নারী ও শিশু

সাহসী নারী লাইজুর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

বরিশাল নগরীর দেশীয় পোশাকের সুনামধন্য প্রতিষ্ঠান আচল বুটিক্স। নগরীর অভিজাত বাণিজ্যিক এলাকা চকবাজারে আচল বুটিক্সের বিক্রয় কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠানটি কর্ণধার নাছিমা রহমান লাইজু। বরিশালে লাইজুই প্রথম নারী ঘর থেকে বেরিয়ে দোকানে বসে এক সময় ক্রেতা সামলাতেন। তখন নগরীতে আর কোনো নারীকে দোকানে ক্রেতা সামলাতে দেখা যেত না। একজন নারী হয়ে দোকানে বসে ক্রেতা সামলানোর বিষয়টি তখন অনেকেই ভালো চোখে দেখেনি। বাইরে বের হলে দোকানদার বলে অনেকেই টিপ্পনি  বা ব্যঙ্গ করতো। হাসি-তামাশাও করছে অনেকে। কিন্তু লক্ষ্যে অবিচল লাইজু। কারও সমালোচনাকে পাত্তা দেননি। তাই এখন সফল একজন উদ্যোক্তা লাইজু।কিন্তু একসময় লাইজুর জীবনটা স্থবির করে দিয়েছিল বিয়ে। ১৯৮৮ সালের কথা। স্কুলের গণ্ডি পেরোতে না পেরোতেই অমতেই তাকে বিয়ে দিলেন মা-বাবা। পড়াশোনা শেষে চিকিৎসক হবেন সেটাই ছিল তার স্বপ্ন। শেষ পর্যন্ত পরিবারের সিদ্ধান্তই মাথা পেতে নিতে হয় লাইজুকে। বিবাহিত জীবন শুরু হলেও লেখাপড়া বন্ধ করেননি লাইজু। এরই মধ্যে তার প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। সংসার জীবনে কিছুটা সুখের হাতছানি আসতে না আসতেই বিয়ের ৪ বছরের মাথায় ১৯৯২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় তার স্বামীর মৃত্যু হয়। প্রভাতের স্বপ্নগুলো হারিয়ে যায় বিবর্ণ সন্ধ্যায়।আচল বুটিক্স বিক্রয় কেন্দ্রে বসেই কথা হচ্ছিলো লাইজুর সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে লড়াই সংগ্রাম করে সফল নারী উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প নিজেই বলছিলেন নাছিমা রহমান লাইজু।লাইজু জাগো নিউজকে বলেন, স্বামী মারা যাওয়ায় কিছুটা ভেঙে পড়েন। এরপর শুরু হয় সন্তানকে মানুষ করার লড়াই। স্বামীর মৃত্যুর পর কোনো আর্থিক সঞ্চয় ছিল না। স্বাবলম্বী হতে হবে। অন্তত সন্তান আর নিজের খরচটুকু জোগাড় করতে হবে। ঘরে বসেই পড়াশোনার পাশাপাশি হাতে হরেক ডিজাইনের সালোয়ার-কামিজ সেলাই করতে লাগলেন। বাজার থেকে শাড়ি কিনে তাতে হাতের কাজ করতে লাগলেন। নিজের কাজ করা পোশাক পরার পর লোকজন প্রশংসা করতেন।পরবর্তী সময়ে যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে ব্লক, বুটিক, নকশিকাঁথা, দরজিবিজ্ঞান প্রভৃতির প্রশিক্ষণ নেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় অর্থ নেই। নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে বাবার কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়ে ছোট পরিসরে দোকান দিয়ে বুটিক্স কাজ শুরু করেন। ভালো কাজের জন্য সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বছর কয়েকের মধ্যে কাজ থেকে পাওয়া অর্থ সঞ্চয় করেন। তা দিয়ে বড় বুটিক হাউস তৈরির উদ্যোগ নেন। এভাবেই আচল বুটিক্সের পথচলা শুরু হয়।আচল বুটিক্সের চালুর বিষয় লাইজু বলেন, বরিশাল নগরীতে তখন কোনো বুটিক হাউস ছিল না। এ জন্য ভালো মানের একটি বুটিক হাউস করতে চেয়েছেন। শুরুতে অনেকেই এটির ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তাদের ধারণা ছিল, নকশা হয়তো টিকবে না। বিদেশি পণ্যের তোড়ে ভেসে যাবে। কিন্তু আচল আজও হারিয়ে যায়নি। এখানের সহযোগিতামূলক কর্মপরিবেশে প্রত্যেক কর্মীই নিজের প্রতিষ্ঠান ভেবে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেন।