ফিচার

সাদা ইঁদুর যখন পোষাপ্রাণী

ইঁদুরের জ্বালাতনে অতিষ্ট হ্যামিলন শহর আর ‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’র গল্প নিশ্চয়ই মনে আছে? সিনেমা এবং কার্টুনে ইঁদুরকে দেখানো হয় ভয়ংকর এবং ঘৃণ্য প্রাণী হিসেবে। ইঁদুরকে মানুষ ভয় পায়। কিছুটা অবহেলায় এড়িয়ে চলে। মানুষের সঙ্গে ইঁদুরের লড়াই বহু বছরের পুরোনো। সম্ভবত নব্য প্রস্তর যুগ থেকে চলে আসছে এই লড়াই। এই দুই প্রজাতি সব সময় পরস্পরকে ধ্বংস করে ফেলতে চেয়েছে। উজাড় করে দিতে চেয়েছে পৃথিবীর বুক থেকে। কিন্তু পরিহাস, তারা বসবাসও করছে সবচেয়ে পাশাপাশি, বলতে গেলে গলায় গলায়। ইঁদুর মানুষকে ধ্বংস করতে চেয়েছে নানা রকম রোগ ছড়িয়ে। ইতিহাসে অন্তত দুবার প্লেগের কবলে পড়ে মানবজাতির প্রায় উজাড় হওয়ার দশা হয়েছিল। প্লেগ ছাড়াও আরও বিচিত্র রকম রোগ শরীরে নিয়ে ঘোরাফেরা করে ইঁদুর। ময়লা নর্দমার কিলবিল করা ১৮ রকমের প্রাণঘাতী ব্যাকটেরিয়া শরীরে বয়ে আনে ইঁদুর। রাতের অন্ধকারে পানির পাইপ বেয়ে উঠে এসে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দেয় সেই জীবাণু। মানুষের বিরুদ্ধে ইঁদুরের এটাও এক প্রতিশোধ বটে! ইঁদুর বিভিন্ন রোগের বাহক হলেও সব ইঁদুর রোগের বাহক নয়। সব ইঁদুর জ্বালাতন করে না। কিছু ইঁদুর মানুষের গবেষণার কাজেও সহযোগিতা করে। পরীক্ষাগারে গবেষণার সময় প্রায়ই ব্যবহৃত হয় এমন জীবন্ত প্রাণীর মধ্যে ইঁদুর একটি। অতএব কখনো কখনো ইঁদুর মানবতার কাছে অনেক কিছু বোঝায়।

Advertisement

আদিকাল থেকেই প্রাণীদের সাদা পশম থাকাকে শুদ্ধি এবং পুণ্য বোঝায়। সাদা ইঁদুর হলো সাদা এবং ধূসর বর্ণের একটি গৃহপালিত প্রাণী। এদের চোখ জোড়া থাকে টুকটুকে লাল রক্তবর্ণ। বর্তমানে সাদা ইঁদুর পোষাপ্রাণীদের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। আঠারো শতকে জাপানিরা সাদা ঘরোয়া ইঁদুরের প্রতি ছিল ব্যাপক কৌতূহলী। জাপানে ইঁদুর ঘরে পোষা হতো এমনকি যত্নও করা হতো। পরে এসব সাদা ইঁদুর ইউরোপ এবং আমেরিকায় আনা হয়। এরপর এর নাম হয়ে যায় অ্যালবিনো ইঁদুর। সহজ ভাষায় যা সাদা ইঁদুর হিসেবে পরিচিত। এসব ইঁদুর সাদা কেন? গবেষকরা বলেন, সাদা ইঁদুর বা অ্যালবিনো ইঁদুরের শরীরে মেলানিন উৎপাদন করার ক্ষমতা নেই।

আরও পড়ুন: কফি পান করতে ভালো লাগে কেন?

