রুবেল মিয়া নাহিদ
Advertisement
‘তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান, তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান’ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘কুলিমজুর’ কবিতার এই অসামান্য লাইন দুটো জানান দেয় শ্রমিকের সম্মান, প্রকৃত মর্যাদা।
আজ পহেলা মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও দাবি আদায়ের দিন। মেহনতি মানুষের বিজয়ের দিন, আনন্দ ও সংহতি প্রকাশের দিন আজ। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামের স্মারক দিবস হিসেবে ১ মে সারা বিশ্বে ‘মে দিবস’ পালিত হয়। বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নতির মূলে রয়েছেন এ দেশের সৃজনশীল শ্রমিকরা। শ্রমিকদের জীবন নিয়ে টানা-হেঁচড়া যেমন কারওই কাম্য নয়, তেমনি সবার শ্রমিকবান্ধব হওয়াও বাঞ্ছনীয়। একইসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, দেশ ও জাতির উন্নয়নে শ্রমিকদের মর্যাদা অতি আবশ্যক। শ্রমিকদের মর্যাদা ব্যতীত দেশ ও জাতির উন্নয়ন সাধন সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন: শিশুকে কাঁদাতে পারলেই মিলবে পুরস্কার
Advertisement
দেশজুড়ে করোনার প্রকোপ কিছুটা কাটলেও এখনো কর্মহীন অনেক মানুষ। এর মাঝে সেই বিশেষ দিনটিতে এবার তাগিদ উঠেছে জীবন ও জীবিকা একসঙ্গে বাঁচানোর। অনেকে কর্মহীন হয়ে বসে আছেন ঘরে। আবার কারও জীবনে আজকের সূর্যও উঠেছে অন্যান্য দিনের মতো ব্যস্ততা নিয়ে। কারণ কাজ না করলে মিলবে না খাবার। মে দিবস উপলক্ষে সব সরকারি, আধাসরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হলেও সমাজের বৃহদাংশকেই সাত-সকালে বেড়িয়ে পড়তে হয়েছে রুটি-রুজির সন্ধানে। কারও আবার মেলেনি ছুটি। ছুটির দিনের কাজের জন্যও মেলে না তাদের বাড়তি অর্থ। অনেককেই আট ঘণ্টার স্থলে কাজ করতে হচ্ছে ১৪-১৫ ঘণ্টা। পান না ওভারটাইম। কেউ আবার জানেনই না মে দিবস কী। অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রম খাতের পাশাপাশি কিছু প্রাতিষ্ঠানিক খাতেও স্থান পায়নি মে দিবসের মর্মবাণী। শ্রমিক আন্দোলনের ১৩৭ বছরেও মে দিবস তাদের জীবনে বয়ে আনেনি কোনো তাৎপর্য। বেশ কয়েকজন শ্রমজীবীর সঙ্গে কথা বলে মে দিবস নিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হলো-
নির্মাণশ্রমিক আলতাফ হোসেন বলেন, ’বইয়া থাকলে কেহ টাহা দিয়া যাইবে? আমাগো কোনো মে দিবস নাই। মে দিবসে বড় বড় কোম্পানির কাম (নির্মাণকাজ) বন্ধ থাহে’।
আরও পড়ুন: পুরান ঢাকার ৫ ভৌতিক স্থান
দিনমজুর আব্দুর রহিম, থাকেন মঠবাড়িয়ার দাউদখালী ইউনিয়নে। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে তার সংসার। তিনি বলেন, মাটিকাটা, পাইপ লাগানো থেকে শুরু করে আরও অনেক কাজ করেন। কোনোদিন কাজ পান আবার কোনোদিন পান না। সাধারণত দিনে পাঁচশ টাকা মজুরি ও খোরাকি পান। এর কম-বেশিও হয়, নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর। আর কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট নয়। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের মজুরি সরকার নির্দিষ্ট করে দিলে ভালো হয়। কিন্তু এটা আমরা কার কাছে বলবো? আর আমরা বললেই কি সরকার তা করবে’।
Advertisement
গৃহকর্মী তসলিমা আক্তার বলছিলেন মে দিবস নিয়ে তার ভাবনার কথা। ‘মে দিবস হেইডা আবার কি? কামের বেডিগো ছুটি আছে? কন কী? কাম না করলে কেউ ভাত দেবে? যাগো বাসায় রান্দি, আমি না গেলে হেরা খাইবে কি? থালা-বাসন কেডা ধুইবে? ছুটি কাটাইলে চাকরি থাকপে না। বছরের ব্যাবাক দিনই মোগো লাইগা সমান’।
যেভাবে শুরু মে দিবস১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা উপযুক্ত মজুরি আর দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। আজ মহান মে দিবস। মাঠে-ঘাটে, কল-কারখানায় খেটে-খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে রক্তঝরা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। দীর্ঘ বঞ্চনা আর শোষণ থেকে মুক্তি পেতে ১৮৮৬ সালের এদিন বুকের রক্ত ঝরিয়ে ছিলেন শ্রমিকরা। সেদিন শ্রমিকরা আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের সব শিল্পাঞ্চলে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন। শ্রমিক সমাবেশকে ঘিরে শিকাগো শহরের হে মার্কেট রূপ নেয় লাখো শ্রমিকের বিক্ষোভ সমুদ্রে।
বিক্ষোভের এক পর্যায়ে পুলিশ শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালালে নিহত হন ১০-১২ জন শ্রমিক। ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে শিকাগোর রক্তঝরা লড়াইকে স্বীকৃতি দিয়ে ওই ঘটনার স্মারক হিসেবে ১ মে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের ‘দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ’-এর দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়। সেই থেকে পহেলা মে পালিত হয় শ্রমিকদের আত্মদান আর দাবি আদায়ের দিন হিসেবে।
লেখক: তড়িৎ প্রকৌশলী,ফিচার লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী।
কেএসকে/জিকেএস