তিনি বলেন, ‘প্রথম দিকে নিজেই ব্যবসাতে বসতাম। নিজেই কাঁচামাল কিনতাম। নিজেই ব্যাংকে যেতাম। নিজেই পাইকারি অর্ডার নিতাম। মা নুরজাহান বেগম ব্যবসায় উৎসাহ দিতেন। এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি। ব্লক, বুটিক ও নকশার কাজ করা সালোয়ার-কামিজ, থ্রিপিস, শাড়ি, বিছানার চাঁদর, কুশন কভার, শাল চাদরের ব্যাপক চাহিদা বাড়তে লাগলো।’২৩ বছরের পথচলায় নানা চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে এমনটা জানিয়ে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, শুধু হার না মানার মানসিকতার জন্য আচল বুটিক্স আজ টিকে আছে। বর্তমানে আচল বুটিক্স’ এ ৪০ লক্ষাধিক টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। এমনও দিন গেছে এক লাখ টাকার বেশি বিক্রি হয়েছে। সময়ের সঙ্গে শুধুই এগিয়েছে। এখন আচল বুটিক্স’এ ২০ জন নারী কাজ করেন। নগরীর গোড়াচাদ দাস রোডে রয়েছে একটি কারখানা। এছাড়া তার কাছ থেকে প্রতিবছর প্রশিক্ষণ নিয়ে বেশ কিছু নারী নিজেরাই বুটিক হাউস বা কারখানা খুলেছেন। তারা চাকরির জন্য বসে না থেকে ব্যবসা করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতেও অনেকের কাজের সংস্থান হয়েছে।এ নিয়ে গর্বিত লাইজু জাগো নিউজকে বললেন, বুটিক হাউস দিয়ে শুধু নিজের ভাগ্যই পরিবর্তন হয়নি, অনেকের ভাগ্য পরিবর্তনে সহযোগিতা করে চলছে। অবহেলিত অনেক নারী ও গৃহিণীরা অবসর সময়ে পোশাকে বুটিকের কাজ করে আয়ের সুযোগ পাচ্ছেন।১৯৯৭ সালে নাছিমা রহমান লাইজুর দ্বিতীয় বিয়ে হয়। এখন তিনি ৩ ছেলের জননী। নিজের উপার্জনের টাকা দিয়ে বরিশাল নগরীতে দু’টি বাড়ি করেছেন। সন্তানদেরও পড়াশোনা করাচ্ছেন অভিজাত স্কুলে। জীবনযুদ্ধে স্রোতের প্রতিকূলে চলার কঠিনতম লড়াইয়ে জয়ী হয়েছেন লাইজু।লাইজু তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বেশ কয়েকটি সম্মাননা পেয়েছেন। লাইজু জাগো নিউজকে বলেন, ২০০৩ সালে প্রাধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত দিয়ে তুলে দেয়া সম্মাননা ক্রেস্ট আজও তাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছে।ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ব্যাপারে জানতে চাইলে লাইজু বলেন, ‘নারীরা করবে ব্যবসা। অনেকেই তা ভালো চোখে দেখেনি। বাইরে বের হলে টিপ্পনি বা ব্যঙ্গ এবং হাসি-তামাশাও সহ্য করতে হয়েছে। কিন্ত তা বলে পিছু পা হইনি। লক্ষ্যে ছিল অবিচল। কারও সমালোচনাকে পাত্তা দেইনি। জীবনে যত বিপদই আসুক, হতাশ হতে নাই। চেষ্টা করলেই টিকে থাকা যায়, সফল হওয়া যায়। আমিও টিকে আছি।’তিনি বলেন, ‘স্বপ্ন দেখছি, বড় একটি পোশক কারখানা করার। সেখানে বহু মেয়ের কর্মসংস্থান হবে। আর তারা অন্যের মুখাপেক্ষী না থেকে স্বাবলম্বী হবে।’মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের বরিশাল জেলা কর্মকর্তা রাশিদা বেগম জানান, নাছিমা রহমান লাইজুর মতো নারীদের দেখে পিছিয়ে থাকা নারীরা অনুপ্রাণিত এবং উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। তিনি জীবনসংগ্রামে জয়ী হয়েছেন এবং বাংলার নারীসমাজকে জীবনসংগ্রামে জয়ী হওয়ার অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন। আর তাহলেই বাংলাদেশ তার গন্তব্যে পৌঁছে যাবে।সাইফ আমীন/বিএ

Advertisement