রফিকুল ইসলাম জসিম
Advertisement
বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের বিয়ে নিজস্ব সংস্কৃতি ধারণ ও চর্চার মধ্যে অন্যতম। তাদের সাধারণত নিজস্ব সমাজের বাইরে বিয়ে করাটা একেবারেই নিষিদ্ধ। এর অন্যথা হলে বা অন্য সম্প্রদায়ের কাউকে বিয়ে করলে সমাজচ্যুত হতে হয়। বিয়ের ক্ষেত্রে খুবই কঠোর মণিপুরীদের অনুশাসন। কন্যা পছন্দের পর বিয়ের দিন নির্ধারণের জন্য পাত্রপক্ষ তার আত্মীয়স্বজন নিয়ে খই, ফলমূল, নাড়ু, মিষ্টিসহ কনের বাড়িতে যায়। এরপর দুইপক্ষের সম্মতিতে বিয়ের দিন ধার্য হয়।
কয়েকটি ধাপে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের বিয়ের পুরো আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। আসুন জেনে নেওয়া যাক সেগুলো-
মঙ্গলাচরণবর ও কন্যা পক্ষের পারস্পরিক আলোচনার পর একটা দিন নির্দিষ্ট করা হয়। ঐ দিনটিই মাঙ্কলকাপি বা মঙ্গলাচরণ। সেদিনেই হেইচাপথ এবং বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা হয়। এরপর হেইচাপথ বা হেইচিং। এটা বিয়ের আগের অনুষ্ঠান। যেখানে বর পক্ষের লোকজন আসেন মিষ্টি বা খৈয়ের তাপু বা হেমারুক নিয়ে। সাধারণত দুপুরবেলায় বা বিকালে সম্পন্ন হয় এই প্রথা।
Advertisement
আজ অবধি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের বিয়েতে দাবি-দাওয়া বা পণ বিনিময়ের প্রথা চালু হয়নি। বলতে গেলে তা একেবারে নিষিদ্ধ। কখনো বর পক্ষের লোকজন কোনো দাবি করেননি। পূর্বে বিয়েও সারা হত খুব ছিমছামভাবেই। খাওয়া দাওয়ার কোনো পর্ব থাকত না। তবে বর্তমানে অন্যদের দেখাদেখি খাওয়ানো হয় কনের বাড়িতে। যদিও এখনো তা বাধ্যতামূলক নয়। যাদের অবস্থা ভালো নেই তারা এড়িয়ে যেতে পারেন। আগের দিনে কারও বাড়িতে মেয়ে বা ছেলের বিয়ে হলে, গ্রামের লোকজন এসে ঐ বাড়ি মেরামত থেকে শুরু করে বিয়ের মঞ্চ সাজানো সব ফ্রিতেই করে দিতেন। সাধারণত বিয়ের আগের দিন রাতে বর কনে দুই বাড়িতেই লাস্ট ব্যাচেলার পার্টি বা মারুপ তিলনির প্রথা প্রচলিত। বিয়ের ঠিক আগের দিন সন্ধ্যা থেকেই বর বা কনের বন্ধুরা যার যার বাড়িতে আসতে শুরু করেন। এরপর অনেক রাত পর্যন্ত তারা নিজেদের মধ্যে নানা গল্প করতেন ও বিভিন্ন খেলা খেলেন।যেমন, নিকন, পাশা, দড়া ইত্যাদি। এরপর তারা কনের বন্ধু বান্ধব হলে কনেকে বিভিন্ন উপহার দিয়ে খৈ বা খিচুড়ি খেয়ে এগারোটা বারোটার দিকে যার যার বাড়ি চলে যান। বরের বাড়িতেও ঐ রকম প্রথায়।
আরও পড়ুন: পরার পর খেতেও পারবেন এই গয়না
