মতামত

শ্রমিকের বঞ্চনা এবং বেকারত্বের বেদনা

মে দিবস এলে শ্রমিক অধিকারের বিষয়টি উচ্চারিত হয়। এবারের মে দিবসেও যথারীতি উচ্চারিত হবে শ্রমিক অধিকারের নানা কথা। কিন্তু দিবসকেন্দ্রিক আনুষ্ঠানিকতায় যতটা জোরেশোরে শ্রমিক অধিকারের কথা উচ্চারিত হয়, বাস্তবের সঙ্গে তার যে বিস্তর ব্যবধান, সেটি লেখার অপেক্ষা রাখে না।

Advertisement

বাস্তবতা হচ্ছে, শ্রমিকদের বঞ্চনার ইতিহাস নতুন নয়। দেশে দেশে, কালে কালে নানাভাবে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষ। রাত-দিন পরিশ্রম করেও তারা ঠিকমতো মজুরি পায় না। তার ওপর বেতন বকেয়া থাকা, কথায় কথায় শ্রমিক ছাঁটাই, লক আউট— এসব কারণেও শ্রমিকদের দুর্দশার সীমা থাকে না।

কর্মস্থলের পরিবেশ নিয়েও রয়েছে অভিযোগ। অনেক ফ্যাক্টরির কাজের পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত নয়। ঝুঁকিমুক্ত নয় অনেক কর্মস্থল। ফলে কাজ করতে গিয়ে অনেককে জীবনও দিতে হয়। সঠিক অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা না থাকায় অনেক শ্রমিকের জীবন গেছে।

তামাকজাত কারখানা, চামড়া, লবণ, জাহাজ ভাঙাসহ এজাতীয় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে স্বাস্থ্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগতে হয় শ্রমিকদের। কিন্তু তারা কোনো চিকিৎসা সুবিধা পায় না, মৃত্যু হলে ক্ষতিপূরণও পাওয়া যায় না। সার্বিকভাবে বাংলাদেশে শ্রমিকদের জীবন তাদের জন্য কল্যাণকর নয়, এটি বলা যায়। অনেক ক্ষেত্রে বেতন-ভাতা আদায়ের জন্য রাস্তায় নামতে হয় তাদের। কিন্তু সেখানেও নানা ঝক্কি। পুলিশের লাঠিপেটা, মালিকের চোখ রাঙানি। চাকরিচ্যুতির ভয়। এ যেন অমোঘ নিয়তি।

Advertisement

বাংলাদেশে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে শিশু শ্রমিকরা। শিশুশ্রম আইনগতভাবে স্বীকৃত নয়। কিন্তু বিশ্বের কোনো দেশই শিশুশ্রমের বাইরে নয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এ সমস্যা আরো প্রকট। বাংলাদেশের শিশুদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই শিশুশ্রমে নিয়োজিত। মূলত দরিদ্র পরিবারে অর্থনৈতিক সহায়তার জন্যই তাদের শ্রমে নিযুক্ত হতে হয়। আর তারা শুধু দিনান্ত পরিশ্রমই করে না, বরং তাদের এমন সব কাজ করতে হয়, যা তাদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী শিশুদের বাধ্যতামূলক শ্রম, সশস্ত্র সংগ্রামে ব্যবহারের জন্য বাধ্যতামূলক নিয়োগ, পর্নোগ্রাফিসদৃশ কোনো কাজে ব্যবহার, মাদকদ্রব্য উৎপাদন ও পাচারে ব্যবহার এবং যেসব ব্যক্তিগত পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে শিশুর স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা কিংবা নৈতিকতার ক্ষতিসাধন করে, তা শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কাজ বলা হয়েছে।

বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশে এক বিরাটসংখ্যক শিশু এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। ওয়েল্ডিং কারখানা, লবণ ও সাবানের কারখানা, বিড়ি ফ্যাক্টরি, এমনকি ভারী জিনিসপত্র বহনেও তাদের নিয়োগ করা হয়, যা তাদের স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। এমনকি জীবনকে পর্যন্ত হুমকিগ্রস্ত করে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহারের ফলে সারা বিশ্বে প্রতিবছর ২২ হাজার থেকে ২৫ হাজার শিশু প্রাণ হারায়। মধ্যপ্রাচ্যে উটের জকি হিসেবেও শিশুদের ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে বেশির ভাগই বাংলাদেশের শিশু।

শিশুশ্রম অপেক্ষাকৃত সস্তা এবং সহজলভ্য হওয়ায় বাংলাদেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অপরাধমূলক ও অনৈতিক কাজের সঙ্গে তাদের যুক্ত করা হচ্ছে জোর করে। বলা হয়ে থাকে, আজকের শিশুই আগামী দিনের সম্পদ। কিন্তু দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত শ্রমজীবী শিশুদের ভবিষ্যৎ আজ অন্ধকারে নিমজ্জিত।

Advertisement

অধিকারবঞ্চিত এসব শিশুকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে না পারলে দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন কি আদৌ সম্ভব? অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে গার্মেন্ট সেক্টরকে শিশুশ্রমমুক্ত করা গেছে। তাহলে অন্যান্য সেক্টর শিশুশ্রমমুক্ত করতে বাধা কোথায়? একদিকে স্কুলগামী শিশুদের এক বিরাট অংশ শিশুশ্রমে বাধ্য হচ্ছে, অন্যদিকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা। এই বৈপরীত্যের মানে কী?

বাংলাদেশে নারী শ্রমিকরাও বৈষম্যের শিকার। শুধু নারী হওয়ার কারণে একই শ্রমের ক্ষেত্রে পুরুষ শ্রমিক ও নারী শ্রমিকের মজুরিতে পার্থক্য রয়ে গেছে। ধরা যাক, একজন পুরুষ শ্রমিক সারা দিন ইট ভাঙার কাজ করে ৩০০ টাকা পায়। এ ক্ষেত্রে নারী শ্রমিক পাবে ২৫০ টাকা। এর কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই। তবু চলছে এটিই।

আসলে নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে নারীর সম-অধিকার, সম্পদ ও ভূমিতে সম-অধিকার, কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীর সমান সুযোগ ও অংশীদারি এখনো নিশ্চিত হয়নি। ফলে বৈষম্য রয়েই যাচ্ছে।

বাংলাদেশে রপ্তানি খাতের সর্বোচ্চ স্থানে অবস্থানকারী গার্মেন্টশিল্প খাতের শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। অথচ বাংলাদেশের গার্মেন্ট কারখানাগুলোর অবকাঠামো, কর্মপরিবেশ, শ্রমিকের নিরাপত্তা ও অধিকারের ব্যাপারে আন্তর্জাতিকভাবেই চাপ রয়েছে। কিন্তু গার্মেন্ট মালিকরা এসব বাস্তবায়ন না করায় একের পর এক ঘটছে দুর্ঘটনা।

সরকারের কারখানা পরিদর্শকের কার্যালয়ের লোকবল সংকট, ঝুঁকিপূর্ণ কর্মপরিবেশ, অবহেলাজনিত কারণে সংঘটিত দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি না হওয়া, যৎসামান্য ক্ষতিপূরণ এবং আইনি দুর্বলতা ইত্যাদি কারণে প্রতিবছর নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কিন্তু তাদের পরিবার ক্ষতিপূরণও পাচ্ছে না। অথচ মারাত্মক প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার জন্য ১৯৫৫ সালের আইনে নিহত শ্রমিকের সারা জীবনের আয়ের সমপরিমাণ অর্থ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান রয়েছে।

বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস জনশক্তি রপ্তানি। বিদেশের মাটিতে ঘাম-শ্রম ঝরিয়ে লাখ লাখ প্রবাসী এ দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখছে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, এসব শ্রমিকের অনেকেই বিদেশের মাটিতে গিয়ে নানা রকম প্রতারণার শিকার হয়। যে বেতন দেওয়ার কথা, সেটি দেওয়া হয় না। যে কাজ করার কথা, তার চেয়ে নিম্নমানের কাজ দেওয়া হয়।

এ ছাড়া থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও মানসম্মত হয় না। এসব কারণে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশিদের যেমন মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়, তেমনি তারা কাঙ্ক্ষিত অর্থ উপার্জন করতে না পারায় রেমিট্যান্সপ্রবাহের ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এতে শুধু শ্রমিকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের অর্থনীতিও। দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যদি তাঁদের ওপর অর্পিত কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করতেন, তাহলে এ সমস্যার উদ্ভব হতো না। লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে গিয়ে তারা সামান্য আয় করলে নিজে চলবে কী আর দেশেই বা পাঠাবে কী।

এ অবস্থায় প্রতিশ্রুত বেতন যাতে পায় শ্রমিকরা, সেটি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার কথা। অভিযোগের তীরটা সংশ্লিষ্ট দেশে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসের প্রতিও। বাংলাদেশি শ্রমিক অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশ দূতাবাসের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে শ্রমিকদের সমস্যাদি দেখা। কিন্তু সমস্যা দেখবে তো দূরের কথা, শ্রমিকরা তাদের সমস্যা জানাতে গিয়ে দূতাবাস কর্মকর্তাদের দেখাটা পর্যন্ত পায় না।

অথচ এসব শ্রমিকের অর্জিত অর্থেই দূতাবাসওয়ালাদের বেতন-ভাতা হয়। এই বোধটুকু যদি তাঁদের মধ্যে থাকত, তাহলে শ্রমিকরা কি আর এতটা সমস্যায় পড়ে। এসব বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট দেশে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাস, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সবার সমন্বিতভাবে কাজ করা উচিত, যাতে বিদেশে গিয়ে কোনো অবস্থায় বাংলাদেশি শ্রমিকরা ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত না হয়। শুধু শ্রমিক অধিকারই নয়, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের গতিপ্রবাহ ঠিক রাখতে হলে এটি করতে হবে।

শ্রমিকের অধিকার সংরক্ষণের জন্যই প্রতিবছর পালন করা হয় মে দিবস। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসেবে দিনটি ১৮৯০ সালের ১ মে থেকে পালিত হয়ে আসছে। শ্রমিকদের রাজনৈতিক অধিকার ও আট ঘণ্টা কাজের দাবি আদায়কে কেন্দ্র করে ইউরোপে গড়ে ওঠে মেহনতি মানুষের সংগঠন ‘দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক’।

এই দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ১৮৮৯ সালে এক সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেয় যে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগোতে শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদে প্রতিবছর ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস পালন করা হবে। তখন থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পালিত হয়ে আজ তা সর্বজনীনতা লাভ করেছে। আর শ্রমিকের আট ঘণ্টা কাজ করার অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় মে দিবস পালন করা হবে। সভা-সেমিনারে উচ্চারিত হবে অগ্নি-উদ্গারী ভাষণ। কিন্তু আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এখন পর্বতপ্রমাণ বেকার সমস্যা। একদিকে লোকজন কাজ পাচ্ছে না, অন্যদিকে শ্রমিকরা অধিকারবঞ্চিত। নানা রকম বৈষম্যের শিকার। সেখানে মে দিবস পালন শুধুই আনুষ্ঠানিকতাপূর্ণ আয়োজন হয়তো বা। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধতাড়িত সমাজব্যবস্থা এই স্বরচিত অন্ধকারে পথ দেখাতে পারে। এই আত্মোপলব্ধি কাজ করুক সবার মধ্যে। এটিই প্রত্যাশা।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। ডেপুটি এডিটর, জাগো নিউজ। drharun.press@gmail.com

এইচআর/জিকেএস