বিশ্বের মোট লিথিয়ামের অর্ধেকেরও বেশি পাওয়া যায় দক্ষিণ আমেরিকার তিনটি দেশ– আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া এবং চিলিতে। সাদা সোনা খ্যাত এ ধাতুর জন্য ওই তিনটি দেশের বাজারের ওপর অনেক দিন ধরে শুধু ব্যবসায়ীদেরই নয়, ক্ষমতাধর অনেক দেশের সরকারেরও তীক্ষ্ণ নজর।
Advertisement
নানা ধরনের ব্যাটারির তৈরির প্রধান উপকরণ এই লিথিয়াম। বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি তৈরিতেও এর দরকার হয়। ফলে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই ধাতুর সরবরাহ নিশ্চিত করতে তৎপর।
মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের লাতিন আমেরিকা বিভাগের পরিচালক বেনজামিন জেদানের মতে, জ্বালানি বাজার রূপান্তরিত হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রধান শক্তিধর দেশগুলো বিকল্প জ্বালানির প্রয়োজনীয় উপাদানের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আর সেই প্রতিযোগিতার যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে লাতিন আমেরিকা।
আরও পড়ুন>> ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ লিথিয়ামের মালিক হবে চীন
Advertisement
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এই দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছে এবং চীনের তৎপরতা নিয়ে তারা খুবই চিন্তিত।
বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারির প্রধান একটি উপাদান লিথিয়াম
চীনা কোম্পানিগুলো হোয়াইট গোল্ড (সাদা সোনা) নামে খ্যাত লিথিয়ামের মজুত নিশ্চিত করতে অনেক বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা বিশেষভাবে নজর দিয়েছে দক্ষিণ আমেরিকায়। কারণ এই ধাতুর সবচেয়ে বড় মজুত সেখানেই।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, বলিভিয়ার বিভিন্ন খনিতে লিথিয়ামের মজুত প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ টন। আর্জেন্টিনার রয়েছে ১ কোটি ৯৩ লাখ টন এবং চিলির মজুত ৯৬ লাখ টন।
Advertisement
আরও পড়ুন>> লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির গবেষণায় রসায়নের নোবেল জয়
মেক্সিকোর মজুত যদিও মাত্র ১৭ লাখ টন, কিন্তু লিথিয়াম ইস্যুতে দেশটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ এটি যুক্তরাষ্ট্রের পাশে অবস্থিত এবং বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরির বেশ বড় কেন্দ্র হয়ে উঠছে তারা। টেসলা এবং বিএমডব্লিউ সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে, তারা মেক্সিকোয় বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরি করবে।
চিলির নতুন পরিকল্পনাঅস্ট্রেলিয়ার পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম লিথিয়াম উৎপাদনকারী দেশ চিলি। এখন পর্যন্ত সেখানে এই সম্পদ বেসরকারি কিছু কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু চিলির প্রেসিডেন্ট গ্যাব্রিয়েল বরিচ সম্প্রতি নতুন পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। তিনি চান, এই সম্পদের মুনাফা যতটা সম্ভব দেশেই রেখে দিতে হবে।
চিলির প্রেসিডেন্ট চাচ্ছেন, কাঁচামাল হিসেবে লিথিয়াম বিক্রির বদলে তা দিয়ে বৈদ্যুতিক ব্যাটারির মতো নানা পণ্য তৈরি করে বিক্রি করতে। এতে মুনাফার পরিমাণ বাড়বে।
সেজন্য তিনি সরকারি-বেসরকারি খাতের মধ্যে যৌথ সহযোগিতার মাধ্যমে শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে চান, যেখানে লিথিয়ামের মতো প্রাকৃতিক সম্পদভিত্তিক পণ্য উৎপাদন করা হবে।
আরও পড়ুন>> ২০২৩ হবে বৈদ্যুতিক গাড়ির বছর
কিন্তু এই প্রচেষ্টা সহজ নয়। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন শক্তিধর দেশ লিথিয়াম হাতে পেতে উঠেপড়ে লেগেছে।
চীনকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগমার্কিন সেনাবাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান জেনারেল ল্যরা রিচার্ডসন সম্প্রতি সতর্ক করেছেন, চীন লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, প্রযুক্তিগত, তথ্যপ্রবাহ এবং সামরিক প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
গত মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের সেনাবাহিনী বিষয়ক কমিটির সামনে এক শুনানিতে তিনি বলেন, এ অঞ্চলটি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এবং তার সুযোগ নিতে আমাদের বৈরী কিছু পক্ষ যেভাবে অসাধু তৎপরতা চালাচ্ছে, তাতে আমি উদ্বিগ্ন। তারা বিনিয়োগের ভান করছে। আসলে তারা খনি থেকে ধাতু তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
লিথিয়ামসমৃদ্ধ আর্জেন্টিনা, চিলি, বলিভিয়ার প্রসঙ্গ তুলে মার্কিন জেনারেল বলেন, চীন সেখানকার লিথিয়ামে ভাগ বসাতে খুবই আগ্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে এবং তারা অনেকদূর এগিয়েছে।