বিবাহের পোশাকসব জাতিরই মৌলিক আচার আচরণে কিছু মৌলিকতা থাকে। বিষ্ণুপ্রিয়া বিয়েতেও এমনই কিছু মৌলিকত্ব আছে। বিয়ের পোশাক বার বা পল্লেয় পড়তে হয়। তবে কেউ কেউ চাকছাবি পরেও বিয়ে করেন। জমকির আহিং বা বেলবেটের ব্লাউজ যার উপর চুমকির কারুকার্য থাকে। আর লেইতেরেং এবং ইনাফি। শাঁখা সিঁদুরের তেমন বাধ্যবাধকতা পূর্বে না থাকলেও বর্তমানে অনেকেই তা পরেন বিয়েতে। তবে নামসা বা চন্দনের (তিলক) পরতেই হবে বর কনে দুজনকেই। বর ধুতি পৈতা বা নকুন, কাঠি (তুলসি কাঠের মালা) এবং একটা পাতলা চাদর পড়েন। সেদিন খালি গায়ে বসতে হয় বরকে বিয়ের পিঁড়িতে। তবে বর্তমানে কোথাও কোথাও পাঞ্জাবি পরেও বিয়ে করার প্রচলন প্রচলিত।
বর বরণবরের আগমনের সময় কনের বাড়ির গেটের কাছে গেট পাশ দিতে হয় সেটা গ্রামের যুবক এবং কনের বান্ধবীরাই নিয়ে থাকেন। তারপরই বরকে বরণ করা হয় তার হবু শ্বশুরবাড়িতে।
Advertisement
বিয়ে বাড়ির উঠানের মাঝে কুঞ্জ সাজানো হয়। সেই গোলাকার কুঞ্জের পশ্চিম দিকে আসন পাতা হয় বর কনের জন্য। তারা পূর্বদিকে মুখ করে বসেন। কুঞ্জ আকারে অনেকটাই বড় থাকে। কারণ সেই কুঞ্জের ভেতরে ঢাকুলা (মৃদঙ্গবাদক) ও ইসালপা (গায়করা) চারিদিকে গোল করে বসে গান করতে থাকেন। যতক্ষণ বিয়ে শেষ না হয় ততক্ষণ। সেই কুঞ্জের দক্ষিণ দিকে বামুন ঠাকুরদের জন্য আসন পাতা থাকে। নির্দিষ্ট ঐ দিকটাতেই ব্রাহ্মণরা বসেন। অন্য কোনো দিকে তারা বসতে পারবেন না। কুঞ্জের দক্ষিণ পূর্ব দিকে বয়স্ক পুরুষদের বসার ব্যবস্থা করা হয়। কুঞ্জের পূর্ব দিকে বরযাত্রীদের বসার আসন পাতা থাকে। সাধারণত উঠানের পূর্ব দিকে যে গোয়ালঘর সেটাই পরিষ্কার করে সাজিয়ে বর যাত্রীদের বসার ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে বর ও তার সঙ্গীরা বড় একটি আয়না সামনে রেখে ঐ আয়নার সামনেই বর বসেন। কুঞ্জের উত্তর দিকে থাকে নারীদের বসার ব্যবস্থা।
আরও পড়ুন: বিয়ের আংটির যত রহস্য
এছাড়া বরের মা কে যিনি কন্যাদান করেন তার বসার ব্যবস্থা করা হয়, কুঞ্জের ঠিক পেছনে। অর্থাৎ গৃহস্থের বারান্দায়। অন্য কোথাও তাকে বসতে দেওয়া নিষিদ্ধ। গ্রামের যুবক ও পুরুষরা চারিদিকে পেছনের সারিতে বসতে পারেন। এটা হয়তো বিয়ে বাড়ির নিরাপত্তার জন্যই। কনের বাড়ির লোকজনও বসতে পারেন বারান্দায়। তাছাড়া কনের বান্ধবীরা বিয়ের আগে কনের সঙ্গে ঘরেই বিছানায় বসে থাকেন। বিয়ে চলাকালীন কেউ কুঞ্জের কাছ ঘেঁষে দাঁড়াতে পারবে না। তাদের বিবাহ অনুষ্ঠান খুব সুশৃঙ্খলভাবে যে যার আসনে বসেই উপভোগ করতে পারেন। তবে বর্তমানে ক্যামেরাম্যান বা কেউ কেউ মোবাইলে ছবি তোলার জন্য সামনে চলে যান। তবে সেটা করতে গেলেও পেছনে বসে থাকা দর্শকদের অনুমতি নিতে হয়।
