টাঙ্গাইলের সখীপুরের কচুয়া গ্রামের আয়েশা আক্তার নামের এক কলেজপড়ুয়া ছাত্রী বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন। আয়েশা সরকারি মুজিব কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন। কতইবা বয়স মেয়েটার? ছবিটা দেখে ভাবছিলাম এমন মায়াভরা মুখের মেয়েটা কেন আত্মহত্যা করতে গেলো? কী তার দুঃখ? এই বয়সী একটা মেয়ে খাবে, ঘুরবে ফিরবে, বন্ধুদের নিয়ে হৈ হুল্লোড়ে মেতে থাকবে। এতো কেন ভারাক্রান্ত হবে তার জীবন?
Advertisement
সংবাদ বিশ্লেষণে জানা গেলো, পরিবার থেকে তার বিয়ের কথা চলছিল। অন্যদিকে সে আরেকজনের সাথে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িত। নিজের পছন্দের বাইরের কারও সাথে বিয়ে করবে না। আয়েশা পড়াশোনা করছিলেন। তার তো এখন বিয়ের পরিকল্পনায় যাওয়ারই কথা ছিল না।
আজকাল মেয়েরা আগে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে শিখে তারপর ব্যক্তিগত জীবনের কথা ভাবে। তাহলে আয়েশার পরিবার কেন মেয়েটাকে এত ছোট বয়সে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিল? একাদশ শ্রেণিপড়ুয়া একজন মানুষের বয়স কী বিয়ের বয়স হয়? বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮। কিন্তু আয়েশার মনে হয় না ১৮ হয়েছিল। এর আগেও ময়মনসিংহে একজন ছাত্রীকে আমরা দেখেছিলাম আত্মহত্যা করতে। পোশাক নিয়ে পারিবারিকভাবে মানসিকভাবে নির্যাতিত ছিল বলেই সে সুইসাইডাল নোটে লিখে গিয়েছিল।
এই যে চারদিকে আমাদের ছোট ছোট বাচ্চা জীবনের প্রতি মায়া হারিয়ে ফেলছে, অতি ক্ষুদ্র সমস্যায় মোকাবিলা করার সাহস অর্জন না করে আত্মহত্যার মতো একটি কঠিন রাস্তা বেছে নিতে পিছ পা হচ্ছে না। এমনকি মৃত্যুর ভয়ও তাদের কাছে তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে- এ বিষয়টি ভেবে দেখার সুযোগ আছে। সমাজে অস্থিরতা বাড়ছে। একদিকে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আসছে কিন্তু সেই সচ্ছলতা আবার সমবন্টিত নয়।
Advertisement
সমাজে ক্রমেই বাড়তে থাকা বৈষম্য আমাদের সন্তানদের মাঝে একধরনের মানসিক দৈন্যতা তৈরি করে দিচ্ছে। আবার অন্যদিকে পারিবারিক বন্ধন, পারিবারিক শিক্ষার সাথে সামাজিক শিক্ষার দূরত্ব সবমিলিয়ে আমাদের পারিবারিক সম্পর্কগুলো কোথায় যেন ক্ষীণ সুতোর মতো হয়ে যাচ্ছে।
সন্তানরা পিতামাতাকে আর ভরসা করতে পারছে না। জেনারেশন গ্যাপ বলে একটা ‘টার্ম’ শুনে অভ্যস্ত কিন্তু এ বিষয়টা কতটা কার্যকর বা এই গ্যাপের ফলাফল সম্পর্কে পিতামাতারা কতটা ওয়াকিবহাল সেটাও বুঝতে হবে। সন্তান কেবল আমার হুকুমের যন্ত্র নয়। তারা যত বড় হয় ততই তাদের ব্যক্তিগত মতামত গড়ে ওঠে। নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ গড়ে ওঠে। ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার কোনো নির্দিষ্ট বয়স নেই।
একজন শিশুরও একটা ব্যক্তিত্ব থাকে। অর্থাৎ সেও কিন্তু কিছু পছন্দ অপছন্দ নিয়েই পৃথিবীর বুকে আসে। হয়তো প্রকাশ করতে পারে না। আর একজন মানবসন্তান যখন বড় হতে থাকে তার চারপাশ থেকে পাওয়া শিক্ষা আর ভিতরে গড়ে ওঠা মানুষটির মাঝে ক্রমশ অন্তর্দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। এই যে দ্বান্দ্বিকতার অবস্থান সেখানেই পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।
