স্বাস্থ্য

দেশে অ্যাজমা রোগীর সঠিক পরিসংখ্যান নেই, চিকিৎসক সংকট প্রকট

#মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসাদের ৩০ শতাংশই অ্যাজমা রোগী#শিশুদের মধ্যে অ্যাজমা আক্রান্ত বেশি#রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ অপ্রতুল#বায়ূদূষণের কারণে অ্যাজমা রোগী বাড়ছে

Advertisement

অ্যাজমা বা হাঁপানি একটি শ্বাসনালির অসুখ। রোগটি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। চিকিৎসকদের মতে, বর্তমানে গ্রামের তুলনার শহরের অধিবাসীদের মধ্যে রোগটির প্রাদুর্ভাব বেশি। বায়ুদূষণ শ্বাসতন্ত্রের অসুখের জন্য বেশি দায়ী। বিশ্বব্যাপী আক্রান্তদের অধিকাংশ শিশু। ১৯৯৯ সালের পর দেশে কোনো জরিপ না হওয়ায় রোগটিতে আক্রান্ত রোগীর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। আবার আক্রান্তদের উপযুক্ত চিকিৎসা দেওয়ার জন্য চিকিৎসক সংকটও প্রকট বলে জানা যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩০ কোটি মানুষ হাঁপানিতে আক্রান্ত। এক থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে আক্রান্তের হার বেশি। বাংলাদেশে বর্তমানে অ্যাজমা রোগীর সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ লাং ফাউন্ডেশনের শ্বাসতন্ত্রের অসুখ সম্পর্কিত এক জরিপে বলা হয়েছিল, হাঁপানি রোগীর সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। এরপর আর কোনো জরিপ হয়নি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বর্তমানে এ সংখ্যা এক কোটির বেশি।

এমন পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বের মতো মঙ্গলবার (২ মে) দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব হাঁপানি দিবস-২০২৩। প্রতিবছর মে মাসের প্রথম মঙ্গলবার হাঁপানি দিবস পালিত হয়। এবছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘অ্যাজমা কেয়ার ফর অল।’

Advertisement

অ্যাজমা বা হাঁপানির কিছু প্রধান কারণের মধ্যে রয়েছে বায়ুদূষণ, পারিবারিক ইতিহাস, অ্যালার্জি, পেশাগত এক্সপোজার যেমন-রাসায়নিক ধোঁয়া, ধুলা, ধূমপান ইত্যাদি। হাঁপানির উপসর্গগুলো হলো- শ্বাসকষ্ট, কাশি, বুকে বাঁশির মতো শব্দ হওয়া, বুকে চাপ অনুভূত হওয়া বা দমবন্ধ ভাব। তবে বর্তমানে দেশে জন্মগত কারণের চেয়ে পরিবেশগত কারণে এই সমস্যা বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া অ্যাজমায় আক্রান্তদের মধ্যে শিশু ও বয়স্করাই বেশি।

জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, প্রতিষ্ঠানটির হাসপাতালে যতজন চিকিৎসা নিতে আসেন, তার ৩০ শতাংশই অ্যাজমা রোগী। এর মধ্যে প্রায় ২৬ শতাংশের বয়স ১৪ বছরে নিচে। ২০২২ সালে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বহির্বিভাগে আট হাজার ৪৮০ জন অ্যাজমা রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে দুই হাজার ১৮১ জনের বয়স ১৪ বছরের নিচে। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী এক হাজার ৪০৫ জন। ২৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সের দুই হাজার ৫০৭ জন আর ৫০ বছরে বেশি রোগী দুই হাজার ৩৮৭ জন।

এছাড়া হাসপাতালটিতে গত বছর ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন তিন হাজার পাঁচজন রোগী। এর মধ্যে ১৪ বছরের নিচে ৮৯ জন। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সের ১৯৭ জন। ২৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সের ৮০১ জন ও ৫০ বছরে বেশি এক হাজার ৯১৮ জন।

দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অপ্রতুল

Advertisement

দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে হাঁপানিসহ বক্ষব্যাধি সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের রোগের সেবাদানে যত সংখ্যক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দরকার, তা নেই। অ্যাজমা (হাঁপানি), যক্ষ্মা (টিবি), সিওপিডির (দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা) মতো চিকিৎসায় সরকারি পর্যায়ে অধ্যাপকের জন্য সৃষ্ট পদ রয়েছে মাত্র তিনটি। এর মধ্যে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে দুটি এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে একটি। গত ১৪ বছরেও অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপকের নতুন পদ সৃষ্টি হয়নি। এতে রোগীরা হাসপাতালে এসেও পূর্ণাঙ্গ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

