্র ৩৩ শতাংশ, নেপালে ২০%, শ্রীলঙ্কায় ৭.৮%। কাজের প্রতি অনীহা বাংলাদেশের এই শতাংশের পেছনে বিশাল ভাবে দায়ী, যেটি একটি কৃত্রিম সমস্যা।
একটি মজার কথা, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ এ প্রকাশিত দ্য ডেইলি স্টারের একটি তথ্যমতে, ফেসবুক ব্যবহারকারীদের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ অতিমাত্রায় বিনোদনপ্রেমী এই তথ্য তাই প্রমাণ করে। বিনোদনের পেছনে তারা যে সময়টা ব্যয় করে সেই সময়ের অর্ধেক সময় যদি তারা self-development এর ক্ষেত্রে তাহলেও দক্ষতাভিত্তিক যে কোনো কাজ শুরু করে ফেলতে পারতো। একটি ছোটখাটো ব্যবসাও দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারত। এরফলে তাদের আর বেকার থাকতে হত না।
আমরা কমবেশি সকলেই জানি বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সিংয়ের কিছু ক্ষেত্র রয়েছে যার মাধ্যমে বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করা যায়। খুব সহজেই চর্চার মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করে অর্থ উপার্জনের একটি সহজ উপায় ফ্রিল্যান্সিং। দক্ষতা বৃদ্ধির পেছনে সময় না দিয়ে বিনোদনের পেছনে সময় নষ্ট করা হচ্ছে সেটা বেকারত্বের বড় একটা কারণ। বিডি জবসের সিইও ফাহিম মাশরুর একবার জানিয়েছিলেন চাকরির বাজারে যে ধরনের চাকরি আছে সেই ধরনের মানুষ তারা পান না আবার বলছেন প্রতিবছর যে ধরনের মানুষ চাকরির বাজারে যুক্ত হচ্ছেন সেই উপযোগী চাকরি নেই।
এর পেছনের কারণ দুটি হতে পারে। একটি ওই যে বিষয়সংক্রান্ত ব্যাপারটা বললাম যে চাকরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তা কম এমন বিষয়ে পড়া আবার আরেকটি কারণ হতে পারে প্রচলিত মজুরিতে কাজ করার অনীহা। অর্থাৎ দক্ষতার অভাব অথবা অনীহা এই কারণেও চাকরির ক্ষেত্রে যেমন শূন্যতা তৈরি করছে তেমন বাড়ছে বেকারত্ব। এটিও একটি কৃত্রিম ব্যক্তিপর্যায়ে সমস্যা।
যেহেতু ব্যক্তিপর্যায়ের, এ সমস্যার জন্য একজন ব্যক্তি বা কিছু ব্যক্তি দায়ী দেখা যাচ্ছে কিছু অল্পসংখ্যক আর্থসামাজিক সমস্যা থেকে বেকারত্বের জন্য দায়ী। উপরে উল্লেখিত যে সমস্যাগুলো সমাধান একবারে ব্যক্তিপর্যায়ে থেকে সম্ভব কিন্তু বাংলাদেশের বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে আর উপরোক্ত সমস্যাগুলো সমাধান অতিদ্রুত না করে নানান কারণে বেকারত্ব দেখাতে থাকলেই সমস্যা একসময় নাগালের বাইরে চলে যাবে বৈ কি।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।
এইচআর/এএসএম