বর বার্তণ (বরকে নিমন্ত্রণ)বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতে অতি অবশ্যই লেরিক হুনানি বা মহাভারত পাঠ করতে হয়। এরপর দুই পক্ষের লোকজনের উপস্থিতিতে কুল পুরোহিত নিজে উপস্থিত থেকে পঞ্জিকা দেখে তা করা হয়। বিয়ের আগের দিন বর বার্তণ (বরকে নিমন্ত্রণ) করতে হয়। তা কনের কোনো ভাই করেন।
কন্যাদান ও বর কনেকে আশীর্বাদবিয়ের আসরে বর কনের হাত কুশ গাছের কাণ্ড দিয়ে বেঁধে তার উপর ধান ভর্তি একটা কাঁসার থালায় ব্রাহ্মণ মন্ত্র পাঠ করেন।কনের পিতা তখনই কন্যাদান করেন। এরপর আত্মীয় পরিজন ও গ্রামের লোকেরা নানা উপহার সেই দান পাত্রে ছুঁয়ে রেখে যান। এই ভাবেই বর কনেকে আশীর্বাদ করা হয়। আশীর্বাদ শেষ হলে পরস্পরের হাতের বাঁধন খুলে দেন ব্রাহ্মণ। এরপর সাত পাকের কাজ শুরু হয়।
বিয়ের মূল অনুষ্ঠান (সাত পাকে বাঁধা)বিয়ের অনুষ্ঠানে বর ও কনের একজন করে নির্দিষ্ট সঙ্গী থাকেন। তবে তাদের দুজনকেও অবশ্যই বিবাহিত হতে হবে। বরের সঙ্গী ছাতা ধরবে বরের। আর যখন বর বিয়ের পিঁড়িতে বসবে তার বিভিন্ন ফরসায়েস রাখবেন। কখনো তাল পাতার পাখা নিয়ে বাতাস করে দেবেন। কখনো রুমালে মুখ মুছে দেবেন। কখনো কানে কানে কথা বলে অসুবিধার কথা জানবেন বরের। কনের সঙ্গী বৌটিও কনের সঙ্গে থাকবেন তবে সব সময় নয়। তাদের কনেরা বেশ শক্তিশালী বলেই মনে হই। ওরা নিজেরাই একা একা গান ও বাদ্যের তালে তালে সাত পাকে বরকে বরণ করতে পারেন। শুধু বরের মাথায় ফুল দিতে বামুন ঠাকুর তার হাত থেকে ফুলের সাজি বা গ্লাস নিজের হাতে নিয়ে ফুলগুলো কনের অঞ্জলী ভরে দেন। সেই ফুলও নিজে নিজেই বরের মাথায় দিতে হয় নববধূকে। এসময় কুঞ্জের ভেতরে কেউ থাকতে পারেন না। কাছাকাছি সঙ্গী থাকেন শুধু প্রয়োজনে সাহায্যের জন্য।
পানাতানহা (বরকে বরণ)বিয়ের সাতপাক পূর্ণ হলে বর ও কনেকে কনের ঘরের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দুজনকে বসিয়ে তাদের কাপড়ের গিট বেঁধে দেওয়া হয়। সেই গিট খোলার জন্য কনের ভাই বোন বা বিশেষ করে বান্ধবীরা টাকা চান। পানাতানহা এইরাতাংহা দিয়ে বরকে (নতুন জামাইকে) বরণ করা হয়। বর কনের সব গুরুজনদের প্রণাম করে এবং কনেও তার আপনজনদের, মা-বাবা, জ্যাঠা কাকা সব গুরুজনদের প্রণাম করে বিদায় পর্ব এভাবেই