মতামত

পাকিস্তানি মানসিকতা বদলাবে না

মুনতাসীর মামুন এবং শাহরিয়ার কবির দু’জনই লিখেছিলেন এবং বিভিন্ন সভায় বলেছিলেন, রমনা রেসকোর্সে জেনারেল নিয়াজি যে, ‘হাতিয়ার’ সমর্পণ করলেন সে অপমান পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ভোলেনি। তারা এর প্রতিশোধ নেবেই। বা সব সময় সচেষ্ট থাকবে প্রতিশোধ নেওয়ার।

Advertisement

গত কয়েক বছর এবং এখন ইউটিউব দেখলে এর যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাবে। কৃৎকৌশলগত উন্নতির কারণে, এখন বাংলাদেশে যে গণহত্যা পাকিস্তান চালিয়েছিল তার বিভিন্ন উদাহরণ দেখা যাবে। পাকিস্তানের অনেক তরুণ-তরুণী সেগুলো জানে। কিন্তু, পাকিস্তানি এসটাবলিশমেন্টের পৃষ্ঠপোষকতায় এ গণহত্যা অস্বীকার শুধু নয় মুক্তিযুদ্ধের পুরো ইতিহাস বিকৃতায়ণের চেষ্টা চলছে।

আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে জুনায়েদ আহমদের লেখা সেই জঘন্য বইটির কথা যেটির পৃষ্ঠপোষক ছিল আইএসআই। সেই বইয়ের প্রতিবাদ জানানোর জন্য নির্মূল কমিটি এক সভা করেছিল। শাহরিয়ার কবির মূল প্রবন্ধ পড়েছিলেন, সভায় উপস্থিত সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমদের উদ্দেশে মুনতাসীর মামুন বলেছিলেন, সংসদে গিয়ে জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনে আহ্বান জানাতে। জনাব আহমদ তখনই সংসদে চলে যান এবং এ বিষয়ে বক্তৃতা দেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন ঘোষণা করেন ২৫ মার্চ হবে জাতীয় গণহত্যা দিবস, যাতে মানুষ নিয়ত স্মরণ করে পাকিস্তানিদের সেই গণহত্যা।

গত মার্চে জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশন গণহত্যা সংক্রান্ত একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করলে পাকিস্তানের প্রতিবাদের কারণে তা বন্ধ করা হয়। আমরা অনেকে ভুলে গেছি, প্রেসিডেন্ট জিয়ার তখনকার প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান জাতিসংঘে ঘোষণা করেছিলেন, পাকিস্তান যা করেছে ভালো করেছে। এ কথা পাকিস্তানের নির্দেশে বলতে হয়েছিল কি না না কে জানে।

Advertisement

বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানি গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাচ্ছে তখন পাকিস্তান গোয়েবলসের মতো মিথ্যা প্রচারণায় নেমেছে। সেখানে এখন গণহত্যার বিরুদ্ধে ওয়েব সিরিজ হচ্ছে। চলচ্চিত্র হচ্ছে। বাঙালি ও বাংলাদেশের সোচ্চার হওয়া উচিত মুক্তিযুদ্ধের বিকৃতায়ণের বিরুদ্ধে। না হলে পাকিস্তান তো বটেই উপমহাদেশে সত্য ইতিহাস পাল্টে যাবে। এ রকম বিকৃতায়ণের সর্বশেষ চেষ্টা পাকিস্তানি চলচ্চিত্র হুয়ে তুম আজনবী। পাকিস্তানে এটি নিয়ে এখন জব্বর আলোচনা হচ্ছে এবং সে আলোচনা আবার এর ‘জনপ্রিয়তা’ বাড়াচ্ছে। এখানে তার উল্লেখ করছি।

