দেশজুড়ে

বিআরটিএ: ঘুস দিলেই লাইসেন্স মেলে শেরপুরে

ঘুস ছাড়া লাইসেন্স মেলে না বিআরটিএ শেরপুর সার্কেলে। অভিযোগ রয়েছে, টাকা না দিলে সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও অকৃতকার্য দেখানো হয়। দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত মোটরযান পরিদর্শক আবু পলাশ নিজেই তার ভাই বিপুলকে দিয়ে ম্যানেজ করেন দালাল সিন্ডিকেট।

Advertisement

লার্নার (শিক্ষানবিশ) করা থেকে স্মার্ট কার্ড হাতে পাওয়া পর্যন্ত লাইসেন্স ভেদে ১৫ থেকে ২০ হাজার করে টাকা নেয় এই সিন্ডিকেট। টাকা দিলে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয়েও মিলছে লাইসেন্স। এর ফলে পার্শ্ববর্তী জামালপুর, রৌমারী, কুড়িগ্রামের প্রার্থীরাও এখন টাকার বিনিময়ে লাইসেন্স করছেন শেরপুর সার্কেল থেকে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, টাকার বিনিময়ে অদক্ষ চালকের হাতে উঠছে ড্রাইভিং লাইসেন্স, যার কারণে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। অথচ টাকা না দেওয়ায় দক্ষ চালক লাইসেন্স পাচ্ছেন না।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, শেরপুর শহরের আফসর আলী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রতি সপ্তাহের বুধবার হয় লিখিত, মৌখিক ও ফিল্ডটেস্ট। স্কুলের সামনেই সড়কে ও তার আশপাশের এলাকায় পরীক্ষা শুরুর আগে ঘুস গ্রহণ করেন বিআরটিএ শেরপুরের মোটরযান পরিদর্শক আবু পলাশের ভাই বিপুল মিয়া। এছাড়া পরীক্ষার আগের দিন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ও শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুস লেনদেনের তথ্য মিলেছে অনুসন্ধানে।

Advertisement

ভুক্তভোগীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে যোগাযোগ করা হয় বিপুল মিয়ার সঙ্গে। একজন প্রার্থীকে তিন পরীক্ষায় কৃতকার্য করাতে দিতে হয় তিন হাজার টাকা। দালালদের এই সিন্ডিকেট ম্যানেজ করেন পরিদর্শক আবু পলাশ নিজেই। তার ভাই বিপুলের তত্ত্বাবধানে রয়েছে সক্রিয় সদস্য বাবুল, রায়হান, সোহানসহ আরও কয়েকজন। এদের সবাই প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিয়ে আসেন বিপুলের কাছে, বিপুল টাকা গ্রহণ করে হোয়াটসঅ্যাপে রোল নম্বর পাঠান পরিদর্শক পলাশের কাছে। তিন হাজার টাকার মধ্যে লাইসেন্স ভেদে দুই হাজার থেকে ২৫শ’ টাকা পান ইন্সপেক্টর পলাশ, আর বাকি টাকা বিপুলসহ অন্যরা।

বিপুলের সিন্ডিকেটে প্রতি উপজেলায় একটি করে সক্রিয় দালাল চক্র রয়েছে। এদের মধ্যে কেউ মোটর মেকানিক, কেউ মুদি দোকানের ব্যবসায়ী আবার কেউ বেকার। ঝিনাইগাতীতে বিপুলের সিন্ডিকেটে কাজ করেন রায়হান নামের একজন। শ্রীবরদীতে সোহান ও শেরপুর সদরে বাবুল মিয়া। বাবুল মিয়া পেশায় মোটর মেকানিক ও এই চক্রের সিনিয়র সদস্য। বিপুলের মাধ্যমে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে বর্তমান বিআরটিএতে কর্মরত অনেক স্টাফকেই তাচ্ছিল্য করে কথা বলেন তিনি। সোহান ও রায়হান নিজেদেরকে কোথাও সাংবাদিক আবার কোথাও বিআরটিএর কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে লাইসেন্স প্রত্যাশীদের নিয়ে আসেন বাবুল ও বিপুলের কাছে।

এছাড়া ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপ বা পেজের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে পোস্ট করেও প্রার্থীর খোঁজ করেন সোহান। তার তত্ত্বাবধানে রয়েছেন আরও কয়েকজন সদস্য। এরা ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে বেনামে বিআরটিএর লাইসেন্স সংক্রান্ত সহযোগিতা চেয়ে পোস্ট করে সাধারণ ফেসবুক ব্যবহারকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কিছুক্ষণ পর চক্রের অন্য সদস্যরা গিয়ে সেখানে সোহানের আইডি মেনশন করে তার সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।

এভাবেই নিজেদের বিষয়ে অভিনব প্রচারণা চালান বিপুল সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্যরা। এরা প্রথমে লার্নার করে দেওয়ার কথা বলে এক হাজার ও পরে সব পরীক্ষায় পাস করে দেওয়ার কথা বলে তিন হাজার করে টাকা নেন তথ্য মিলেছে অনুসন্ধানে। সম্প্রতি লার্নার থেকে শুরু করে স্মার্ট কার্ড হাতে পাওয়া পর্যন্ত ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা লেনদেনের তথ্যও মিলেছে।

Advertisement

শহরের অভিজাত শপিংমল, রেস্তোরাঁ, বিপনীবিতান, কফিশপ, ডিসি গেইটের আশপাশের এলাকাসহ পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে চলে ঘুস লেনদেন কার্যক্রম। বাবুল ও বিপুল সরাসরি টাকা নিয়ে প্রার্থীদের রোল নম্বর (লার্নার নম্বর) পাঠান মোটরযান পরিদর্শক আবু পলাশের কাছে।

