তরুণী বয়স থেকেই তার কথায় চলনে বলনে বদলে দেবার অঙ্গীকার। নিজেকে তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। আর আজ যখন তার বয়স প্রায় ষাটের কোঠায় তখনও তিনি আগের মত সমান তারুণ্যের দীপ্তি ছড়ানো আবেগী মানুষ। অন্যায়, অবিচার, উগ্র মৌলবাদের নখর থেকে নারীদের রক্ষা করতে সব সময় সামনের কাতারে থাকেন। বলছিলাম গাইবান্ধার নারী আন্দোলনের পথিকৃত আমাতুর নূর ছড়ার কথা। তার সম্পর্কে বলতে গিয়ে এই ভূমিকাটুকু যথেষ্ট নয়। কোথায় যেন কমতি থেকে যায়। গাইবান্ধার মাস্টার পাড়ার বাসিন্দা হলেও এই নারী নেত্রীর পৈত্রিক বাড়ি জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার রামজীবন ইউনিয়নের সাহাপাড়া এলাকায়। বাবা কলিম উদ্দিন মন্ডল আর মা ওমর খৈয়াম মাহমুদা এর পরিবারে তারা ছয় ভাই তিন বোন। তাদের মধ্যে ছড়ার অবস্থান পঞ্চম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই তার দস্যিপনা দেখে বাবা মা গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসতেন। তবে তারা এটা জানতেন যে, একটু আধটু দুষ্টুমি করলেও তাদের আদরের মেয়ে কোন অন্যায় বা অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত হতেই পারে না। বড়জোর কেউ অন্যায় করলে মুখের উপর প্রতিবাদ করবে। গ্রামাঞ্চলে লেখাপড়া তেমনভাবে হতো না। তাই তাকে ভর্তি করে দেয়া হয় গাইবান্ধা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে। গাইবান্ধা শহরে এসে উঠেন মামা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক প্রখ্যাত আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ খালেদ এর বাড়িতে। ১৯৭০ সালে তিনি যখন দশম শ্রেণির ছাত্রী তখন পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে ফুঁসছে সারাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ছাত্র জনতা সংগঠিত হচ্ছে। ডাকসাইটে মামার স্নেহ ও সাহচর্য পেলেও কি করে যেন বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আরেক মামা খলিলুর রহমানের প্রভাব তার উপর পড়ে। খালাতো ভাই মাসুদুর রহমান ফারুক ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। মনে মনে আমাতুর নূর ছড়াও মামা ও ভাইয়ের রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করতে শুরু করেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাকে ফিরে যেতে হয় সুন্দরগঞ্জে। প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা তখন এলাকায় ঢুকতে শুরু করেছেন। ঝুঁকি নিয়ে তাদের এক গ্রুপের সঙ্গে আরেক গ্রুপের যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে যান তিনি। গোপনে চিঠি পৌঁছে দিয়ে আসাই ছিল তার কাজ। এক্ষেত্রে মামা মোহাম্মদ খালেদ তাকে অনুপ্রাণিত করেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে তিনি ভর্তি হন গাইবান্ধা মহিলা (পরবর্তীতে সরকারি) কলেজে। এবার সরাসরি জড়িয়ে পড়েন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে। তিনি হন কলেজ শাখার প্রচার সম্পাদক। রাজনীতির মাঠে নেমে তিনি দেখতে পান মেয়েদের দুরাবস্থা। এমনকি সচ্ছল পরিবারের মেয়েদের মধ্যে সচেতনতার অভাব দেখে তিনি ব্যথিত হন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন ভবিষ্যতে তিনি নারীদের উন্নয়নে কাজ করবেন। কিন্তু তখন পরিবার ভাবছে অন্য কথা। এইচএসসি পাস করার পর ১৯৭৩ সালে তার বিয়ে হয় বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে। গৃহবধূ হওয়ার পর কিছুটা