কয়েকদিন আগে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ফেসবুক স্ক্রল করছিল। প্রায় যেমন করি। তখনই বাংলাদেশের খবরের চ্যানেলে সম্প্রচারিত একটি ভিডিও চোখে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে একটি সিনেমা ঈদুল ফিতরে মুক্তি পেতে চলেছে পাকিস্তানে। ইতিহাসনির্ভর সিনেমার দিকে একটা ঝোঁক, অনেকের মতো আমারও আছে। সিনেমাটির প্রতি আরও বেশি আকর্ষণ অনুভব করছিলাম কারণ বিগত কিছুদিন ধরে একাত্তর নিয়ে একটু আধটু পড়াশোনা করার চেষ্টা করছি। যদিও ইন্টারনেটের দৌলতে শেষ পর্যন্ত দেখে ফেললাম ‘হুয়ে হাম আজনাবী’ সিনেমাটি ।

‘হায় কি দেখিলাম! জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না’। লাহোর থেকে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসেছে জিনাত এবং নিজামউদ্দীন। জিনাত বাঙালি। নিজামউদ্দীন উর্দুভাষী। তারা পূর্বপরিচিত নয়। পরিচিত হয় ঢাকা ইউনিভার্সিটি তে এসে। নিজামউদ্দীন কিছুকাল বাদেই জিনাতের প্রেমে পড়ে। প্রেম যখন সবে শুরু, নিজামউদ্দীন ও জিনাত দুজনেই লাহোর ফিরে যায়। লাহোরে আসার পর নিজামউদ্দীন জানতে পারে জিনাত আসলে একজন ‘তওায়েফ’।

প্রেমের গল্প। মান-অভিমান বিচ্ছেদের আগুনের সেঁকা হয়ে তবে তো প্রেম জমবে! সিনেমা জমানোর আরো নানা উপকরণ পরিচালক মজুদ রেখেছেন। পূর্ব পাকিস্তানে ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে স্বাধীনতার লড়াই। নায়িকা জিনাত মুজিবপন্থী। লাহোরের বাঈজি বাড়িটি আসলে মুক্তিবাহিনীর একটি প্রধান আখড়া। মুক্তিবাহিনী প্রধান ফারুক। বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তার হাতেই পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার লড়াইয়ের দায়িত্বভার দিয়ে গেছেন।

Advertisement

কোট প্যান্ট পরিহিত এই মুক্তিবাহিনীর লিডারের, পূর্ব পরিচয় সিনেমার কোথাও দেখানো হয় নি। যদিও তারই নির্দেশে বাঈজি বাড়ির প্রধান খালম ভারত থেকে পাঠানো অস্ত্র লুকিয়ে রাখে। অবশ্য নিজামউদ্দীন বা জিনাতের এসব নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই। মুক্তিবাহিনীর বাঙালি অফিসার জব্বার জিনাতের সঙ্গে রাত কাটাতে চাইলে নিজামউদ্দীন তাকে বাঁচায়। দুজনে বিয়ে করে। ততক্ষণে অবশ্য বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়ে গেছেন। পাক আর্মি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে এসে ‘শান্তি বিঘ্নকারী’ মুক্তিফৌজকে মেরে, নিরস্ত্র বাঙ্গালিদের বাঁচানোর স্লোগান দিচ্ছে। কিন্তু এতকিছুর পরও ‘ঢাকার পতন, হয়। এরপর শুরু আসল গল্প, জিনাত অভিমানে বাংলাদেশে চলে আসে। খালমও তার সাথে বাংলাদেশে এসে ‘কোঠা’য় নাচের মেহফিল বসায়। নিজামউদ্দীন জিনাতকে ভুলতে পারে না।

জব্বার, ফারুকের নেতৃত্বে কালো প্যান্ট শার্ট পরা, কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা মুক্তিবাহিনী যখন বাংলাদেশে বসবাসকারী উর্দুবাসীদের উপর ‘গণহত্যা’ চালাচ্ছে, মেয়েদের ধর্ষণ করছে, তখন নিজামউদ্দীন বাংলাদেশে আসে জিনাতকে খুঁজতে। শেষ পর্যন্ত সে জিনাতকে খুঁজে পায়। দেশভক্ত পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের সাহায্যে পাকিস্তান ফিরে যায়।

