মতামত

এডিপি বাস্তবায়নে ব্যর্থতা ও সরকারের দায়

বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা (এডিপি) বাস্তবায়ন গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। গত ১০ বছরে সরকার যেভাবে দেশের ও রাজধানীর উন্নয়নে তৎপর ছিল চলতি বছরও তো প্রায় সেই রকমই তৎপর। কিন্তু যারা উন্নয়ন প্রজেক্টগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছেন, তারা ঠিক মতো তা বাস্তবায়ন করতে পারছেন না। বলা উচিত তারা তুলনামূলকভাবে আগের বছরগুলোর চেয়ে ব্যর্থ। এই ব্যর্থতার দায় গিয়ে পড়ে সরকারের কাঁধে। অর্থাৎ সরকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে আন্তরিক নয় বা ছিল না বলেই প্রজেক্ট ডিরেকটররাও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেননি।

Advertisement

এই না পারার কারণ, সরকারি তহবিল থেকে সরকারের দেয় অংশ অর্থ যথাসময়ে ছাড় না করা যেমন একটি, তেমনি বিদেশি টাকার অংশও যথাসময়ে না আসাও অন্যতম সংকট। তার মানে হচ্ছে সরকারের দুটি শাখাই তাদের কাজে তেমন স্মার্ট নয়। বিশেষ করে সরকারের অর্থ ছাড়ের ব্যাপারে অ্যাকাউন্টস অফিসগুলো ও মন্ত্রণালয়ের ঢিলেমি যেমন আছে, তেমনি আছে তাদের অদক্ষতা ও খাই মেটানোর বিষয়টি। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।

কোনো মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়ের পরিবার পরিজনরা প্রজেক্ট থেকে গাড়ি নিয়ে আসেন। প্রজেক্টের গাড়ি সচিবের বাড়ির লোকেরা ব্যবহার করেন। এমনকি সেই সব লাক্সারি গাড়ি ব্যবহার করেন সচিব নিজেও। এরকম বহু ঘটনা সংবাদপত্রের পাতায় আমরা পড়েছি। এই রিপোর্টটি পড়ে দেখি-

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৯ মাসে এডিপিতে ব্যয় হয়েছে ৯৮ হাজার ৫২১ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে একই সময়ে খরচের পরিমাণ ছিল ৯৮ হাজার ৯৩৪ কোটি। অর্থাৎ টাকার অঙ্কেও কমেছে বাস্তবায়ন।

Advertisement

প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ৯ মাসে এডিপির সরকারি অংশের ৫৬ হাজার ১৫১ কোটি টাকা ব্যয় করতে পেরেছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা ২ দশমিক ১৫ শতাংশ কম। অন্যদিকে বৈদেশিক ঋণ থেকে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে বরাদ্দের ৫২ শতাংশে পৌঁছেছে, যা গত অর্থবছরে একই সময়ে ছিল ৫০ শতাংশের কিছু কম। যদিও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে অর্থাৎ করোনা অতিমারি আঘাত হানার আগে এটি ছিল ৫৭ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাস অতিমারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ডলারের ঘাটতির কারণে বাংলাদেশ সরকার প্রকল্প বাস্তবায়নে সাবধানী হয়। ফলে সার্বিকভাবে সরকারি তহবিলের ব্যবহার হ্রাস পেয়ে থাকতে পারে।

বৃহৎ বরাদ্দের ১৫টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বাস্তবায়নের দিক দিয়ে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে আছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়টি তাদের মোট বরাদ্দের মাত্র ২৭ দশমিক ২৬ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের খরচেও একই পরিস্থিতি। (সমকাল/১৯ এপ্রিল, ২৩)

এডিপি বাস্তবায়নের এই যে ধীরগতি তা যে সরকারের উন্নয়ন আদর্শ ও তা কার্যকরী পদক্ষেপের মধ্যে ফারাক রয়েছে, তা আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু অতীতে এবং বর্তমানেও এসব ব্যর্থতার জবাব তারা দেন এই বলে যে এডিপি বাস্তবায়নে শতভাগ অর্জন সম্ভব নয়। কেন সম্ভব নয়, এর জবাব আসে এভাবে যে অর্থ ছাড়করাসহ নানা প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক কারণে উন্নয়ন কাজ যথাসময়ে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়ে ওঠে না।

Advertisement

এ ব্যাখ্যা খারাপ নয়। বাস্তবধর্মী ব্যাখ্যা। কিন্তু এর বাইরেও আছে প্রশাসনিক ব্যর্থতা দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালকের যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়েও নানান অভিযোগ রয়েছে। যারা সরকারের প্রজ্ঞাবান ও ক্ষমতাবান সচিবদের গুডবুকে থাকেন, সেই সব আধাদক্ষ, আধা দলবাজ বা ফুলদলবাজ ও দক্ষতায় লেভেনডিসরাই ওই সব লুব্রিক্যান্ট প্রজেক্টের হাল ধরেন। এবং তাদের কাছে মন্ত্রণালয়ের সচিব গাড়ি চাইলে তারা তা দেন। কিন্তু আইনে প্রজেক্টের বাইরের কাউকে প্রজেক্টের বাইরের কাউকে গাড়ি দেওয়ার অধিকার পিডির নেই। এই যে ‘গাড়িঘুষ’, তা একজন পিডিকে বেপরোয়া করে তোলে। সরকার খোঁজ নিলেই এর সত্যতা পাবেন। তিনি লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারলেও সচিবের তাপে তারা বহাল থাকেন। মূলত এভাবেই একজন পিডি ব্যর্থ হন। কিন্তু তার সেই ব্যর্থতার দায় গিয়ে চাপে মন্ত্রণালয়ের কাঁধে।

