জাতীয়

কমছে জলাভূমি ও বনায়ন, বাড়ছে উষ্ণায়ন-খরা

দ্রুত বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশের ঋতু। শীতে শীত নেই, বর্ষায় বৃষ্টি নেই, বছরের বেশিরভাগ সময় অনুভূত হচ্ছে গরম। বছরের বিভিন্ন সময় শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষার দেখা মিললেও সেসবের সময় বা ক্ষণ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ সময় খরা বা তাপপ্রবাহের তীব্রতায় জনজীবনের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই উষ্ণায়ন বা নির্দিষ্ট ঋতুর প্রভাবে হেরফের হচ্ছে। তারা মনে করেন, এ সমস্যার সমাধানে বিশ্বের দায়ী তথা মোড়ল দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। একই সঙ্গে জাতীয়ভাবেও সচেতনতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

Advertisement

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের নগরায়ন আর শিল্পায়নের ফলে সৃষ্ট অবকাঠামো বাড়ছে। এর বিপরীতে কমছে জলাভূমি, বন ও সবুজ। এগুলো সংরক্ষণে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

আরও পড়ুন: জলবায়ু পরিবর্তনে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে বাংলাদেশ

বনভূমি পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের (জিএফও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে ২ লাখ ৫৩ হাজার বর্গকিলোমিটার বনভূমি এলাকা উজাড় হয়েছে।

Advertisement

শুধু ২০২১ সালেই নয়, প্রায় প্রতিবছরই বিশ্বে এ বিশাল পরিমাণ বনভূমি উজাড় হচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, বিশ্বে প্রতিবছর যে পরিমাণ বনভূমি উজাড় হচ্ছে তার তুলনায় বাংলাদেশে এর পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।

এফএওর হিসাবে, বিশ্বজুড়ে গত ১৫ বছরে প্রায় ১ দশমিক ৪ শতাংশ বন উজাড় হয়েছে। বাংলাদেশে তা ২ দশমিক ৬ শতাংশ। যেখানে বাংলাদেশে বছরে ২ হাজার ৬০০ হেক্টর বন উজাড় হচ্ছে।

আরও পড়ুন: বৈশ্বিক উষ্ণতা: সবুজ পৃথিবী রূপ নিচ্ছে মরুভূমির

বন উজাড় হওয়ার ছোবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না সংরক্ষিত বনাঞ্চলও। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বাংলাদেশের ফুসফুস খ্যাত সংরক্ষিত বন ‘সুন্দরবন’র বিস্তার ও ঘনত্ব দিন দিনই কমেছে। বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণ-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত দুই দশকে সুন্দরবনের গাছপালার পরিমাণ মারাত্মকভাবে কমেছে। কমেছে বনের ঘনত্বও। বন উজাড় হয়ে ফাঁকা ও পতিত জমির পরিমাণ বাড়ছে। সুন্দরবন আগের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। একসময় বাংলাদেশ অংশে এ বনের বিস্তার ছিল ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটার, সেটি এখন কমে ৬ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটারে নেমেছে।

Advertisement

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বন বিভাগের উপস্থাপিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারাদেশে ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৫৮ একর বনভূমি দখল হয়ে গেছে। ১ লাখ ৬০ হাজার ৫৬৬ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান এসব বনভূমি জবরদখল করে রেখেছেন। বনের জমি দখল করে ঘরবাড়ি নির্মাণ, কৃষিকাজ থেকে শুরু করে তৈরি করা হয়েছে শিল্পকারখানা।

এবার রমজান মাসে দীর্ঘ সময়জুড়ে গরমের তীব্রতা অর্থাৎ তাপদাহে ভুগেছে মানুষ। চৈত্র মাসের এমন চিত্র স্বাভাবিক হলেও তাপমাত্রা ছিল গত কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। শুধু তা-ই নয়, গত বছরের বর্ষা মৌসুমেও বৃষ্টির দেখা মেলেনি। এবারও তেমন পরিবেশ থাকবে বলে আশঙ্কা বিজ্ঞজনদের। তারা বলছেন, সৃজনটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে। যখন বৃষ্টি হওয়ার হচ্ছে না। যখন শীত হওয়ার হচ্ছে না। যখন তাপ কম থাকার থাকছে না। অতিবৃষ্টি বা অতিগরম চলে আসছে বাংলাদেশেও।

আরও পড়ুন: মৌলভীবাজারে ‘সিগারেটের আগুনে’ পুড়লো আড়াই একর বন

এ বিষয়ে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর এ তিন মাস আমরা বর্ষাকাল হিসেবে চিহ্নিত করে থাকি। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। কিন্তু গত বছর জুলাইতে তুলনামূলক কম বৃষ্টি হয়েছে, আগস্টেও বৃষ্টি নেই বললেই চলে। আবার জুনের শেষে ও জুলাই মাসের শুরুতে প্রতিবেশী দেশ ভারতে অতিবৃষ্টির কারণে আমাদের সিলেট অঞ্চলে ব্যাপক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি বলেন, অতিমাত্রায় বৃষ্টি আবার অনাবৃষ্টি বা বৃষ্টিশূন্যতা; এটা সাধারণত আগে দেখা যেত না। মোটাদাগে এই পরিস্থিতির জন্য আমরা দুটি কারণ চিহ্নিত করেছি। এর একটি হলো বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন। এর ফলে বৃষ্টিপাতের সময় ইনটেনসিটি ও ডেনসিটি এগুলো পরিবর্তন হয়ে গেছে। উপমহাদেশে এর একটি প্রভাব আছে। যার ফলে জুলাই মাসে যে বৃষ্টি হওয়ার কথা বা মৌসুমি জলবায়ুর যে প্রধান বৈশিষ্ট্য- এই সময়ে দক্ষিণপূর্ব দিক থেকে বায়ু প্রবাহিত হওয়ার কথা এবং বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা, আমরা এবার সেটি লক্ষ্য করিনি। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের একটি বড় প্রভাব।