একজন সদ্য যৌবনে পা দেওয়া সন্তানের মানসিক চাহিদাকে বুঝতে পারাটাই বিশাল চ্যালেঞ্জ। পুরোনো দিনের শিক্ষা দিয়ে একবিংশ শতকের সন্তান লালন পালন করা যাবে না। সন্তানের স্বাধীনতার জায়গাটিকে নিশ্চিত করতে হবে। পিতামাতা অবশ্যই তাদের পছন্দ অপছন্দকে প্রকাশ করবেন কিন্তু চাপিয়ে দেওয়া যাবে কি? এই যে চাপিয়ে দিতে চাওয়ার মানসিকতা তারই ফলাফল হচ্ছে সন্তানের হারিয়ে যাওয়ার রাস্তাকে প্রশস্ত করে দেওয়া।
Advertisement
পারিবারিকভাবে যদি মতামত প্রকাশের মতো সুযোগ না থাকে সেখানে চাপা অভিমান বা অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবেই। আয়েশারা সেই জেনারেশনের সন্তান যারা নিজের মতো করে চলতে চাওয়ার দাবি নিয়ে বেড়ে ওঠে। ব্যক্তিস্বাধীনতার সীমানা তাদের কাছে অনন্ত মনে হয়। পিতামাতা বা অন্য কারও সেখানে প্রবেশকে তারা ‘রেস্ট্রিক্টেড’ করে রাখে। এই ‘রেস্ট্রিকশন’ অপশন মানেই হচ্ছে প্রাইভেসিতে অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করা।
কিন্তু পরিবারে এই রেস্ট্রিকশন থাকলে কি চলবে? লড়াইটা এই জায়গায়ই। পিতামারাও ভুলটা এখানেই করে। তারা যখনই টের পায় সন্তান তাদের কথা বা আদেশ মতো চলছে না তখনই তারা রাজা প্রজার কনসেপ্টে চলে যায়। মানে হচ্ছে আমি তোমার অভিভাবক তাই তুমি আমার চেয়ে বেশি বুঝবে না।
আমি যেমনটা বলবো তোমাকে ঠিক তেমনটাই মানতে হবে। অন্যথা হলেই সন্তান বেয়াদব। এই যখন পরিবেশ হয়ে যায় তখন সন্তান নিজেকে গুটাতে থাকে। অপ্রকাশিত চ্যাপ্টারের সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রচণ্ড মানসিক চাপ তাদের ধীরে ধীরে হতাশার দিকে ধাবিত করে। আস্থা পায় না তারা। বিশ্বাস করতে পারে না যে একজন ব্যক্তি হিসেবে তার মতকে প্রাধান্য দেওয়ার কেউ আছে।
ব্যক্তিত্বের দ্বান্দ্বিক অবস্থানের কারণের সমাজে আয়েশারা জীবন দেওয়ার মতো ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নিতে দুইবার ভাবছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে। সেখানেও আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখাটা জরুরি। বাবা মা হয়েছি বলেই আরেকজনের জীবনের ১০০ ভাগ দখল নিশ্চিত হয়ে যায়নি। সন্তানদের আপনার হস্তক্ষেপের কারণ যুক্তিসহকারে বুঝাতে না পারলে এবং আপনাকে তাদের জীবনের সব বিষয়ে কথা বলার মতো আস্থাটা তৈরি করতে না পারলে সামনে আরও এমন আয়েশার সংবাদ পাবো আমরা।
তাই আয়েশাদের ভালোবাসা দিয়েই বুঝাতে হবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সবার অংশগ্রহণ বা আলোচনার সুযোগ থাকবে কিন্তু দুপক্ষকেই একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ও যুক্তির জায়গায় হতে হবে মানবিক ও যৌক্তিক। হতাশা, বেদনা, কষ্টবোধ বা মতের বিরোধ আসবেই তাই বলে মূল্যবান জীবন দিয়ে ফেলতে হবে এমন বোকামি করা থেকে বিরত রাখতে সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি নজর রাখার বিকল্প নেই।
লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/এমএস