জাতীয়

‘ঈদে বাড়ি যাইতে পারি নাই, ২ মাসের বাসাভাড়া বাহি’

মো. সোহেলের বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপায়। তিনি রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার দিনমজুর। তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে পাঁচ সদস্যের সংসার তার। যাত্রাবাড়ীর শেখদীতে বাসা। কষ্টে দিন যাচ্ছে সোহেলের।

Advertisement

সোমবার (১ মে) সকালে যাত্রাবাড়ীর শনিরআখড়া ব্রিজের (আন্ডার পাস) ঢালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম সড়কের মুখে সোহেলের সঙ্গে কথা হয়। ভোর থেকে আরও অনেকের মতো শ্রম বিক্রির জন্য এখানে এসেছেন সোহেল।

সোহেল বলেন, কাম (কাজ) একেবারেই কইম্যা গ্যাছে। পুরা রোজার মাসে মাত্র ৯/১০ দিন কাম করছি। ঈদের পরও কাম নাই। ঈদে মা-বাবার কাছে দ্যাশে যাইতে পারি নাই। দুই মাসের বাসা ভাড়া বাহি (বাকি) পড়ছে। মালিক চিল্লাচিল্লি করে। হাজার দশেক টাহা অইলে বাসা ভাড়া শোধ করে দ্যাশে চইল্লা যামু।

তিনি বলেন, দ্যাশে যাইয়া খালি খাওন খরচডা হইলেই অইবে। হেইডা পারমু। ঢাকার মতো বাড়ি ভাড়ার ট্যানশন তো থাকলো না।

Advertisement

সোহেলের মতো দিনমজুরদের এমনই কষ্টে যাচ্ছে দিন। তারা দাবি করছেন, মানুষ এখন ভবন নির্মাণ কিংবা দিনমজুর সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজ কম করছে। মাসে ১০ থেকে ২০ দিনের বেশি কেউ কাজ পাচ্ছেন না।

কাজ কমে যাওয়ায় মজুরদের চাহিদা কমে গেছে। তাই জীবিকার তাগিদে অনেককেই কম মজুরিতে কাজ করতে হচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বমুখী হলেও মজুরি কমছে শ্রমিকদের। তাই দুর্মূল্যের বাজারে মজুরি বঞ্চনায় কঠিন সংকটে রাজধানীর দিনমজুররা।

শনিরআখড়ার মতো এমন শ্রম বিক্রির অস্থায়ী বাজার জুরাইন, যাত্রাবাড়ী, ফকিরাপুল, শান্তিনগর, মিরপুর, বাসাবো, মানিকনগর, নয়াবাজারসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আছে বলে জানিয়েছেন শ্রমিকরা।

সকাল ৬টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত শ্রমিকরা এসব স্থানে অবস্থান করেন। যারা কাজ করাবেন তারা এসে দরদাম করে শ্রমিক নিয়ে যান। কাজের জন্য তাদের বহু দূর-দূরান্তে যেতে হয়।

Advertisement

সোমবার সকাল ৭টার দিকে দেখা গেছে, শনিরআখড়ায় শত শত শ্রমিক ভিড় জমিয়েছেন। কেউ দাঁড়িয়ে আছেন। টুকরি, কোদালসহ জিনিসপত্র কাছে রেখে বসে আছেন কেউ। কাজের জন্য শ্রমিক প্রয়োজন এমন কেউ এলেই অনেকেই ঘিরে ধরছেন তাকে। তবে ক্রেতার সংখ্যা ছিল খুবই কম।

বিভিন্ন শ্রেণির শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দৈনিক মজুরি রাজমিস্ত্রী ও কাঠমিস্ত্রীদের ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা, রং মিস্ত্রীদের ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, মাটিকাটা ও ইট-বালু টানা শ্রমিকদের ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা।

রাজমিস্ত্রীর হেলপার মো. আক্কাস। তার গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ। ঢাকায় তিনি একাই থাকেন। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে স্ত্রী থাকেন গ্রামে।

আক্কাস বলেন, ‘রডের দাম এত বাইড়্যা গেছে যে, মানুষের বাড়িঘর বানানোর অবস্থা আর নাই। তাই কাজও কইম্যা গেছে। যা কামাই করি, নিজে খামু না দ্যাশে পাডামু। নিজের খরচের পর আর কিছু থাহে না।