গুটিয়ে নিতে হয় তার কর্মকাণ্ড। তারপরও স্বামীর আনুকূল্যে চলতে থাকে সামাজিক কাজকর্ম। বিশেষ করে কোথাও নারীর উপর নির্যাতনের খবর পেলে সেখানে তার অনিবার্য উপস্থিতি লক্ষ্য করতো লোকজন। এভাবেই কাটতে থাকে দিন। ১৯৭৪ এ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী আন্তর্জাতিক চক্রের ষড়যন্ত্রের শিকার হয় বাংলাদেশ। খাদ্যের অভাবে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে মানুষ। বঙ্গবন্ধু সরকার প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে। বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠে নঙ্গরখানা। আমাতুর নূর ছড়া ছাত্র সংগঠনের রুটি বানানো, স্যালাইন তৈরির কাজে জড়িয়ে পড়েন। একজন গৃহবধূর পক্ষে সাংসারিক কাজের পাশে যতটুকু সময় দেয়া সম্ভব তিনি দিতেন। তার শ্বশুর আব্দুল কুদ্দুস মিয়ার চালের ব্যবসা ছিল। দুপুরে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর চুপি চুপি তার গোডাউনে ঢুকে চাল চুরি করে নিজের ঘরে লুকিয়ে রাখতেন ছড়া। সেই চাল রাতে সহকর্মীদের হাত ঘুরে পৌঁছে যেত অন্নহীন মানুষের ঘরে। এজন্য অনেক বার পারিবারিকভাবে বকুনিও শুনতে হয়েছে তাকে। এসব কাজের মধ্য দিয়েই নারী নেত্রী হিসেবে আমাতুর নূর ছড়ার উত্থান। গোটা মহুকুমা পরবর্তীতে জেলার সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে তার কর্মের খ্যাতি। এর মধ্যে একে একে তার ঘরে জন্ম নিয়েছে ছেলে আশরাফুল আলম লিটন, শরিফুল আলম পুলক ও মেয়ে শামীমা আক্তার লিমা। পরিবারের সবাইকে সময় দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নারী মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে একাগ্রচিত্তে কাজ করে গেছেন তিনি। তবে সত্যিকার অর্থে নিজের স্বপ্নের ঠিকানা খুঁজে পান তিনি ১৯৮৭ সালে। বেগম সুফিয়া কামালের হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সারাদেশে নারীদের জন্য কাজ শুরু করেন। গাইবান্ধা জেলা কমিটির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির বর্তমান সহ-সভানেত্রী রেখা চৌধুরী তাকে যুক্ত করেন মহিলা পরিষদের সঙ্গে। প্রাক্তন পৌর কাউন্সিলর নাজমা শওকতসহ আরও অনেকের সঙ্গে কাজ শুরু করেন আমাতুর নূর ছড়া। মহিলা পরিষদ হয়ে উঠে তার ধ্যানজ্ঞান। তার মাধ্যমে অনেক তরুণী চলে আসেন মহিলা পরিষদের পতাকা তলে। ব্যক্তিগত কারণে রেখা চৌধুরী ঢাকা চলে গেলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন আমাতুর নূর ছড়া। পরবর্তীতে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে প্রথমে সাধারণ সম্পাদক এবং ২০০৬ সাল থেকে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। নৈতিকতা বিরোধী কাজের সঙ্গে আপোষহীন, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত লড়াকু এই নারী নেত্রী সাধারণ মানুষের বিপুল ভোটে ১৯৯৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধা পৌরসভার সংরক্ষিত নারী আসনের কমিশনার পদে নির্বাচিত হন। তার বিজয়ের দিনটিতেই স্বামীকে হারান তিনি। নারীদের জন্য অসংখ্য ভালো কাজ করেছেন তিনি। আশির দশকের মাঝামাঝি গাইবান্ধা শহরতলীর পুলবান্দি এলাকায় একটি সংখ্যালঘু পরিবারের মেয়ের বিয়ের কথা উঠলেই তিনি পুরানো দিনের মতোই উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন। পাত্র ছিলেন বিত্তশালী বাবার সন্তান। দুজনার প্রেমের সম্পর্ককে বিয়েতে রূপান্তরিত করার ব্যাপারে ছেলের বাবার আপত্তি ছিল। তিনি ছড়াসহ নারী নেত্রীদের আন্দোলনের মুখে জেদ বজায় রাখতে ছেলেকে জেলে পাঠান। হাল ছাড়েননি ছড়া। একান্ত সুহৃদ নাজমা শওকতকে সঙ্গে নিয়ে দুই রাত জেলখানার গেটে বসে থেকে ছেলেকে বাধ্য করেছেন মেয়েটিকে বিয়ে করতে। ২০০৩ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী সাদিয়া সুলতানা তৃষার মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে আন্দোলন শুরু হয়। সেই আন্দোলনে মহিলা পরিষদ তথা আমাতুর নূর ছড়ার ভূমিকা এখনও মানুষের মুখে মুখে। ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে রাজপথে লড়াকু সৈনিক কিংবা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ৭১’র ঘাতক দালালদের শাস্তির দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলনের সামনের কাতারের নেতা আমাতুর নূর ছড়াকে কে আর ভুলতে পারে! তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির জেলা কমিটির সদস্য হিসেবেও উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা রাখেন। সম্প্রতি পৌর নির্বাচনে নারী প্রার্থীদের জন্য নির্ধারিত মার্কা বিরোধী আন্দোলনেও তিনি ছিলেন অন্যতম রূপকার। আমাতুর নূর ছড়া বলেন, অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে তাকে বার বার প্রভাবশালীদের হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে। সামাজিকভাবে তাকে খাটো করার চেষ্টাও কম করা হয়নি। প্রসঙ্গত, সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুরের কুখ্যাত কাদের চোরের কথা। ধর্ষণসহ নানা অপকর্মের কারণে এলাকাবাসীর আহ্বানে তিনি কাদের চোরকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। অনেক ঘটনার পর কাদের চোরের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। জেল গেটে দাঁড়িয়ে কাদের তাকে বলেছিল, বের হয়ে দেখে নেব। হুমকির মুখে ছড়া কেবলই স্মিত হেসেছিলেন। আমাতুর নূর ছড়া প্রসঙ্গে মহিলা পরিষদের জেলা সম্পাদক রিক্ত প্রসাদ বলেন, নারীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সংগঠিত করার কাজটি মূলত আমাতুর নূর ছড়াই গাইবান্ধায় সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে করেছেন। বিশেষ করে নারী নির্যাতন, অ্যাসিড সন্ত্রাস, ধর্মান্ধতা, নির্যাতিতদের চিকিৎসা ও আইনি সহায়তা দানের ক্ষেত্রে তার ভূমিকার কোন তুলনা হয় না। গাইবান্ধার বহুল আলোচিত মেনেকা গণধর্ষণ ঘটনার বিরুদ্ধে গড়ে উঠা আন্দোলনের রূপকার হিসেবেও তাকে মানুষ মনে রাখবে। আমাতুর নূর ছড়ার দীর্ঘকালের সহকর্মী নারী নেত্রী নাজমা শওকত বলেন, গাইবান্ধার মতো একটি মফস্বল শহর থেকে সামাজিক প্রতিকূলতাকে জয় করে কাজ করার মানসিক শক্তি ছড়াকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে। অনেক সীমাবদ্ধতার পরও আজ বিভিন্ন সেক্টরে যারা নারীদের জন্য কাজ করছেন তাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে পূর্বসূরীদের কথা। বিশেষ করে আমাতুর নূর ছড়ার মত নারী নেত্রীকে যিনি ব্যক্তিগত লোভ লালসার উর্ধ্বে উঠে নারীদের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন।আমাতুর নূর ছড়া বলেন, সামাজিক প্রতিকূলতা, নির্যাতিত, বঞ্চিত নারীদের জন্য কাজ করতে গিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে হয়ত অনেক কিছুই পাওয়া হয়নি। তবু কাউকে না কাউকে শৃঙ্খল মুক্তির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতেই হয়। কোন কিছু পাওয়ার জন্য নয়, সুনির্দিষ্ট আদর্শের জন্যই আমার এই লড়াই। এসএস/এমএস
Advertisement