এদিকে পরীক্ষা কেন্দ্রে পরীক্ষাও নেন বিপুল। বিআরটিএর কোনো স্টাফ না হয়েও লিখিত, মৌখিক ও ফিল্ড টেস্ট পরিচালনা করেন তিনি। এই সময়েই ঘুস দেওয়া প্রার্থীদের উত্তীর্ণ করে বাকিদের অকৃতকার্য দেখানো হয়। টাকা না দিলে পরীক্ষাকেন্দ্রে অসৌজন্যমূলক আচরণ ও বাজে ব্যবহারের স্বীকার হতে হয় বলে অভিযোগ প্রার্থীদের।

শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার ব্যবসায়ী শাহীন পাঠান। দুই দফায় আবেদন করে সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও পাননি ড্রাইভিং লাইসেন্স। তার অভিযোগ, দালাল সিন্ডিকেটকে টাকা না দেওয়ায় তাকে অকৃতকার্য দেখানো হয়েছে।

তিনি বলেন, আমি দুইবার করে পরীক্ষা দিয়েছি। আমার খাতা দেখে লিখে আমার পাশের দুইজন পাস করেছে। অথচ আমি টাকা না দেওয়ায় আমাকে ফেল করনো হয়েছে। এ বিষয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে।

ভুক্তভোগী রাজা মিয়া বলেন, আমরা ব্যবসায়ী মানুষ। দোকান আর ব্যবসা রেখে এতবার দৌড়াদৌড়ি করাটাও ঝামেলা। দালালদের টাকা না দেওয়ায় আমারও দুইবার পরীক্ষা দিতে হয়েছে। সময়মতো লাইসেন্স না পাওয়ায় সড়ক-মহাসড়কে মোবাইল কোর্টে জরিমানা দিতে হয়। এই বিড়ম্বনা থেকে বাঁচতে অনেকে দালালদের মাধ্যমেই লাইসেন্সের কাজ করিয়ে নেন।

কলেজশিক্ষক মুক্তার হোসেন বলেন, আমি এসেছি রৌমারী থেকে। টাকা দিয়েই লাইসেন্সের আবেদন করেছি। দালালদের কারণে সরকারি ফি’র প্রায় চারগুণ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। টাকার বিনিময়ে অদক্ষ চালকের হাতে উঠছে ড্রাইভিং লাইসেন্স, যার কারণে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। অথচ টাকা না দেওয়ায় দক্ষ চালকরা পাচ্ছেন না লাইসেন্স।

নকলা উপজেলার সিএনজিচালক বশির মিয়াও টাকা না দিয়ে দুই দফায় ব্যর্থ হয়ে তৃতীয় দফায় দশ হাজার টাকায় পেয়েছেন ফিংগার প্রিন্ট দেওয়ার সুযোগ।

তিনি বলেন, আমার দুইবার লার্নারের মেয়াদ চলে গেছে। লাইসেন্স করতে পারিনাই। এবার দশ হাজার টাকা দিয়ে নিছি। তিন মাসের মধ্যে স্মার্ট কার্ড করে দিতে চাইছে। এখন দেখি কী হয়।

এদিকে কোনো স্টাফ না হয়েও কিভাবে নিজের ভাইকে দিয়ে পরীক্ষা পরিচালনা করা হয়, তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি ইন্সপেক্টর নিজেও।

বিআরটিএ শেরপুর সার্কেলের মোটরযান পরিদর্শক আবু পলাশ বলেন, অফিসে স্টাফ কম থাকায় পরীক্ষার কেন্দ্রে আমাকে সহযোগিতার জন্য রাজবাড়ী থেকে বিপুলকে এনেছিলাম। সে বেকার বসে ছিল। ভেবেছিলাম, আমার সঙ্গে থেকে কিছুটা কাজ শিখবে। সে যদি এরকম অনিয়ম করে তাহলে তাকে আর একদিনও শেরপুরে রাখবো না। তাকে আমি কালই পাঠিয়ে দেবো। এরপর আর কোনো পরীক্ষায় তাকে কেন্দ্রে আনবো না।

তবে ঘুস লেনদেনের কথা স্বীকার করে পরবর্তীতে এসব অনিয়ম বন্ধে তাগিদ দিয়েছেন সহকারী মোটরযান পরিদর্শক। বিআরটিএ শেরপুর সার্কেলের সহকারী মোটরযান পরিদর্শক ফজলুর রহমান বলেন, বাইরে লাইসেন্স ইস্যুতে শুধু বিপুল নয়, আরও অনেকেই টাকা নিতে পারে। সে বিষয়ে আমরা ততোটা অবগত নয়। তবে টাকা লেনদেনের বিষয়টি আমরা অনেকবার শুনেছি। এটি বন্ধ হওয়া উচিৎ। এজন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এসব অনিয়মের বিষয়ে অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন বিআরটিএ শেরপুর সার্কেলের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিঃ) মো. আনোয়ারুল কিবরিয়া। তিনি বলেন, এসব অভিযোগ এখনো আমাকে কেউ করেনি। কোনো অভিযোগ পেলে আমি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি অবহিত করবো।

বিআরটিএ শেরপুর সার্কেলের তথ্যমতে, গত ছয় মাসে ৩১৬৩ জন পরীক্ষা দিয়েছেন, এরমধ্যে কৃতকার্য হয়েছেন ২৭৫৬ জন। আর দশ মাসে ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহ হয়েছে চার হাজার জনের।

এফএ/এমএস