বগুড়ার পাশের জেলা জয়পুরহাট। বগুড়ার আশপাশে সব জেলায় ঘুরতে গেলেও কখনো জয়পুরহাট যাওয়া হয়নি। এবারই প্রথম। আমি ও আমার স্কুল শিক্ষক আশরাফুল আলম মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঘুরতে।
Advertisement
বগুড়ার সোনাতলা থেকে রওনা হলাম ১১ টার দিকে। ১২টার মধ্যেই পৌঁছালাম জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার নান্দাইল গ্রামে। স্যার বললেন, সেখানে একটি ঐতিহ্যবাহী দিঘি আছে। দেখলে তোমার ভালো লাগবে। আমিও স্যারকে বললাম, চলেন।
আরও পড়ুন: দেখতে ভুলবেন না জনপ্রিয় যেসব স্পট
ঢাকা-জয়পুরহাট মহাসড়কের পাশেই সরু রাস্তা দিয়ে এক কিলোমিটার যাওয়ার পরেই দেখলাম বিশাল এক দিঘি। স্যার বললেন এইটাই সেই নান্দাইল দিঘি।
Advertisement
দিঘির চারপাশ কংক্রিটের শান দিয়ে বাঁধানো। আর পাড়ের চারপাশে বিভিন্ন গাছের সমারোহ। মনে হচ্ছে ঘন সবুজ বনের বুক চিরে বয়ে গিয়েছে নদী।
নদী বললাম কারণ এক দেখায় দিঘিকে নদীর মতো মনে হয়। জানলাম প্রায় ৩০০ বিঘা জুড়ে এই পুকুর বিস্তৃত। দিঘির পাশেই আছে নান্দাইল কলেজ।
আরও পড়ুন: সস্তায় প্লেনের টিকিট কাটবেন যেভাবে
দিঘির সামনের সাইটে দুটি ঘাট লক্ষ্য করলাম। সেখানে বেশ কিছু শিশু ও নারী গোসল করছেন। পাশেই বাধা আছে ছোট ছোট বোট। কয়েকটি প্যাডেল বোট ও কয়েকটি ইঞ্জিল চালিত বোট।
Advertisement
চাইলে দর্শনার্থীরা এই নৌকাগুলোতে চড়ে পুরো দিঘিতে ভেসে বেড়াতে পারেন। দর্শনার্থীদের কথা চিন্তা করে দিঘির একদম উপকণ্ঠে একটি গেস্ট হাউজও নির্মাণ করা হয়েছে।
অর্ধপাকা সুন্দর এই গেস্ট হাউজে আছে দুটি রুম। দর্শনার্থীরা দিঘিটি ভ্রমণের পাশাপাশি এখানে রাত্রি যাপনও করতে পারবে। বর্তমানে এই দিঘিটির দেখভালের দায়িত্বে আছে জয়পুরহাট জেলা প্রশাসন।
আরও পড়ুন: মেসির বাড়ির ওপর দিয়ে কেন উড়তে পারে না বিমান?
সেখানে রাত্রিযাপন করতে হলে আগে থেকেই জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে গেস্ট রুম বুক করতে হবে। এছাড়া দিঘির পাড়ে আছে একটি গোলাকার আকৃতির ঘর। সেখানে চাইলে দর্শনার্থীরা আড্ডা দিতে পারবেন।
কথা হয় সেখানে ঘুরতে আসা এক দর্শনার্থীর সঙ্গে। তিনি জানান, তার নাম শামীমা। তিনি গাইবান্ধা সরকারি কলেজে পড়েন। কয়েকজন বান্ধবী মিলে তারা এই দিঘিতে ঘুরতে এসেছেন।
জানা যায়, মৌর্য্য বংশের রাজা নন্দলাল শুকনা মৌসুমে কৃষক প্রজাকুলের চাষ ও খাবার পানির অসুবিধার কথা চিন্তা করে ১৬১০ সালে দিঘিটি খনন করেন। এই রাজার নামেই দিঘিটির নামকরণ করা হয়।
আরও পড়ুন: পাশের দেশে গিয়ে দেখে আসুন বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম প্রাচীর
স্থানীয়দের মতে, একরাতের মধ্যেই পুকুরটি খনন করা হয়েছে। মৌর্য্য বংশের রাজা নন্দলালের স্ত্রী অর্থাৎ রানির ইচ্ছানুযায়ী এক রাতেই কয়েক হাজার শ্রমিক লাগিয়ে এ দিঘিটি খনন করা হয়।
শীতকালে এ দিঘীটিতে প্রচুর অতিথি পাখির আগমন ঘটে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের কারনে বর্তমানে দিঘীটি পিকনিক স্পট হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীসহ নানা পেশার মানুষেরা এখানে পিকনিক করতে আসে।
তবে দিঘিটি এখনো অবহেলা-অযত্নে আছে বলে জানান এই গ্রামেরই এক কৃতি সন্তান আনোয়ার পারভেজ। তিনি বলেন, ‘আশির দশকের শৈশবে দেখেছি এখানে জঙ্গল, উঁচু টিলা ও হাজারো গাছগাছালির আচ্ছাদন। দিঘির স্বচ্ছ পানিতে হাজারো পাখি বিচরণ করেছে। ঘন জঙ্গলঘেরা দিঘির পাড় হাজারো পাখির কলতানে মুখরিত থাকতো।’
আরও পড়ুন: সিলেটের ‘সাদা পাথর’ ভ্রমণে কখন ও কীভাবে যাবেন?
তিনি আরও বলেন, ‘নব্বই দশকে শুরু হয় দিঘির পাড়ের টিলা আর গাছ কেটে শত শত বিঘা জমি দখলের উৎসব। নির্বিচারে টিলা আর গাছ লোপাট করে দিঘির পাড়ে বসতি গড়ে তোলার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। দখল করতে করতে একসময় দিঘির তিনদিকের পাড়ে লোকালয় গড়ে ওঠে।’
‘তবে দিন দিন ঐতিহ্য হারিয়ে শ্রীহীন হয়ে পড়েছে রাজা নন্দলালের কিংবদন্তির স্বাক্ষী উত্তরের সবচেয়ে দীর্ঘতম এই ঐতিহাসিক দিঘি। কিছু সংস্কার ও ভিন্নধর্মী কিছু উদ্যোগ নিলে এখানে পর্যটক আরও বাড়বে ও দর্শনীয় স্থান হিসেবে দেশব্যাপী সুনাম বাড়বে বলে আশা করি।’
লেখক: ফিচার লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী
জেএমএস/জেআইএম