দেশজুড়ে

প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে হরিজনদের কাজে

স্বপন বাশফোর (৩৮)। হরিজন সম্প্রদায়ে জন্ম তার। ৩০ বছর ধরে বংশ পরম্পরায় তিনি মানুষের বর্জ্য-ময়লা পরিষ্কার কাজের সঙ্গে জড়িত। একসময় বালতি ও কোদালই ছিল ভরসা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে কাজের ধরণ। হাতের স্পর্শ ছাড়াই মেশিনের সাহায্যে পয়ঃনিষ্কাশন ও বর্জ্য-ময়লা পরিষ্কার করেন তিনি।

Advertisement

স্বপন বাশফোর জামালপুরের সরিষাবাড়ী পৌরসভার আরামনগর বাজার এলাকার মৃত রতন বাশফোরের ছেলে। তিনি ছাড়া এখানে প্রায় ১৫-১৭টি পরিবারের বসবাস।

স্বপন বাশফোর জানান, এখন আর আগের মতো তাদের ঝামেলা নেই। সারাদেশের হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন জাপানের তৈরি মেশিন দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করেন। তিনিও জামালপুর শহর থেকে একটি মেশিন সংগ্রহ করেছেন। এতে খরচ হয়েছে ১৭ হাজার টাকা। ছয়-সাত বছর ধরে তিনি মেশিনটি ব্যবহার করছেন।

তিনি আরও জানান, এখন মল পরিষ্কার করলে শরীরে লাগে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রোজগারেও গতি এসেছে। আগে একটি টয়লেট পরিষ্কার করতে ৫০০-১০০০ নিলেও এখন ৩-৪ হাজার টাকা পাই। সময়ও অনেক কম লাগে।

Advertisement

হরিজন সম্প্রদায়ের লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের কাজে সরকারি কোনো অনুদান পান না। তাই আক্ষেপের যেন কমতি নেই তাদের। অনেক কষ্ট করে সংসার চালাতে হয় তাদের। আবর্জনা পরিষ্কার করে আশপাশের পরিবেশ ঠিক রাখলেও তারাই অবহেলিত। আছে লাঞ্ছনা-বঞ্চনাও।

সরেজমিনে সরিষাবাড়ী পৌরসভার আরামনগর বাজার সংলগ্ন হরিজন পল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, ঘনবসতির কয়েকটি ঘর নিয়ে ছোট্ট একটি পাড়া। সেখানে শতাধিক হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন বাস করে। একসময় এটি মেথরপট্টি হিসেবেও পরিচিত ছিল। চিরচেনা এই পল্লীটি আগে নোংরা ও চিৎকার-চেঁচামেচিপূর্ণ থাকলেও পরিবেশ বদলেছে। কাঁচা-আধাপাকা ঘর এখন পাকা ও দ্বিতল ভবনে রূপ নিয়েছে। অনেকেই পেশা বদলে বিভিন্ন কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। তাদের সন্তানরাও বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করছেন।

হরিজন সম্প্রদায়ের নারী সদস্য মালা বাশফোর (৩২) বলেন, অধিকাংশই বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে ধরে আছেন। অনেকেই অন্য কাজও করছেন। তবে আমরা স্বপ্ন দেখি আমাদের সন্তানরা মানুষের মতো মানুষ হবে। দেশের সেবায় নিয়োজিত হবে।

তবে হরিজনদের দুঃখ, তাদের কোটাও এখন অন্য ধর্মাবলম্বীরা দখলে নিয়েছে। অফিস-আদালতের পরিচ্ছন্নতাকর্মীর পদে আবেদন করতে গেলে সেখানেও টাকা ও প্রভাবশালীদের দাপটে বঞ্চিত হন।

Advertisement

লেখক ও প্রাবন্ধিক জাকারিয়া জাহাঙ্গীর বলেন, আমাদের সংবিধানে দেশের সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষের জন্য সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন যুগ যুগ ধরে সামাজিকভাবে তাচ্ছিল্যের শিকার। তবে বর্তমানে তাদের বসবাস ও পেশার ধরণ পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু তাদের জন্য নির্ধারিত পেশা, বিশেষ করে বিভিন্ন দপ্তরের পরিচ্ছন্নতাকর্মীর পদগুলো মুসলমানসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ ভাগ বসিয়েছেন। তাও রাজনৈতিক দাপট ও মোটা অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে— যা আমাদের জন্য লজ্জার ও দুঃখজনক।

দেশের প্রতিটি মানুষকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হরিজনদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানসহ সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি।

সরিষাবাড়ী পৌরসভার মেয়র মো. মনির উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে সারাদেশেই। এখানে পিছিয়ে নেই হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজনও। তারা এখন হাতের স্পর্শ ছাড়াই উন্নত প্রযুক্তিতে তৈরি মেশিন দিয়ে পয়ঃনিষ্কাশন করছেন। এতে একদিকে যেমন সময় অপচয় কমেছে, অন্যদিকে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেছে। দেশের প্রতিটি নাগরিককে চলমান উন্নয়নে অংশীদার করতে বর্তমান সরকার হরিজনদের জন্যও কাজ করে যাচ্ছেন।

এসজে/জিকেএস