বাহ্যিকভাবে, ঘরে পোষা সাদা ইঁদুর আর বুনো ইঁদুরের রঙের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য এবং অভ্যাস ভিন্ন ভিন্ন। উপযুক্ত এবং অনুকূল পরিবেশে একজোড়া প্রাপ্তবয়স্ক বুনো ইঁদুর থেকে এক বছরে ইঁদুরের বংশ বৃদ্ধি পেয়ে দুই হাজার থেকে তিন হাজারটি হতে পারে। একটি স্ত্রী ইঁদুরের বয়স তিন মাস পূর্ণ হলে বাচ্চা দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করে। বাচ্চা প্রসবের পর দুই দিনের মধ্যেই স্ত্রী ইঁদুর পুনরায় গর্ভধারণ করতে পারে। এদের গর্ভধারণ কাল প্রজাতিভেদে ১৮-২২ দিন হয়ে থাকে। সারাবছরই বাচ্চা দিতে পারে। তবে বছরে ৫-৭ বার এবং প্রতিবারে ৬-১০টি বাচ্চা জন্ম দিয়ে থাকে। মা ইঁদুর এদের যত্ন বা লালন-পালন করে থাকে। এদের ১৪-১৮ দিনে চোখ ফোটে। চার সপ্তাহ পর্যন্ত মায়ের দুধ পান করে এবং তিন সপ্তাহ পর থেকে শক্ত খাবার খাওয়া শুরু করে। পাঁচ সপ্তাহ পর থেকে এরা মায়ের সঙ্গ থেকে আলাদা হয়ে যায়। একটি ইঁদুরের জীবনকাল সাধারণত দুই-তিন বছর হয়ে থাকে।

Advertisement

সাদা ইঁদুর দেখতে আশ্চর্যজনক হলেও কোনো গন্ধ ছড়ায় না, যেমনটি অন্য অনেক পোষাপ্রাণীর ক্ষেত্রেও হয়। সাদা পুরুষ ইঁদুরের ওজন গড়ে ৪০০ গ্রাম থেকে ৬৫০ গ্রাম পর্যন্ত। স্ত্রী ইঁদুরের ওজন ৩০০ গ্রাম থেকে ৪৫০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। সাদা ইঁদুর রোদের আলো সহ্য করতে পারে না। তাই এরা রাতে বেশি সক্রিয় থাকে আর দিনের বেলা নির্জন জায়গায় লুকিয়ে থাকে। ঘরে পোষা সাদা ইঁদুররা রাতে ঘুমায় এবং কেবল দিনের বেলা জেগে থাকে। তাই তাদের জীবনকাল খুব ছোট হয়। তারা তাদের মালিকদের এক থেকে দেড় বছর পর্যন্ত আনন্দ দিতে পারে। তবে ব্যাপারটি অবশ্যই সঠিক যত্নের সঙ্গে সম্পর্কিত। সাদা ইঁদুর বা অ্যালবিনোস তিন বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারার ঘটনা খুব বিরল। সাদা ইঁদুর তাই দুষ্প্রাপ্য এবং মূল্যবান প্রাণী হিসেবে গবেষকদের কাছে ব্যাপক সমাদৃত। বাজারেও এর চাহিদা ব্যাপক।

আরও পড়ুন: নারীকে আকৃষ্ট করতেই সুগন্ধি ব্যবহার শুরু করেন পুরুষরা

কোনো প্রাণীর জিন থেকে অবিকল আরেকটি প্রাণী তৈরির বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াই হচ্ছে ক্লোনিং। সম্প্রতি জেনেটিক পরীক্ষায় জিন প্রকৌশল প্রযুক্তি প্রয়োগ করে উজ্জ্বল সাদা ইঁদুর জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। নতুন ধরনের ডিএনএ ইঁদুরের শুক্রাণুর মধ্যে প্রবেশ করিয়ে জেনেটিক প্রযুক্তিতে এই সাদা ইঁদুরের জন্ম দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞানীরা নতুন এই জিন প্রকৌশল পদ্ধতির বাস্তব রূপ দিতে এবং উন্নতি ঘটাতেই সাদা ইঁদুরের জন্ম দিয়েছেন। পদ্ধতিটি প্রযুক্তিগত দিক থেকে খুবই সহজ এবং সম্ভাবনাময়। এর সফলতার হার অন্য চলতি জেনিটিক পদ্ধতির চেয়ে অনেক বেশি। নতুন এ পদ্ধতিতে জিনগুলো সরাসরি প্রাণীর দেহে পুশ করা হয়। এই কাজে একটি ভাইরাসের সাহায্য নিয়ে তা প্রবেশ করানো হয়। হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যান্থনি পেরি এবং তার সহযোগীরা হনলুলুতে সর্ব প্রথম সাদা ইঁদুরের এই ক্লোনিং করেন।