‘আমার গল্প ফুরালো নটে গাছটি মুড়ালো ’না, নটে গাছ এত সহজে মোড়ানো যায় না। আর তাই হয়তো দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ার ৫০ বছর পরেও নিজেদের পাপ ঢাকতে ইতিহাসকে বিকৃত করতে হয়। অবশ্য ইতিহাসের বিকৃতি নাকি একটা গোটা প্রজন্মকে ভুল ইতিহাসে বাঁচতে শেখানো? তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। দৃশ্যের পর দৃশ্য জুড়ে দেখানো হয় ইন্দিরা গান্ধীর অখণ্ড হিন্দু রাষ্ট্র গঠন করার বাসনাকে পূরণ করছেন বঙ্গবন্ধু। হিন্দুদের প্ররোচনাতেই মুক্তিফৌজ গঠন হয়েছে।

বাঙালির অসাম্প্রদায়িক মনোভাব বা বাঙালি জাতিসত্তাকে রক্ষা করা মুক্তিযুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য নয়। সংগ্রামী এক বাঙালি নেতা পুরো সিনেমা জুড়ে যেন বড় অসহায়। পঞ্চাশের দাঙ্গার পর বঙ্গবন্ধু ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে বারবার তিনি যে কথা বলেছিলেন, তা হলো হিন্দুরা দেশ যাতে ত্যাগ না করে। বাঙালি ঐতিহ্যকে রক্ষায়, অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়তে, সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার বিষয়টি তাঁর কাছে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল।

এসব কথা মনে চলে আসে কারণ পাকিস্তানি এই পুরো সিনেমাটটি জুড়ে সাম্প্রদায়িক আফিমের চাষ করেছেন পরিচালক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তাঁর কাছে কেবলমাত্র ভারতীয় আগ্রাসনের একটা রূপ। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা তাই ভারতের পতাকা হাতে নিয়ে স্লোগান দেয় তার সিনেমায়। ঢাকা ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস হয়ে ওঠে অন্যতম জঙ্গি কার্যালয়। ঢাকা ইউনিভার্সিটি তে মুক্তিবাহিনী গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি আর্মিকে দোষী সাব্যস্ত করতে। বাঙালি অফিসারেরা পাকিস্তানি মেয়েদের ইজ্জত লুট করে এমনকি ঢাকা ইউনিভার্সিটির বাঙালি ছাত্ররাও বাঙালি মেয়েদের সম্ভ্রমহানি করতে চায়। বঙ্গবন্ধুর একমাত্র কামনা, কিভাবে তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে খুশি করবেন। ইন্দিরা গান্ধী হাতজোড় করে পূজা করেন। রাম রাজ্য বানাতে চান।

ভারতীয় সৈন্যরা সেনাবাহিনীর পোশাক না পড়ে গেরুয়া উত্তরীয় গলায় ঝুলিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে। ভারতীয় কালচারাল মিনিস্টারের সামনে উর্দুভাষী মুসলমান মেয়েদের ভজন গাইতে বাধ্য করে মুক্তিবাহিনী। এমন আরো কত মনি মুক্তা ছড়িয়ে পরিচালক পাকিস্তানি জনগণকে ঈদের উপহার দিয়েছেন। প্রত্যেকটা দেশের শাসন ব্যবস্থা একটি নিজস্ব ইতিহাস থাকে, তবে সেই ইতিহাস রচনার পিছনে জাতির ঐক্য রক্ষার প্রতি একটা দায়বদ্ধতা থাকে প্রশাসনের। মিথ্যার জোলাপ খাইয়ে জনগণকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা বৃথা। সেই বৃথা চেষ্টায় ১৯৭১ এর ১৬ ই ডিসেম্বর এর হত্যাকাণ্ড কে জাস্টিফাই করতে পরিচালক সংবাদপত্রের শিরোনামের ছবি দেখান পর্দায় ‘GENOCIDE ETHNIC CLEANSING OF WEST PAKISTANIS IN DHAKA INNOCENT CHILDREN PARENTS EXECUTED BY MUKTI BAHINI’ সিনেমাটি শেষ করে ইউটিউবের দৌলতে পরিচালক কামরান এর কয়েকটি ইন্টারভিউ দেখতে পাই।