আরও পড়ুন: বৈশ্বিক উষ্ণতা করোনাভাইরাসের চেয়ে মারাত্মক

দ্বিতীয় কারণ ব্যাখ্যা করে ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, অন্য কারণটি হলো স্থানীয় কারণ। বৃষ্টি হওয়ার জন্য যে ম্যাকানিজম; বিভিন্ন জলাভূমি থেকে সূর্যের আলোর মাধ্যমে পানির বাষ্প হওয়ার কথা, এটি গলিভূত হয়ে মেঘ আকার ধারণ করবে এবং বৃষ্টি আকারে পতিত হবে, সেটি ঠিকঠাক হচ্ছে না। এই জলীয়বাষ্প দুটি মাধ্যমে হয়। গাছের প্রস্বেদনের মাধ্যমে; যেখানে গাছ মাটির নিচ থেকে শিকড়ের মাধ্যমে পানি সংগ্রহ করবে এবং সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় সূর্যের আলোর মাধ্যমে এটি করবে। এ প্রক্রিয়ায় উপজাত বা বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে জলীয়বাষ্প ছাড়বে গাছ। যত বেশি গাছ তত বেশি জলীয়বাষ্প। এই জলীয়বাষ্পগুলোই উপরে যাবে এবং বৃষ্টির আকার ধারণ করতে সহযোগিতা করবে।

তিনি বলেন, একদিকে জলাভূমির পরিমাণ কমছে, অন্যদিকে সবুজের পরিমাণও সংকুচিত হচ্ছে। বিপরীতে বেড়ে যাচ্ছে নির্মাণ এরিয়া, নগরায়ন এবং শিল্পায়ন। প্রচুর কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে এবং পরিবর্তিত হয়ে বিভিন্নভাবে অবকাঠামো হচ্ছে। এর কারণে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এছাড়াও আরও কিছু কারণ আছে।

এই পরিবেশ বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ খুব একটা দায়ী নয়। দায়ী রাষ্ট্রগুলোকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে সমস্যা দূর করতে বেশি করে গাছ লাগাতে হবে। বনাঞ্চলীয় এলাকায় উন্নয়ন প্রকল্প বাদ দিতে হবে। গ্লাসকো চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে।

আরও পড়ুন: ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড অ্যান্টার্কটিকায়

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোকাদ্দেম জাগো নিউজকে বলেন, বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি জড়িত বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বা গ্রিন হাউজ প্রক্রিয়া। যার কারণে সারাবিশ্বে এমন খরা। বাংলাদেশে আমরা দেখতে পাই, ৪২ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি খরা ছিল গত বছর। গোটা ইউরোপে ৫০০ বছরের মধ্যে ভয়াবহ খরার প্রকোপ। শুধু তাই নয়, একদিকে খরা অন্যদিকে উষ্ণায়ন প্রক্রিয়া। চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া বিরাজ করছে। গত বছরের এ সময়ে (জুন, জুলাই, আগস্ট) প্রাকৃতিক নিয়মে প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা তো হয়নি, বরং প্রকৃতিতে শুষ্ক-রুক্ষ একটা অবস্থা ছিল। আবার একই সময়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের চেরাপুঞ্জিতে গত ১০৩ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। যার প্রভাবে আকস্মিক বন্যায় প্লাবিত হয় আমাদের সিলেট অঞ্চল।

তিনি বলেন, গত বছর একই সময়ে (জুন, জুলাই, আগস্ট) দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ১১ দিনে তিনটি নিন্মচাপ হয়েছিল। যার কারণে জোয়ারের পানি স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে দুই ফিট বেশি উচ্চতায় উঠে যায়। এতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। উষ্ণায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। আমেরিকাতেও চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার কারণে দাবানলে হাজার হাজার হেক্টর ভূমি ও গাছপালা ধ্বংস হচ্ছে। স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, গ্রিস ও ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বনাঞ্চলেও দাবানল হচ্ছে। উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলেও ভয়াবহ খরা দেখা দিচ্ছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রক্রিয়া এ বৈরি আবহাওয়ার অন্যতম কারণ।

খরা ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ বিধান চন্দ্র দাস জাগো নিউজকে বলেন, সৃজনই তো পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা, হচ্ছে না। তখন হয়তো অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি হচ্ছে। এটা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এ থেকে উত্তরণের বিষয়টি বাংলাদেশের হাতে নেই। এটা বৈশ্বিক সংকট। এটি বৈশ্বিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। গত বছরের জলবায়ু সম্মেলনে (কপ২৬) অনেক তর্ক-বিতর্কের পর এক সমঝোতায় পৌঁছেছিলেন বিশ্বনেতারা। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তো সব শেষ করে দিল। সামনে কী হবে, আমরা সে অপেক্ষায় আছি।

এসইউজে/এমকেআর/জেআইএম