কী বলছে চীনগত জানুয়ারি মাসে চীনা বার্তা সংস্থা শিনহুয়াকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে চীনের প্রাকৃতিক সম্পদ বিষয়ক মন্ত্রী ওয়াং গুয়াংহুয়া বলেছেন, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের জন্য চীন অন্য দেশের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। ফলে বিশ্ব পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হলে অর্থনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে।
ওজনে খুবই হালকা লিথিয়াম। ছবি সংগৃহীত
চীনা সরকার ২০১৬ সালে প্রকাশিত তাদের জাতীয় প্রাকৃতিক সম্পদ পরিকল্পনায় ২৪টি খনিজ সম্পদকে ‘কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে লোহা, তামা, অ্যালুমিনিয়াম, সোনা, নিকেল, কোবাল্ট, লিথিয়াম এবং রেয়ার আর্থ।
আরও পড়ুন>> দুই চাকায় বৈদ্যুতিক বিপ্লব ভারতে
পরিকল্পনায় বলা হয়, চীনের অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের উন্নয়নে প্রাকৃতিক এসব খনিজ সম্পদ অত্যন্ত জরুরী।
চীনা বিনিয়োগে রকেটগতিদক্ষিণ আমেরিকার খনিগুলোতে বিপুল অংকের টাকা বিনিয়োগ করেছে চীন। আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, চিলির মতো দেশগুলোও চীনের প্রযুক্তি ও পুঁজির সুবিধা নিতে খুবই উৎসাহী। তারা মনে করছে, এতে তাদের স্থানীয় শিল্পেরও উন্নয়ন হবে।
এ বছরের প্রথম তিন মাসে এই তিনটি দেশে চীনা কোম্পানিগুলো খুবই উচ্চাভিলাষী কিছু বিনিয়োগ চুক্তি সই করেছে। চীনের তিনটি কোম্পানি- সিএটিএল, বিআরইউএনপি এবং সিএমও বলিভিয়ার লিথিয়াম উন্নয়ন প্রকল্পে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই পরিসংখ্যান দিয়েছে মার্কিন গবেষণা সংস্থা আটলান্টিক কাউন্সিল।
চিলিতে কয়েকটি চীনা কোম্পানি একটি লিথিয়াম শিল্প পার্ক তৈরির জন্য বিশাল বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
আর্জেন্টিনায় বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরির জন্য ৪০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে চীনের চেরি অটোমোবাইল কোম্পানি। এছাড়া, ২০২২ সালে আর্জেন্টিনার তিনটি এলাকায় দুই দেশ যৌথভাবে কমপক্ষে নয়টি বিনিয়োগ প্রকল্পের ঘোষণা দিয়েছে।
আর্জেন্টিনার একটি লিথিয়াম খনিতে কাজ করছেন এক শ্রমিক। ছবি সংগৃহীত
গবেষণা সংস্থা আটলান্টিক কাউন্সিলের দক্ষিণ আমেরিকা বিষয়ক গবেষক পেপ ঝাং জানিয়েছেন, বলিভিয়ায় গত জানুয়ারি মাসে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে তিনটি চীনা কোম্পানি।
তিনি জানান, এ বছর দক্ষিণ আমেরিকার খনিজ সম্পদ উন্নয়নে চীনা বিনিয়োগ বিশেষ মাত্রা পাচ্ছে। ২০২১ সালে যেখানে চীনের বাৎসরিক বিনিয়োগ ছিল ১১০ কোটি ডলার, সেখানে এ বছর চীন ১৪০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারযুক্তরাষ্ট্র খোলাখুলিই বলছে, কৌশলগত কারণে খনিজ দ্রব্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার।
গত বছর এক বিবৃতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, অনেক আধুনিক প্রযুক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ খনিজ দ্রব্য প্রয়োজন। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্যেও এগুলো দরকার।
আরও পড়ুন>> বিদ্যুৎচালিত গাড়ি বাজারে আনছে অ্যাপল
কম্পিউটার থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক গাড়ি, ব্যাটারি, সোলার প্যানেল বা উইন্ড টারবাইনের মতো পণ্যের উৎপাদনে লিথিয়াম, কোবাল্ট বা রেয়ার আর্থের মতো খনিজ দ্রব্য প্রয়োজন হয়।
বাইডেন জানান, এসব খনিজ দ্রব্যের চাহিদা আগামী কয়েক দশকে ৪০০ থেকে ৬০০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। লিথিয়াম ও গ্রাফাইটের চাহিদা বাড়বে প্রায় চার হাজার গুণ।
ওয়াশিংটন-বেইজিং দড়ি টানাটানিগবেষক বেনজামিন জেদান বলেন, চীন লাতিন আমেরিকায় ব্যাটারি তৈরিতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। ফলে তারা (আমেরিকার চেয়ে) সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
‘যুক্তরাষ্ট্র মূলত চেষ্টা করছে সবুজ প্রযুক্তি তৈরিতে মার্কিন কোম্পানিগুলোকে সাহায্য করার জন্য দক্ষিণ আমেরিকা থেকে কাঁচামাল নিয়ে আসতে। ফলে, দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর কাছে চীনের প্রস্তাব অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে। কারণ চীনারা চাচ্ছে কাঁচামাল না বেঁচে তা দিয়ে পণ্য তৈরি করে রপ্তানি করতে।
জেদান বলেন, বিষয়টি বুঝতে পেরে এখন যুক্তরাষ্ট্রও চীনের পথে যেতে চাচ্ছে। ফলে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের দড়ি টানাটানির মধ্যে পড়ে গেছে দক্ষিণ আমেরিকা।
সূত্র: বিবিসি বাংলাকেএএ/