কামরান শাহীদের বানানো এটি প্রথম সিনেমা। তাঁর আব্বা সত্তর-আশির দশকের বিখ্যাত পাকিস্তানি চলচ্চিত্র অভিনেতা শাহীদ। কামরান শাহিদ পাকিস্তানি জনপ্রিয় চ্যানেল দুনিয়া নিউজে ‘On The Front With Kamran Shahid’ নামে বিখ্যাত একটি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করতেন। একটি ইন্টারভিউতে তিনি বলছিলেন লন্ডনের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে তিনি এম.ফিল করেছেন। প্রচুর অর্থনৈতিক সঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের প্রায় সবকটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা করেছেন, ইতিহাসকে ভালোবাসেন বলে।

৩৫ -৪০ কোটি টাকায় নির্মিত এই বিগ বাজেটের সিনেমাটিতে পাকিস্তানি জনগণের সামনে একাত্তরের সত্য তুলে ধরা তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য। উপমহাদেশের জনগণের বিশ্বাস বড় সহজে অর্জন করা যায়। ২০২১ সালে নির্মিত ‘জো বিছর গ্যায়ে’ নামক একাত্তরের ঘটনা নিয়ে নির্মিত সিরিজটি বা নাবিল কোরেশি’র পরিচালনায় নির্মিত ‘খেল খেল মে’ নামক সিনেমাটিও পাকিস্তানে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। ‘জো বিছর গ্যায়ে’ সিরিজটি তো কয়েক কোটি লোক দেখেছে ইউটিউবে। সব ক্ষেত্রেই ‘বিশ্বাসঘাতক’ বাঙালির রূপ সেখানে পরিষ্কার। পরিচালক কামরান একপা বেশি এগিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সময়, মুক্তিযোদ্ধা ফারুক তাই হয়তো বলেছে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াটা এক বিশাল ভুল। বঙ্গবন্ধুকে তাই মরতেই হবে। মৃত মানুষ বা ছবি তো কথা বলে না, সেই সুযোগ নিয়েছেন পরিচালক। যেখানেই মুক্তিবাহিনীর গণহত্যা চালানোর দৃশ্যপট সাজিয়েছেন, পর্দায় ভেসে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের ছবি। বাঙালি কবির দুঃখ এখানেই শেষ হয়নি।

মুক্তিফৌজ প্রধান যখন ভারতীয় মন্ত্রীকে খুশি করতে উর্দুভাষী বালিকাকে উপহার দেয় তখনও ক্যানভাসে থেকেছেন শুধু রবীন্দ্রনাথ। উপমহাদেশে বসবাসকারী, নিজেকে ইতিহাসের পণ্ডিত পরিচয় দেওয়া একজন পরিচালকের থেকে পাওয়া এই দৃশ্যকল্প, তার মেধার প্রতি করুণার পাশাপাশি ঘৃণা করতেও বাধ্য করে। আসলে ‘সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে’! পৃথিবীর সব মৌলবাদীর চেহারায় আসলে একই তাই ভারতে যেমন ‘কাশ্মীর ফাইলস’ নির্মিত হয় ঠিক তেমনি তৈরি হয় পাকিস্তানে ‘হুয়ে তুম আজনাবী’র মতো সিনেমাও।

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা বিষয়ক গবেষক।

এইচআর/এমএস