ঈদের পর আন্দোলন জোরদার করবে বিএনপি-এমন ঘোষণা তারা অনেক আগেই দিয়েছিল। ঈদের সপ্তাহকাল কেটে গেছে ইতোমধ্যে। শরিকদলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়েছে আন্দোলন বিষয়ে। তবে তাদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এবারও তারা বড় বড় শহরগুলোতেই আন্দোলনকে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। কিন্তু পথের কাঁটা হিসেবে দেখা দিয়েছে ৫ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন।
Advertisement
রোজার ঈদ থেকে কোরবানির ঈদের মাঝামাঝি সময়ই ছিল তাদের আন্দোলনের পিকটাইম। এমনও কোনো কোনো পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, দুই ঈদের মাঝখানের সময়টাতেই সরকারকে নাস্তানাবুদ করতে হবে। তা না হলে পরবর্তী সময় আন্দোলন করাটা তাদের জন্য পিচ্ছিল হয়ে পড়বে আগের চেয়ে বেশি। কারণ সরকার তখন নির্বাচনী প্রস্তুতি নিয়ে এককভাবে মাঠ দখল করে নেবে।
যুক্তি বিশ্লেষণে তাদের সময় নির্ধারণটা তাদের জন্য ঠিকই ছিল। কিন্তু তাদের টার্গেটেড টাইমে আন্দোলন করার মতো সক্ষমতা যেটুকু ছিল সেটাও ক্রমহ্রাসমান এই মুহূর্তে। ইতোমধ্যে ৫ সিটি করপোরেশনেই উকিলপন্থি বিএনপি প্রার্থীদের উপস্থিতি স্পষ্ট। বিএনপি সিটি করপোরেশনে নির্বাচন করবে না, এমন নির্দেশনা স্পষ্ট করে প্রচার করেছে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। সর্বশেষ তাদের নীতিনির্ধারণী মহল থেকে বলা হয়েছে, দলীয় নির্দেশ অমান্য করে যদি কেউ নির্বাচনে অংশ নেয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সাধারণত কোনো নির্বাচনে কোনো দল অংশগ্রহণ না করলে কিংবা কোনো দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হলে দল থেকে এমন নির্দেশনা সবসময়ই দেওয়া হয়। তারপরও দেখা যায় প্রায় সব নির্বাচনে দলীয় নির্দেশ অমান্য করে প্রার্থী হয়ে যায়। কখনো কখনো বিজয়ীও হয়। যেমন বর্তমান সিটি করপোরেশন মেয়রদের মধ্যেও এমন রয়েছেন।
Advertisement
দলীয় নির্দেশ অমান্য করে নির্বাচন করে কেউ পরাজিত হবে জানার পরও নির্বাচন করে নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের জন্য। তারা জানে বিজয়ী হলে দল বিষয়টিকে এড়িয়ে যাবে। আর যদি দলীয় কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়ও তাহলেও সেটা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। কিংবা বহিষ্কার করলেও একসময় দলীয় প্রয়োজনে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারও করা হয়ে থাকে।
এটা যে শুধু বিরোধী দলের নেতাদের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে তা নয়। সরকারি দল থেকেও যদি দলীয় নির্দেশ অমান্য করে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে থাকে আর বিজয়ী হয় তারাও বিষয়টিকে সেভাবেই দেখে। সুতরাং নির্বাচন করা যাবে না এমন নির্দেশনাটা আসলে কাগজে কলমেই থাকে বাস্তবে তা হয় না।
দলীয় নির্দেশনা অমান্য করে উকিল আব্দুস সাত্তার ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তাকে এর আগেই দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু তিনি ঠিকই এখনও বিএনপিকেই নিজের দল হিসেবে মনে করেন। হয়তো কখনও সুযোগ হলে তিনি বিএনপির নেতা হিসেবে আবার বহালও হয়ে যেতে পারেন।
সুতরাং নির্বাচন করা যাবে না এমন নির্দেশনা আসলে নির্বাচনের জন্য বড় কোনো ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে না। কিন্তু এবারের ৫ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের বিষয়টি ভিন্নরকম। কারণ একদিকে জাতীয় নির্বাচনের বছর এটি দ্বিতীয়ত বিরোধী দলের আন্দোলনে চূড়ান্ত সময়ও এটি। তাদের জাতীয় পর্যায়ের দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করতে হলে আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে হবে। কিন্তু যদি বড় শহরগুলোর নেতাদের মধ্যে বিভক্তি জোরালো হয় এবং তাদের বহিষ্কারের খড়গের নিচে পড়তে হয় তখন আন্দোলনে এর প্রভাব পড়বে।
