নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক জোট। সংকট সমাধানে সংলাপের পরামর্শ দিচ্ছেন বিশিষ্টজনরা। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংলাপে আগ্রহী নয়। সম্মত নয় বিএনপিও। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সর্বদলীয় অংশগ্রহণে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার নানামুখী চাপ আছে সরকারের ওপর। এ অবস্থায় বিএনপি জোট যদি ভোটে না আসে তাহলে নির্বাচন পুরোনো পথে হাঁটবে কি না তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।
Advertisement
দীর্ঘদিন ধরে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি। এ দাবিতেই তারা ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও শেষ পর্যায়ে সেটি প্রত্যাখ্যান করে। এবার দলটির শক্ত অবস্থান— এ সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না।
আরও পড়ুন>> ঈদের পর কি আন্দোলন আরও চাঙা করবে বিএনপি?
এদিকে, আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করতে দেশি-বিদেশি নানা চাপ আছে সরকারের ওপর। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও চাইছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। কিন্তু তারা বিএনপির মতো দলের সঙ্গে সংলাপে রাজি নয়।
Advertisement
এনিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, ‘কার সঙ্গে সংলাপ করবো? আপনারা পারবেন বাবা-মা ভাইয়ের খুনিদের সঙ্গে সংলাপ করতে? তারপরও দেশের স্বার্থে তাদের সঙ্গে সৌজন্য রক্ষা করতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা সে পথ রুদ্ধ করেছে। খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে মারা যাওয়ার পর সান্ত্বনা দিতে গিয়েছি, দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।...’
সরকারি দল সংলাপে রাজি না হলেও নির্বাচন কমিশন সব সময় আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের কথা বলে আসছে। এ নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বরাবরই বলছেন, ‘বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঠিক বোঝাপড়া থাকতে হবে। আমরা সব বড় রাজনৈতিক দলকে অনুরোধ করছি, কোনো ফাঁক-ফোকর থাকলে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে হবে, যাতে সবাই নির্বাচনে অংশ নেয়।’
সিইসির এ আহ্বানের পাশাপাশি সংকট সমাধানে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনায় আমন্ত্রণও জানান। বিএনপি সে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছে।
আরও পড়ুন>> কলেবর বাড়ছে আওয়ামী জোটের!
Advertisement
এনিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা নির্বাচন কমিশনে কোনো আলোচনায় যাবো না। কারণ নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করা অর্থহীন।’
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র আট মাস বাকি। এর মধ্যে কোনো সুরাহার আলামত নেই রাজনৈতিক অঙ্গনে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে, সহসা সে সংকট কাটছে না।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রিপরিষদের এক সদস্য জাগো নিউজকে বলেন, ‘সংলাপ/সমঝোতার আর সুযোগ নেই। সংলাপ হবেও না। সংবিধানের আলোকে বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচন হবে। এখন বিএনপির যে অবস্থান, তাতে তারা নির্বাচনে আসতেও পারবে না। আবার নির্বাচন নিয়ে কোনো অভিযোগ করারও সুযোগ/জায়গা থাকবে না।’
আরও পড়ুন>> ভোটের ৯ মাস বাকি, সমঝোতায় নেই অগ্রগতি
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের বক্তব্য হচ্ছে- সংবিধান অনুযায়ী স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন হবে। সরকার তার রুটিন দায়িত্ব পালন করবে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেবে, ম্যান্ডেট পেলে দেশ পরিচালনা করবে অথবা বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করবে, গঠনমূলক সমালোচনা করবে। এটাই রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব। কেউ নির্বাচনে অংশ না নিলে আওয়ামী লীগের বিব্রত হওয়ার কারণ নেই।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নির্বাচনমুখী দল। আমরা সব সময় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি। নানা সংকটেও আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। জাতির পিতার নেতৃত্বে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের সময়ও নির্বাচনে গেছে আওয়ামী লীগ। আশা করি, বিএনপিও নির্বাচনে অংশ নেবে।’
একই সুর দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল। তাদের নিজস্ব দাবি থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। এটি আওয়ামী লীগের জন্য অস্বস্তিকর হবে কেন? বিএনপি কখন কোন দাবি করে, কখন কোন দাবিতে অনড় থাকে তা নিয়ে গবেষণা করলে যে কেউ একটি চমৎকার অভিসন্দর্ভ রচনা করতে পারবেন। তা দিয়ে একদিকে পিএইচডি পাওয়া সম্ভব, অন্যদিকে অভিসন্দর্ভটি বেশ পাঠকপ্রিয় হতে পারে।’
আওয়ামী লীগের এই সাংগঠনিক সম্পাদকের দাবি, ‘বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে এদেশে অবাধ, নিরপেক্ষ, জনঅংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এবার বিএনপি শেষ সময় পর্যন্ত নির্বাচনী লড়াইয়ে থাকবে। তাদের মুরব্বিরা সেভাবেই গাইড করছেন।’
তবে এনিয়ে বিএনপির বক্তব্য ভিন্ন। তারা মনে করছেন, তাদের দাবি মেনে সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে।
দলটির সহ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদে বিএনপি দলীয় সাবেক হুইপ রুমিন ফারহানা জাগো নিউজকে বলেন, আগামী নির্বাচন ২০১৪ বা ২০১৮-এর স্টাইলে হবে না। সরকারের ওপর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তীব্র চাপ আছে। আমাদের বন্ধু ও সহযোগী রাষ্ট্র থেকে বারবার বলা হচ্ছে- নির্বাচন হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক। আর অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি মুখ্য। নির্বাচনের এখনো সাত-আট মাস বাকি। নির্বাচনকালীন সরকারটি এখন আলোচনায় গুরুত্ব পাবে। আমরা আমাদের দাবি আদায়ে সর্বোচ্চ আন্দোলন করবো।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘একটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন জাতি প্রত্যাশা করে। কোনো রাজনৈতিক দল যদি তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে, সেটা তাদের ব্যাপার। কাউকে তো জোর করে নির্বাচনে আনার সুযোগ নেই। তবে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো- যেসব দল নির্বাচনে আসতে চায় না, কেন আসতে চায় না, তাদের কী চাওয়া-পাওয়া, সেগুলো আলোচনা করে জেনে সরকারের সঙ্গে আলাপ করা। অর্থাৎ, আমি বলতে চাইছি, এমন পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ অবস্থান হলে সংলাপের প্রয়োজন আছে। নির্বাচন কমিশন সংলাপের আয়োজন করতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে গণমাধ্যমে দেখেছি- নির্বাচন কমিশনও সংলাপের জন্য কয়েকবারই আমন্ত্রণ জানিয়েছে। কিন্তু তারা (বিএনপি) যেভাবে নির্বাচনে যাবে না বলছে, ঠিক একইভাবে সংলাপেও যাচ্ছে না। এটা একটা দেশের জন্য অশনি সংকেতের চিহ্ন। কোনো রাজনৈতিক দল কোনো রকম সংলাপে যাবে না, নির্বাচনেও অংশ নেবে না— এ ধরনের মনোবৃত্তি যদি থাকে, বাংলাদেশের মানুষ এটা গ্রহণ করবে না।’
‘বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রমনা। নূর হোসেনদের আত্মবিসর্জনের ঘটনাও আমাদের জানা। কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ না নিয়ে রাজনৈতিক অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে কি না, সন্দেহ আছে। একটা গণতান্ত্রিক দেশে একটা রাজনৈতিক দল যদি বিলীন হয়ে যায়, সেটাও দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়।’
এসইউজে/এএসএ/এমএস