দেশজুড়ে

খনিতে ঝরে প্রাণ, জীবনে নামে পঙ্গুত্বের অভিশাপ

আজ ১ মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। প্রতি বছরের মতো এবারও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য- ‘শ্রমিক-মালিক ঐক্য গড়ি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলি’। শ্রমিকদের শ্রমে-ঘামে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির চাকা সচল থাকলেও শ্রমিকরা আজও অবহেলিত। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫০ বছরেও ঘুরেনি শ্রমিকদের ভাগ্যের চাকা।

Advertisement

খনি শ্রমিকদের কথাই ধরা যাক। খনি থেকে উত্তোলন করা সম্পদে দেশ ও জাতির উন্নয়ন ঘটলেও খনি শ্রমিকদের জীবনমান এখনো তলানিতে। যারা জীবন বাজি রেখে খনিজসম্পদ উত্তোলন করতে গিয়ে পঙ্গত্ব বরণ করেন কিংবা নিহত হন, তাদের জীবনের নিরাপত্তা আজও নিশ্চিত করা যায়নি। নিরাপত্তাহীনতা আর জীবনের ঝুঁকি নিয়েই প্রতিদিন খনিজসম্পদ আহরণ করতে হয় তাদের। এতে হরহামেশা প্রাণ হারান কিংবা পঙ্গুত্ববরণ করেন অনেক শ্রমিক।

দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির কয়লা দিয়ে তাপবিদ্যুৎ উৎপান করে আলোকিত হচ্ছে দেশ। সেখানকার মধ্যপাড়া কঠিন শিলা (পাথর) খনির পাথর দিয়ে হচ্ছে রাস্তাসহ দেশের নানামুখী উন্নয়নকাজ। এ দুই খনিগর্ভে কাজ করতে গিয়ে অনেক শ্রমিক হতাহত ও পঙ্গুত্ববরণ করছেন। অথচ এসব শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তায় নেই ন্যূনতম কোনো উদ্যোগ।

বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিএমসিএল) তথ্যানুযায়ী, ২০০৫ সালে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার পর থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কয়লা উত্তোলন কাজে পাঁচজন দেশি শ্রমিক প্রাণ হারান। গুরুতর আহত হন চারজন এবং সামান্য আহত হন ৭১ শ্রমিক। সূত্রের তথ্যানুযায়ী, সামান্য আহত ৭১ শ্রমিক বিসিএমসিএল ও চীনা কনসোর্টিয়ামের সহায়তায় দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা নিয়ে পুনরায় কাজে যোগদান করেন। হতাহত অন্য শ্রমিকদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।

Advertisement

দেশের উৎপাদনশীল বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ভূগর্ভে কাজ করতে গিয়ে পঙ্গুত্ববরণকারী কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিনিধির। তারা হলেন- দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার খলিলপুর সর্দারপাড়া গ্রামের মো. ইদু সর্দার, দক্ষিণ রসুলপুর গ্রামের শহিদুল ইসলাম ও কাজিপাড়া গ্রামের আমিনুল ইসলাম। তারা সবাই বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির শ্রমিক ছিলেন। খনিগর্ভে কাজ করার বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনাজনিত কারণে তারা প্রত্যেকেই আজ পঙ্গু। খনিতে তাদের এখন চাকরিও নেই। পরিবার-পরিজন নিয়ে খনি দুর্ঘটনার সেই ভয়াবহ স্মৃতিটুকু সম্বল করে আজও তারা বেঁচে আছেন।

কথা হয় খনিতে কাজ করতে গিয়ে চিরতরে এক পা হারানো মো. ইদু সর্দারের সঙ্গে। পার্বতীপুর উপজেলার খলিলপুর সর্দার পাড়া গ্রামে তার বাড়ি। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, অনেকদিন আগের কথা, সম্ভবত ২০০৪ সালে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ভূগর্ভে কাজ করার সময় হঠাৎ কয়লা বহনের ট্রলি ছুটে এসে গায়ে পড়ে, আর কিছু বলতে পারি না। সাতদিন পর ঢাকার একটি হাসপাতালে নিজেকে দেখলাম, শরীরে দেখি বাম পা নেই। দেড় মাস চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে বেকার হয়ে পড়ি। খনি থেকে প্রথম দিকে মাসিক আড়াই হাজার টাকা করে পেতাম। বর্তমানে তিন হাজার টাকা পাই। এক ছেলে ও এক মেয়ের সংসার। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি মানুষের সাহায্য নিয়ে। আর ছেলে কলেজে পড়ে। ওই তিন হাজার টাকা আর কিছু সাহায্য চেয়ে সংসার চালাতে হয়।

