ফিচার

শেরেবাংলা ফজলুল হকের প্রয়াণ দিবস

শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, পুরো নাম আবুল কাশেম ফজলুল হক। তিনি ছিলেন বাঙালি আইনজীবী, লেখক এবং সংসদ সদস্য। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাঙালি কূটনীতিক হিসেবে পরিচিত লাভ করেন। রাজনৈতিক মহল এবং সাধারণ মানুষের নিকট শের- ই- বংগাল এবং ‘হক সাহেব’ নামে পরিচিত ছিলেন।

Advertisement

ফজলুল হক ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর বরিশাল জেলার রাজাপুর থানার সাতুরিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার আদি পৈতৃক নিবাস পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলায়। প্রাথমিক শিক্ষা বাড়িতেই শুরু হয়। পরে তিনি গ্রাম্য পাঠশালায় ভর্তি হয়েছিলেন। গৃহ শিক্ষকদের কাছে তিনি আরবি, ফার্সি এবং বাংলা ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। ১৮৮১ সালে তিনি বরিশাল জিলা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন।

১৮৮৬ সালে অষ্টম শ্রেণিতে তিনি বৃত্তি লাভ করেন এবং ১৮৮৯ সালে ফজলুল হক প্রবেশিকা পরীক্ষায় তৎকালীন ঢাকা বিভাগে মুসলমানদের মধ্যে প্রথম স্থান দখল করেন। ফজলুল হক তার প্রখর স্মৃতিশক্তির কারণে শিক্ষকদের খুবই স্নেহভাজন ছিলেন। প্রবেশিকা পাশ করার পর উচ্চশিক্ষা লাভের জন্যে তিনি কলকাতায় গমন করেন। ১৮৯১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ. পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। সে সময় প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। নিজের মেধার বলে তিনি প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এফ.এ. পাশ করার পর তিনি গণিত, রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় অনার্সসহ একই কলেজে বি.এ. ক্লাসে ভর্তি হন।

১৮৯৩ সালে তিনি তিনটি বিষয়ে অনার্সসহ প্রথম শ্রেণিতে বি.এ. পাশ করেন। বি.এ. পাশ করার পর এম.এ. ক্লাসে প্রথমে ভর্তি হয়েছিলেন ইংরেজি ভাষায়। পরীক্ষার মাত্র ছয় মাস আগে তাকে এক বন্ধু ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন যে, মুসলমান ছাত্ররা অঙ্ক নিয়ে পড়ে না, কারণ তারা মেধাবী নয়। এই কথা শুনে এ. কে. ফজলুল হকের জেদ চড়ে যায়। তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে, অঙ্কশাস্ত্রেই পরীক্ষা দেবেন। এরপর, মাত্র ছয় মাস অঙ্ক পড়েই তিনি প্রথম শ্রেণি লাভ করেন।

Advertisement

খেলাধুলার প্রতি ফজলুল হক খুবই আগ্রহী ছিলেন। তিনি প্রথম জীবনে নিজে বিভিন্ন খেলাধুলার সাথে জড়িত ছিলেন এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন খেলাধুলার পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও তিনি পরিচিত ছিলেন। তিনি মোহামেডান ফুটবল ক্লাবের প্রতিষ্ঠার সময় থেকে এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এছাড়া তিনি দাবা, সাঁতারসহ বিভিন্ন খেলা পছন্দ করতেন।

১৮৯৭ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বি.এল. পাশ করে স্যার আশুতোষ মুখার্জির শিক্ষানবিশ হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টে নিজের নাম তালিকাভুক্ত করেন এ. কে. ফজলুল হক। দুবছর শিখানবিশ হিসেবে কাজ করার পর ১৯০০ সালে তিনি সরাসরি আইন ব্যবসা শুরু করেন। পিতার মৃত্যুর পর ১৯০১ সালে তিনি বরিশালে ফিরে আসেন এবং বরিশাল আদালতে যোগদান করেন।

১৯০৬ সালে আইন ব্যবসা ছেড়ে ফজলুল হক সরকারি চাকরি গ্রহণ করেন। পূর্ব-বাংলার গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলার তাকে ডেকে সম্মানের সঙ্গে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ দেন। সরকারি চাকুরিতে তিনি কিছুদিন ঢাকা ও ময়মনসিংহে কাজ করেন। এরপর তাকে জামালপুর মহকুমার এস.ডি.ও হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।

শিল্প সাহিত্যের সঙ্গে এ কে ফজলুল হকের সান্নিধ্য ঘটে বরিশালে। কিশোর-কিশোরীদের জন্য এ সময় তিনি নিজের সম্পাদনায় বালক নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর কিছুদিন পর তিনি ভারত সুহৃদ নামে যুগ্ম সম্পাদনায় আরো একটি সাপ্তাহিক প্রত্রিকা প্রকাশ করেন। এ সময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত নবযুগ নামক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার রচিত গ্রন্থের নাম বেঙ্গল টুডে।

Advertisement

তিনি রাজনৈতিক অনেক পদে অধিষ্ঠান করেছেন, তার মধ্যে কলকাতার মেয়র, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর অন্যতম। যুক্তফ্রন্ট গঠনে প্রধান নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। বাংলায় তিনি কৃষক প্রজা পার্টি নীচু জাতের হিন্দু ও মুসলমান উভয় কৃষকদের স্বার্থের পক্ষেই সওয়াল করত। এমনকি মুসলিম লিগের সঙ্গে কৃষক প্রজা পার্টির লড়াইও চলেছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে এ কে ফজলুল হক সমর্থন দেন।

১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর আবুল কাশেম ফজলুল হককে পাকিস্তানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদক ‘হেলাল-ই-পাকিস্তান’ খেতাব দেওয়া হয়। ১৯৬১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকবৃন্দ তাকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে এবং তাকে হলের আজীবন সদস্য পদ প্রদান করা হয়। এই সংবর্ধনা সভার পর তিনি আর কোনো জনসভায় যোগদান করেননি। ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল এ কে ফজলুল হক ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

কেএসকে/এমএস