ইঁদুরের মতো তীক্ষ্ম দাঁতওয়ালা অন্য একাধিক প্রাণীর ওপর এই ক্লোনিং পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। এই নতুন পরীক্ষায় প্রথমে ইঁদুরের শুক্র হিমাংকের নিচে রেখে জমিয়ে নেওয়া হয়। এরপর তাতে অন্য প্রজাতির প্রাণীর ডিএনএ প্রবেশ করানো হয়। সর্বশেষে পরিবর্তিত এই শুক্র সাদা ইঁদুরের ডিম্বাণুতে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়। এরপর আদর্শ ভ্রুণ প্রতিস্থাপন পদ্ধতিতে ডিম্বাণুগুলোকে স্ত্রী ইঁদুরের দেহে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়। এই ক্ষেত্রে যে জিনটি ইঁদুরের শুক্রাণুতে প্রবেশ করানো হয়েছে; সেটি নেওয়া হয়েছে সামুদ্রিক মাছ জেলিফিস থেকে। এই জিনটির কারণেই সাগরের এই প্রাণীটির দেহের রং চকচকে উজ্জল সবুজ বর্ণের দেখায়।

Advertisement

আরও পড়ুন: ঘণ্টায় ৫৬ কিলোমিটার উড়তে পারে যে মাছ

গবেষকরা জানান, জেলিফিসের জিনটি ব্যবহার করার উদ্দেশ্য হলো জিনটি সফলভাবে সংঘবদ্ধ হয় কি না? ইঁদুরের দেহে এর কার্যকারিতা পরীক্ষিত হয় কি না, তা খতিয়ে দেখা। দেখা যায়, গবেষণাগারে প্রস্তুত করা ৮০ শতাংশেরও বেশি ভ্রুণ এই সাদা জিনকে গ্রহণ করেছে। তবে ভ্রুণগুলোর পাঁচটির ভেতর মাত্র একটি গর্ভাবস্থা পার হতে পেরেছে এবং এদের মধ্যে জেলিফিশের জিনের প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। ক্লোনিংয়ের বর্তমানে যেসব পদ্ধতি চালু রয়েছে, তার মধ্যে এই নতুন পদ্ধতিটির সাফল্যের হার অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে সাফল্যের হার প্রায় বিশ শতাংশ। নতুন এই পদ্ধতিতে জিনগুলো এমনভাবে স্থাপন করা হয় যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বংশধরদের দেহের এই জিন বিদ্যমান থাকে। অর্থাৎ সাদা ইঁদুরের বংশধররাও যেন সাদা হয়।

গবেষকরা বলছেন, ইঁদুরের জিনের সঙ্গে মানুষের জিনের বেশ মিল থাকায় গবেষণার প্রাথমিক ধাপে সাদা অ্যালবিনো প্রজাতির ইঁদুরের বেশ চাহিদা রয়েছে। বায়োলজিক্যাল ও বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সের যে কোনো গবেষণা কাজের প্রাথমিক ধাপে পরীক্ষার জন্য সুইচ অ্যালবিনো প্রজাতির ইঁদুর ব্যবহার করা হয়। তবে বাংলাদেশে শুধু আইসিডিআরবি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সাদা ইঁদুর পালন করা হয়। যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অপ্রতুল। সাদা ইঁদুর পালনে আগ্রহীদের খামার করতে সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলতে পারলে গবেষণা ক্ষেত্রে ইঁদুর আরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। আরও সমৃদ্ধ হতে পারে বাংলাদেশের গবেষণাখাত।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক, গবেষক ও এমফিল স্কলার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এসইউ/এএসএম