ঘনিয়ে আসে। সে এক আবেগময় মুহূর্ত! এতদিন যে বাড়িটি নিজের বলে জেনে আসছে এক নিমিষে পর হয়ে যায়। তখন পিতা মাতা গুরুজনেরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। কনেও দুঃখ আনন্দ মেশানো অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই চির-চেনা মানুষগুলোকে ছেড়ে সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে নতুন মানুষদের আপন করে চলে যান। এরপরই কনেকে বিদায় দিতে হয়।
আরও পড়ুন: মীতৈ মণিপুরীদের বৈচিত্র্যময় বিয়ের রীতিনীতি
ফুলশয্যার ব্যবস্থাকনে বিদায়ের আগেই সামান্য খাবার খেয়ে নেন বর এবং কনে। যে রাতে বিয়ে সেই রাতেই বিদায় এবং সেই রাতেই বরের বাড়িতে ফুলশয্যার ব্যবস্থা করা হয়। তাই কনের বাড়ি থেকে ন্যূনতম তিনজনকে নিঙল থিঙপাৎ যেতে হয়। নিঙল থিঙপা হলো কনেকে পৌঁছে দেওয়ার প্রথা। বরের বাড়িতেও ধূপ, চন্দন, খৈ ছিটিয়ে কনের শাশুড়ি কনেকে বাড়ির গেট থেকে জড়িয়ে ধরে ঘরে নিয়ে যান। এভাবেই কনের গৃহ প্রবেশ হয়। কনের বাড়ির লোকজনদের মধ্যে দুজন স্ত্রীলোক ও একজন পুরুষ থাকতে হবে। এছাড়াও আরও অনেকেই যেতে পারেন কনের সঙ্গে। তবে নির্দিষ্ট তিনজনই বরের বাড়িতে কনের জন্য ফুলশয্যার বিছানা পেতে দেবে। এভাবে বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠান সমাপ্তি হয়। সেই রাতেই বরের বাড়ি থেকে কন্যা পক্ষের লোকজন ফিরে আসে।
বৌভাত ও ফিরা যাত্রানববধূকে বরণ করে শ্বশুর বাড়িতে যত আত্মীয় গুরুজন আসেন সবাইকে কাপড় দিয়ে প্রণাম করেন নববধূ। এরপর তিন দিনের দিন কারচানা অনুষ্ঠানটি করতে হয়। সেদিন কনের বাড়ি থেকে গ্রামের লোক এবং আত্মীয় স্বজনরা খৈ, মিষ্টি নিয়ে বরের বাড়িতে প্রথমবার দেখতে যান। আজকাল কেউ কেউ বৌভাত চার দিনের দিন করে চতুর্থ মঙ্গলের প্রথা পূর্বে ছিল না বর্তমানে সেই প্রথা ও প্রচলিত হয়ে গেছে। তবে তা এখনো বাধ্যতামূলক নয়। শ্বশুর বাড়িতে নববধূর আতর ভাত (প্রথম রান্নার অনুষ্ঠান) নেওয়া হয়। পঞ্চম দিন বরের বাড়ি থেকে পাঁচজন কি সাতজন নিয়ে বর কনেরা পাচেরভাত খেতে বা ফিরা যাত্রায় আসেন। সেদিন সকালে আসলে সন্ধের আগে আবার বর কনেকে ফিরে যেতে হয় বরের বাড়ি। এরপর কোনো একটা ভালো দিন দেখে (বাংলা পঞ্জিকায়) কনেকে একদিনের জন্য বাড়িতে নিয়ে নিয়ে আসে কনের বাবা মা। এরপর থেকে দুই বাড়িতে আসা যাওয়া এবং থাকার প্রথা সামাজিকভাবে স্বীকৃত হয়।
লেখক: ফিচার লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী
কেএসকে/এমএস