তিনি বলেন, বাড়ি-ঘরের কাম করি। কিন্তু মাঝে মাঝে ড্রেন পরিষ্কারেও যাই। কী করমু, বাইচ্যা তো থাহন লাগবো।

আক্কাস বলেন, শ্রমিক কম, সবাই দ্যাশ-গ্রাম থেকে এহনও আয়ে নাই। তাও ৩০০-৪০০ জনের কম না। কিন্তু এরমধ্যে ৫০ থেকে ১০০ জনের বেশি কাম পাইবো না।

রাজমিস্ত্রী মকবুল হোসেনের বাড়ি পটুয়াখালীর দশমিনায়। তিনি বলেন, একদিন কাম করি আর পাঁচ-ছয়দিন বাইয়া থাহি। খরচা তো আর বইয়া থাহে না। জিনিসপত্রের যে দাম, আমাগো মরা ছাড়া উপায় নাই। ঈদের পর ১০ দিন গ্যালেও কাম করছি একদিন।

ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না বলে দাবি করেছেন মাটিকাটা শ্রমিক মঈনুদ্দিন। তিনি বলেন, একজন মাটিকাডা শ্রমিক বা রাজমিস্ত্রীর হেল্পারের মজুরি দিনে ৭০০ টাহার কম হওয়া উচিত না। কিন্তু অনেকে ৫০০ টাহায়ও যায়। কী করবো? কাম কম, মনে করে একদিন বইয়া থাহার চাইতে কম পাইলেও ভালা। খাওন খরচটা তো ওডে।

এখানে অনেক নারী দিনমজুরও আসেন। তাদের একজন খাদিজা বেগম। খাদিজার বাড়ি কুমিল্লা, তার চার সন্তান। তার স্বামীও দিনমজুর।

খাদিজা বলেন, কাম একবারে কইম্যা গেছে। রোজার মাস কষ্টে গ্যাছে। বাসা ভাড়া দিতে পারি না। এই ঈদে বাড়ি যাইতে পারি নাই। খাইতে পাই না, বাড়ি যামু ক্যামনে।

আরেক নারী দিনমজুর মর্জিনা বেগম। তার গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়। তিনি বলেন, আমার স্বামী থাইক্যাও নাই। এক পোলা। রোজার মাস তো বইয়াই থাকলাম। ঈদের পর দুইদিন কাম করছি। চাইলের দাম বাড়ে, মাছের দাম বাড়ে, বাসা ভাড়া বাড়ে, আমাগো মজুরি বাড়ে না। মজুরি আরও কমে। ৪০০-৫০০ টাহায়ও আমরা যাই।

দিনমজুর মো. হাসানের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর। হাসান বলেন, এক ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায়ই থাহি আমি। বড় একটা মাছ কতদিন আগে কিনছি মনে নাই। মাংসের কতা তো চিন্তাই করি না। ঈদের পর একদিন মাত্র কাম করছি। আমগো অবস্থা ভালো না।

রাজমিস্ত্রীর সহকারী ফারুক হোসেনের বাড়ি হবিগঞ্জ। ফারুক বলেন, ছেলের বয়স ৭ বছর হইয়া গ্যাছে। এহনও স্কুলে ভর্তি করাইতে পারি নাই। খাইয়া বাঁচমু, না বাচ্চাগো স্কুলে পড়ামু? মাসে ১০/১৫ দিনের বেশি কাম নাই।

তিনি বলেন, জিনিসপত্রের যে দাম, মজুরি রোজ এক হাজার টাহা অইলেও অয় না। কিন্তু মানুষ ৫০০/৬০০ টাহার বেশি দিত চায় না। এই টাহা দিয়া ঘরভাড়া দিয়ে ডাল-ভাত খাওয়া ছাড়া উপায় নাই। মাছ-মাংসের কতা আমরা চিন্তাও করতে পারি না।

হবিগঞ্জের আরেক দিনমজুর কতরউদ্দিন নতুন বিয়ে করেছেন। তিনি চার মাস ধরে ঢাকায় আছেন। তিনি বলেন, বউয়ের বাচ্চা হবে। দ্যাশে মা থাহে, চাইর মাসে মায়রে চাইরডা ট্যাহাও পাডাইতে পারি নাই। ক্যামনে পাডামু, নিজেই তো টিকতে পারতাছি না। বলতে গেলে রোজার মাসে কামই করতে পারি নাই। সামনে আমাগো আরও কঠিন দিন আইতাছে।

আরএমএম/এমএইচআর/জিকেএস