মো. শহিদুল ইসলাম বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ভূগর্ভে (মাটির নিচে) কালো মানিক (কয়লা) আহরণের কাজ করতেন। ২০০৫ সালে মাটির নিচে এক দুর্ঘটনায় তার মেরুদণ্ডের কোমরের অংশে ভেঙে যায়। প্রথমে দিনাজপুরে, পরে ঢাকায় চিকিৎসা নেন। কিন্তু আজও পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বেঁচে আছেন। ওই অবস্থায় দুই মেয়ের বিয়ের জন্য বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিএমসিএল) সিএসআর (করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিট) তহবিল থেকে সাহায্যের আবেদন করলেও কোনো লাভ হয়নি। পরে মেয়েদের বিয়ে দিতে অন্যদের সহায়তা নেন।

শহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, খনি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে যা পাওয়া যায় তা চাহিদার তুলনায় নগণ্য। পঙ্গুত্বের পর প্রথমে মাসিক ১,২০০ টাকা, পরে দেড় হাজার, দুই হাজার, আড়াই হাজার এবং বর্তমানে তিন হাজার করে পাই। এ দিয়েই খেয়ে-না খেয়ে বেঁচে আছি।

Advertisement

বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে কাজ করার সময় পা হারানো আরেক শ্রমিক খনি সংলগ্ন কাজিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. আমিনুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলতে তার বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। প্রতিবেশীরা জানান, পা হারানোর পর খনির চাকরিটাও যায়। এরপর অনেকটা নিঃস্ব হয়ে জীবনযাপন করছেন আমিনুল ইসলাম। একমাত্র মেয়েকে অনেক কষ্টে বিয়ে দিয়েছেন। অভাবের সংসারে নানা অশান্তি, প্রায় সময়ই বাড়িতে থাকেন না। কোথায় যান, কোথায় থাকেন তার কোনো ঠিক নেই।

এ বিষয়ে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিএমসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. সাইফুল ইসলাম সরকার জাগো নিউজকে জানান, হতাহত শ্রমিকদের মধ্যে কিছু শ্রমিককে এককালীন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে মাসে তিন হাজার এবং আহতদের পরিবারকে চার হাজার করে টাকা দেওয়া হয়। ঈদে কিছু বোনাসও দেওয়া হয়।

খনি শ্রমিকদের নিারাপত্তা ও অধিকার বিষয়ে জানতে চাইলে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি জাকির হোসেন বলেন, আমাদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিয়ে কিছু দাবি রয়েছে। শুনেছি, নতুন চুক্তিতে শ্রমিকদের অধিকারকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তার কোনো কাগজপত্র আমরা দেখিনি। ৫৫ বছর বয়স হলে শ্রমিক খনিতে কাজ করার যোগ্যতা হারান। তখন তাকে খালি হাতে ঘরে ফিরতে হয়। আমরা চাই, চাকরিজীবন শেষে একজন শ্রমিককে এককালীন অর্থ সহায়তা দেওয়া হোক। যেন জীবনের বাকিটা সময় সে মোটামুটি ভালোভাবে কাটাতে পারে বা অন্য কিছু করে চলতে পারে।

দিনাজপুরের আরেক খনি মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (মধ্যপাড়া পাথর খনি) (এমজিএমসিএল) খনিতে কাজ করতে গিয়েও অনেক শ্রমিক হতাহত বা পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। এমনই তিনজন পঙ্গু শ্রমিক হলেন- পার্বতীপুরের খাগড়াবন্দ গ্রামের রাসেল সরকার, দক্ষিণ মধ্যপাড়ার লিটন এবং রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার মোকাররম হোসেন। তাদের মধ্যে খনি দুর্ঘটনায় রাসেল বাম হাত আর মোকাররম হারান বাম পা। দুজনই খনি থেকে ক্ষতিপূরণ বাবাদ চার লাখ টাকা করে পেলেও পঙ্গুত্ব নিয়ে তাদের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ।

খনি দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ববরণকারী ও নিহতদের বিষয়ে কথা বলতে এমজিএমসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু দাউদ মুহম্মদ ফরিদুজ্জামানের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোনকল রিসিভ করেননি।

 

এমদাদুল হক মিলন/এমকেআর/জিকেএস