রমজান ও ঈদের দীর্ঘ অবকাশ শেষে আবার ব্যস্ত হয়ে উঠছে জনজীবন। সাথে ব্যস্ত হচ্ছে রাজনীতির মাঠও। আপাতত রাজনীতির সব আলাপ পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘিরে। প্রকৃতির উত্তাপ এখনও নির্বাচনের গায়ে লাগেনি। তবে নির্বাচনের ট্রেন গতি পেতে না পেতেই উত্তাপ সেখানেও ছড়াবে বলে ধারণা সবার।
Advertisement
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে পাঁচ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে তাদের মনোনয়ন ঘোষণা করেছে। বিএনপি যথারীতি বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ব্যাপারে অনড়। মনে হতে পারে, বিএনপি আসবে না বলে আওয়ামী লীগ আবারও ফাঁকা মাঠে গোল দেবে। আবার বিএনপি যেহেতু নির্বাচনেই আসবে না, তাই এই নির্বাচন নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু মাঠের হিসাব অত সহজ নয়। বরং দুই দলই নিজেদের ঘর সামলানো নিয়ে বিপাকে আছে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটি নির্বাচনকে অনেকে ফাইনালের আগে সেমিফাইনাল বলছেন। আর ফাইনাল খেলতে নামার আগে সেমিফাইনালে নিজেদের শক্তি সামর্থ্য দেখানোটাও জরুরি। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ অনেকদিন ধরেই তৃণমূল পর্যায়ে ঐক্যের ওপর জোর দিচ্ছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচন দিয়েই তারা জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতিটা সেরে রাখতে চায়। কিন্তু শঙ্কা হলো, সিটি নির্বাচনই মাঠ পর্যায়ে আওয়ামী লীগের অনৈক্যের দুয়ার খুলে দিতে পারে।
রমজান ও ঈদের কারণে বিএনপির আন্দোলনে ভাটা পড়েছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল ঈদের পর আন্দোলন চাঙা করবে। কিন্তু সিটি নির্বাচনের হাওয়া তাদের আন্দোলনকে ভাসিয়ে নিতে পারে। তারচেয়ে বড় কথা হলো, সরকারবিরোধী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তির জন্য নির্বাচন বর্জনে অনড় থাকাটা জরুরি। কিন্তু বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন বর্জন করলেও দলের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কতটা নির্বাচনের বাইরে রাখতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে দলের ভেতরেই। বিশেষ করে কাউন্সিলর হতে আগ্রহী নেতাদের নির্বাচনের বাইরে রাখা সত্যি মুশকিল হবে। তারচেয়ে বড় কথা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপ-নির্বাচনে উকিল আব্দুস সাত্তারের মতো আরও কেউ কেউ পল্টি মারেন কি না সন্দেহ আছে তা নিয়েও। বিএনপির এখন তাই আন্দোলন গতিশীল করার চেয়ে, ঘর সামলানোর দিকেই বেশি মনোযোগ দিতে হবে।
Advertisement
আগামী ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভোট। এরপর ১২ জুন খুলনা ও বরিশাল এবং ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশনের ভোট হবে। সবার আগে নির্বাচন হবে গাজীপুরে। মনে হচ্ছে সবচেয়ে বড় নাটকটাও হবে এখানেই। গাজীপুরে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন দলের প্রবীণ ও ত্যাগী নেতা আজমত উল্লাহ খান। টঙ্গী পৌরসভার সাবেক মেয়র এর আগেও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পেয়েছিলেন তিনি। তবে জিততে পারেননি।
গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। তবে বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে দল থেকে বহিষ্কৃত হন তিনি। একই সঙ্গে বরখাস্ত করা হয় মেয়র পদ থেকেও। দলের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হলেও এবার মনোনয়ন পাননি তিনি। দলের বাইরে গিয়ে নির্বাচনের মাঠে নামেন তিনি। তবে বাছাইয়ে ঋণখেলাপির অভিযোগে তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে গেছে।
এমন আশঙ্কা তিনি আগে থেকেই করছিলেন। তাই তার মা জায়েদা খাতুনের নামেও একটি মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। নিজেরটা বাতিল হলেও মায়ের মনোনয়নপত্র বৈধ হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, মাকে সামনে রেখে নির্বাচনের মাঠে থাকবেন জাহাঙ্গীর। মনোনয়নপত্র দাখিলের দিনই জাহাঙ্গীর আলম বলেছিলেন, তিনি গ্রেপ্তার হতে পারেন, গুম হতে পারেন। তবু নির্বাচন থেকে সরবেন না।