বর্তমানে রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগে পদ আছে ৩৬টি। এর মধ্যে অধ্যাপকের পদ তিনটি। সহযোগী অধ্যাপকের ১৪টি ও সহকারী অধ্যাপকের পদ আছে ১৯টি। এই হাতে গোনা কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের বাইরে সরকারি হাসপাতালে বক্ষব্যাধি চিকিৎসায় পদহীনভাবে তিন থেকে চারশজনের মতো বিশেষজ্ঞ আছেন। তারা বক্ষব্যাধির চিকিৎসক হয়েও মেডিসিন ও ইএনটিসহ বিভিন্ন বিভাগে সেবা দিচ্ছেন। নতুন পদ সৃষ্টি না হওয়ায় অনেক চিকিৎসক মেডিকেল অফিসার হিসেবেই যাচ্ছেন অবসরে।

জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. খায়রুল আনাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার হাসপাতালেই দৈনিক গড়ে বহির্বিভাগ, জরুরি ও অন্তঃবিভাগ মিলে হাজারের বেশি রোগী চিকিৎসা নেন। সারা দেশের হাসপাতালেই এসব রোগীর চাপ রয়েছে। যা সামাল দিতে এই মুহূর্তে শুধু আটটি পুরাতন মেডিকেলেই সহকারী, সহযোগী ও অধ্যাপক মিলে আড়াই থেকে তিনশ পদ সৃষ্টি জরুরি। আমি পরিচালকের দায়িত্ব নেওয়ার পর পদ সৃষ্টির চেষ্টা করছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করছি। সম্প্রতি স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরে যোগাযোগের পর ২৬৭টি পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলছে। সেখান থেকেও কাটছাঁট করে সহকারী, সহযোগী ও অধ্যাপকের জন্য মাত্র ৬০টি পদ অনুমোদনের জন্য প্রক্রিয়াধীন।’

মহাখালীর ৬৭০ শয্যার জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউিট ও হাসপাতালের সেবা তত্ত্বাবধায়ক ডা. আব্দুল্লাহ আল মেহেদি জাগো নিউজকে জানান, তাদের হাসপাতালে রেসপিরেটরি মেডিসিন বিষয়ে অধ্যাপকের জন্য সৃষ্ট পদ মাত্র দুটি। দীর্ঘদিন পর গত সপ্তাহে একজনকে পদায়ন করা হয়েছে। এখনো একটি পদ শূন্য। সহকারী অধ্যাপকের (চেস্ট মেডিসিন) জন্য সৃষ্ট তিনটি পদের মধ্যে দুটিই শূন্য রয়েছে। থোরাসিক সার্জারিতে অধ্যাপকের একটি পদ থাকলেও শূন্য এবং থোরাসিক সার্জারির সহযোগী অধ্যাপকের দুটি পদের সব শূন্য।

সার্জারিতে সহযোগী অধ্যাপকের একটি পদ, সেটিও শূন্য। অ্যানেস্থেসিওলজির অধ্যাপকের একটি পদ, সহযোগী অধ্যাপক (অ্যানেস্থেসিওলজি) তিনটির সব এবং সহযোগী অধ্যাপক (অ্যানেস্থেসিওলজি) চারটির মধ্যে তিনটি শূন্য পড়ে রয়েছে। প্যাথলজি ও মাইক্রোবায়োলজি অধ্যাপকের পদও শূন্য। সব মিলে বিভিন্ন পদে ২৩ জন চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে।

বর্তমানে শহরাঞ্চল ও গ্রামে দীর্ঘমেয়াদি কাশির প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এর কারণ জানতে চাইলে ডা. মো. খায়রুল আনাম জাগো নিউজকে বলেন বলেন, ‘যাদের অ্যাজমা, সিওপিডি, ফুসফুসে ডিপিএলডি রোগ আছে এবং ফুসফুসে ক্যানসার আছে এমন রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি কাশি হচ্ছে। এছাড়া অনেক রোগীর দেখা যায় টিবি রোগ শনাক্ত হয়নি। তাদের এক মাস, দুই মাস বা এর বেশি সময় কাশি থাকতে পারে। তারা চিকিৎসকের শরণাপন্ন না হয়ে রোগ নির্ণয় না হওয়ার ফলে এ সমস্যায় ভোগেন। এছাড়া অনেক টিবি রোগীর চিকিৎসা বিলম্বিত হওয়ার কারণে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের। প্রাপ্তবয়স্কদের অনেকের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়া ও যথাযথ চিকিৎসা না নেওয়ার ফলে দীর্ঘমেয়াদি কাশির সমস্যা দেখা দেয়।’

এছাড়াও বায়ুদূষণের ফলে অ্যাজমা রোগী দেশে এবং সারা পৃথিবীতেই বেড়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।

বিশ্ব হাঁপানি দিবস উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারিভাবে সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দ্য চেস্ট অ্যান্ড হার্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ৪১তম বাৎসরিক সাধারণ সভা, বৈজ্ঞানিক সম্মেলন, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও সংস্থার উদ্যোগে সচেতনতামূলক আলোচনা সভা, শোভাযাত্রা, লিফলেট বিতরণসহ নানা কর্মসূচি চলবে দিনব্যাপী।

এএএম/এএসএ/জিকেএস