Advertisement
শুধু তাই নয় আসলে নির্বাচনের ঢেউয়ে ওইসব স্থানে আন্দোলন খুব একটা শক্তিশালী মাত্রায় পৌঁছানোর সম্ভাবনাও কম। কারণ দলীয় কর্মীরা তখন নির্বাচনের মাঠে থাকবে। তাদের ঘরে বসিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। যদি দলীয় কোনো নেতা নির্বাচনে অংশ নাও নেয় তাহলেও তাদের নির্বাচনী মাঠে থাকতে হবে। এটা বন্ধ করা যাবে না। কারণ মেয়র কোনো প্রার্থী না থাকলেও ৫ সিটি করপোরেশনে অন্তত কয়েকশ কাউন্সিলর প্রার্থী থাকছে বিরোধী দল থেকে- এটা চোখ বন্ধ করেই বলা যায়।
৫সিটি করপোরেশন এলাকাতেই কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রকাশ্যেই নির্বাচন করার ঘোষণা ইতোমধ্যে প্রচার হয়ে গেছে। তাদের বক্তব্য- কাউন্সিলরগণ দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করেন না, সুতরাং দলীয় ক্ষতি হওয়ার কোনো কারণ নেই। অন্যদিকে এমন কাউন্সিলরও আছেন যিনি হয়তো এলাকায় অনেক জনপ্রিয়। যে কারণে ৪/৫ বার পর্যন্ত কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন এবং এখনও কাউন্সিলরের দায়িত্বও পালন করছেন।
সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে বিএনপির নেতা আরিফুল হক চৌধুরী কিংবা খুলনা মহানগর বিএনপির সাবেক সহসভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জুর বক্তব্য কিন্তু এখনও স্পষ্ট নয়। তাদের কথায় বোঝা যায়, তারা এখনও প্রত্যাশা করছেন দল নির্বাচনের ব্যাপারে গ্রিন সিগনেল দিতে পারে। দুইজনই স্বীকার করছেন দলীয় সিদ্ধান্ত হচ্ছে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা। কিন্তু নজরুল ইসলাম মঞ্জুর একটি বক্তব্য হচ্ছে-সরকারকে মোকাবিলা করার একটি পথ হতে পারে নির্বাচন।
বিএনপির সম্ভাব্য মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে এমন ভাবনাও আছে- তারা জনগণের রাজনীতি করেন, যদি জনগণ চায় তাহলে তারা প্রার্থী হবেন। এই যদি কোনো কোনো ক্ষেত্রে যে বাস্তবে হয়ে যেতে পারে তাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এদিকে রাজশাহীতে বিএনপির মেয়র প্রার্থী না থাকলেও বরিশাল খুলনা, গাজীপুর ও সিলেটে মেয়র প্রার্থীও দেখা যেতে পারে, যাদের রাজনৈতিক পরিচয় হচ্ছে বিএনপি। কিন্তু কাউন্সিলর প্রার্থীদের বিষয়টি ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে। তারা নির্বাচন করবেন। এবার দল থেকে যদি তাদের বহিষ্কারও করে তাতেও তাদের বসে থাকার সম্ভাবনা কম। খবর হয়েছে একমাত্র সিলেটেই কাউন্সিলর হিসেবে শতাধিক বিএনপি নেতাকর্মী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
প্রশ্ন হচ্ছে- সিটি করপোরেশনের এই নির্বাচন বিএনপির আন্দোলনে কি প্রভাব ফেলতে পারে। জবাবটা খুব জটিল মনে হয় না। বড় শহরগুলোকে বাদ দিয়ে অন্যান্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আন্দোলনকে শক্তিশালী করা কি সম্ভব হবে? সিটি করপোরেশনের মেয়র কিংবা শীর্ষস্থানীয় বিএনপি নেতা কিন্তু শুধু নিজ এলাকাতেই নয় আশেপাশের এলাকাগুলোতেও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকেন। তাদের গ্রহণযোগ্যতা এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্র শুধু নিজ সিটি করপোরেশনেরই সীমাবদ্ধ থাকে না। সুতরাং এই নির্বাচন বিএনপির আন্দোলনের জন্য নিয়মতান্ত্রিক বাধা হিসেবে আসবেই।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/জিকেএস