রাজনৈতিক বিপর্যয় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ উন্নয়ন প্রকল্পের গতিকেই কেবল মন্থর করে দেয় না, অনেক ক্ষেত্রে লন্ডভন্ডও করে দেয়। অতিমারি কোভিডের কারণে অনেক উন্নয়ন কার্মকাণ্ডের গতি শূন্য হয়ে যায়। সেটা যতটা না অতিমারির ভয়ে, তারও চেয়ে ওই সুযোগটাকে ব্যবহার করে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে নেওয়ার দুর্নীতিপরায়ন ইচ্ছায়।

গত অর্থবছরে বড় আকারের উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধি ও সময়ক্ষেপণ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলেছে। কোভিডের পর এলো ইউক্রেন বনাম রাশিয়ার যুদ্ধ। অনেক দূরের এই ছোট বাংলাদেশেও তার খারাপ অভিঘাতটি এসে আমাদের অর্থনীতিতে আঘাত হেনেছে। সেই কারণেও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায়। এটা আমাদের মতো লিস্ট ডেভেলপ্ট দেশের জন্য কেবল ক্ষতিকরই নয়, আমাদের অগ্রগামিতার জন্যও ক্ষতির।

ডলার সংকট তীব্র না হলেও বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলে প্রচণ্ড চাপ করেছে। যার কারণে সরকার একমাত্র খাদ্যশস্য বাদের সব ধরনের আমদানিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ করছে। সেই ধারা এখনো অব্যাহত। সেই সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতি এবং ব্যাংক ব্যবস্থায় যে লিকুইডিটি সংকট ছিল বা এখনো আছে, তার ধকলও সহ্য করতে হচ্ছে সরকারকে। ফলে সরকারের নাভিশ্বাস না উঠলেও তার শ্বাসকষ্ট পষ্টই দেখা যায়। যদিও সরকার তা স্বীকার করবেন না।

স্বীকার না করলেও তার একটি রূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি ছোট বড় আকারের উন্নয়ন প্রকল্পে ধীরলয়ে চলার মধ্যেই। এই ধীরগতির পেছনে অর্থসংকট অন্যতম।

সরকারের মন্ত্রীরা এবং তাদের রাজনৈতিক প্রশাসনের কর্মকর্তারা যদি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অধিক সময় ব্যয় না করতেন, যদি নিজ নিজ তরফের উন্নয়ন কাজ তদারকি করতেন নিবিড়ভাবে, তাহলে কিন্তু ওই যে ২.৪৯ ভাগ উন্নয়ন কম হয়েছে গত বছরের চেয়ে, সেই ঘাটতি আমাদের দেখতে হতো না। আমাদের মনে হয়, সরকারের মন্ত্রীদের রাজনৈতিক বিরোধীদের নিয়ে বাকোয়াজ না করে তার ডেভেলপমেন্ট কাজে মনোযোগী হওয়া। বিশেষ করে কিছু মন্ত্রী আছেন যারা সর্বক্ষণই বিরোধী দল বিএনপির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করাই যেন তার দায়িত্ব।

রাজনৈতিক মাঠে এই রকম ব্যস্ততার দরুন, মন্ত্রণালয়ের মাঠে তিনি বা তারা সময় দিতে পারেন না। এজন্য আমার একটি প্রস্তাব আছে সরকারের কাছে। যারা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাবেন তারা রাজনৈতিক মাটের মেঠো বক্তৃতায় যাবেন না। এদের তৃণমূল স্তরের কোনো রাজনৈতিক প্রোগ্রামেও দাওয়াত দেওয়া হবে না। অর্থাৎ তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করবেন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য। লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য এর চেয়ে ভালো কি ব্যবস্থা হতে পারে? আর যারা রাজনৈতিক মাঠে থাকবেন, তারা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করবেন রাজনৈতিক বক্তৃতার কনটেন্ট দিয়ে।

টিটকারী সর্বস্ব রাজনৈতিক বক্তৃতা ও বিদ্বেষমূলক আচরণ দিয়ে আর যাই হোক, গণতান্ত্রিক রাজনীতি হতে পারে না। এরকম রাজনীতি চলতেও পারে না। গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে অবমুক্ত করতে হবে সব কিছুর আগে। সে দায়িত্ব সরকারের। কেননা, সরকার ক্ষমতায় থেকে যে সব সুবিধা ভোগ করে, সেই পুলিশি শক্তি ও সাহস নিয়ে রাজনীতি চলতে পারে না। রাজনীতির মাঠ ‘পুলিশমুক্ত’ করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/এমএস