তার দাবি, তিনি দলের বিরুদ্ধে নয়, ব্যক্তির বিরুদ্ধে তার নির্বাচন। জাহাঙ্গীর আলম যদি শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকেন, তাহলে আজমত উল্লাহর জন্য নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়াটা সহজ হবে না। আজমত উল্লাহর জন্য আরও অস্বস্তি নিয়ে এসেছেন শাহ নূর ইসলাম। দলে তার কোনো পদ না থাকলেও গাজীপুরের প্রভাবশালী বিএনপি নেতা হাসান উদ্দিন সরকারের ভাতিজা শাহ নূর ইসলাম বিএনপি নেতাকর্মীদের আশীর্বাদ পেতে পারেন।
Advertisement
আওয়ামী লীগের জন্য অস্বস্তি আছে সিলেটেও। আওয়ামী লীগের আগের প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের মৃত্যুতে সিলেটে প্রার্থী বদলটা অনিবার্য ছিল। কিন্তু যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর মনোনয়ন পাওয়াটা আওয়ামী লীগের মাঠের নেতাকর্মীরা ভালোভাবে নেননি। উড়ে এসে জুড়ে বসা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর বিপক্ষে দলের কোনো প্রার্থী নেই বটে, তবে অভিমানের চোরা স্রোত তাকে বিপাকে ফেলতে পারে।
গত দুই নির্বাচনে জয় পাওয়া বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরীর ভাগ্য ঝুলে আছে বিএনপির সিদ্ধান্তের ওপর। এখন পর্যন্ত আরিফুল হক চৌধুরী কোনো সিদ্ধান্ত জানাননি। তবে লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে, আরিফুল হক চৌধুরী দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নির্বাচনে অংশ নেবেন। সেটা হলে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই পক্ষের জন্য অস্বস্তির কারণ হবে।
আরিফুল হক চৌধুরী নির্বাচনে এলে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর জন্য জেতা সহজ হবে না। কারণ তখন আরিফুল হক চৌধুরী আওয়ামী লীগের বিক্ষুব্ধ অংশের সমর্থন পেতে পারেন। তবে আরিফুল হক চৌধুরী নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপির নির্বাচন বর্জনের নৈতিক অবস্থান অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়বে।
বরিশালে আওয়ামী লীগের কাহানী ঘর ঘর কা। বরিশালে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ। গত নির্বাচনে জিতে মেয়র হয়েছিলেন তার ছেলে সাদিক আব্দুল্লাহ। তবে নানা কারণে বিতর্কিত সাদিক আব্দুল্লাহ এবার মনোনয়ন পাননি। আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর ভাই, সাদিক আব্দুল্লাহর চাচা খোকন সেরনিয়াবাতকে।
বরিশালের আগামী দিনের রাজনীতির গতিপথ এবার নির্ধারিত হবে নির্বাচনের ফলাফলের পর। নির্বাচনের মাঠ সামলানোর আগে খোকন সেরনিয়াবাতকে ঘর সামলাতে হবে। তবে বরিশালের প্রয়াত বিএনপি নেতা ও সাবেক মেয়র আহসান হাবিবের ছেলে কামরুল আহসান নির্বাচনে অংশ নিতে চান। শেষ পর্যন্ত কামরুল আহসান নির্বাচনে এলে আওয়ামী লীগের গৃহবিবাদের সুবিধা পেতে পারেন তিনি।
খুলনায় বর্তমান মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। গত নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম নির্বাচন করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি এলে নির্বাচন জমে উঠতে পারে।
আওয়ামী লীগ সবচেয়ে নির্ভার রাজশাহীতে। বর্তমান মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনের ওপরই ভরসা রেখেছে দল। অবশ্য ভরসা রাখার মতো কাজও করেছেন তিনি। রাজশাহী এখন দেশের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ও পরিবেশবান্ধব শহর। রাজশাহীতে আওয়ামী লীগে কোনো অন্তর্দ্বন্দ্ব বা বিএনপির কারও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ইঙ্গিত মেলেনি। তবে সব সিটিতেই বিএনপির স্থানীয় নেতারা কাউন্সিলর পদে লড়বেন বলেই মনে হচ্ছে।
সব মিলিয়ে সিটি নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলই বিপাকে আছে। নির্বাচনের ফলাফলের চেয়ে ঘর সামলানো নিয়েই তাদের দুশ্চিন্তা বেশি।৩০ এপ্রিল, ২০২৩
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস