সাহিত্য

উপমহাদেশে ঈদুল ফিতরের অতীত

রবিউল কমল

Advertisement

ঈদে মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। আমরা সারাবছর অপেক্ষা করতে থাকি দিনটির জন্য। পুরো রমজান মাস সিয়াম-সাধনা শেষে উদযাপন করি ঈদুল ফিতর। উপমহাদেশে এই ঈদের প্রচলন শুরু হয় মুগল সম্রাটদের মাধ্যমে। মুগলদের আগে বাংলায় ঈদের প্রচলন তেমন ছিল না। মুগল সম্রাটরা আসার পর আমাদের ঈদ উৎসব সার্বজনীন হয়ে ওঠে।

মুগলদের মাধ্যমেই উপমহাদেশের মুসলিমরা ঈদকে উৎসব রূপে দেখতে পায়। কারণ ব্রিটিশ শাসিত তখনকার সমাজে খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় উৎসব বড়দিনকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হতো। এছাড়া তখন সাধারণ মানুষের ধর্ম এবং ধর্মীয় উৎসব সম্পর্কে জ্ঞানও ছিল খুব কম। কিন্তু মুগলরা এসে প্রদেশে প্রদেশে মক্তব গড়ে তুলেছিলেন কোরআন ও ইসলামি আইন শিক্ষার জন্য।

মুগল আমলে ঈদ এবং ঈদের অনুষ্ঠানকে সরকারিভাবে গুরুত্ব দেওয়া হতো। মুগল সাম্রাজ্যে যেসব অনুষ্ঠান পালিত হতো সেসবের চিত্রাঙ্কনও করা হতো। সে আমলের বিভিন্ন চিত্রে ফুটে ওঠে সে সময়ের উৎসবের ঘনত্ব। এমনই একটি চিত্রে প্রথম মুগল সম্রাট বাবরকে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে রাজ দরবারের সভাসদকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে দেখা যায়।

Advertisement

ঐতিহাসিক তাবাকাৎ-ই-নাসিরীর লেখক মিনহাজ উস সিরাজের মতে, ‘সুলতানরা রমজান মাসে ধর্মীয় আলোচনার ব্যবস্থা করতেন। ধর্ম প্রচারক নিযুক্ত করতেন এ কাজের জন্য।’

আরও পড়ুন: কুমার অরবিন্দের গল্প: সেলাই করা জীবন

বাংলাদেশে ঈদের সবচেয়ে পুরোনো বর্ণনা পাওয়া যায় মির্জা নাথানের লেখায়। ঈদুল ফিতরের সময় তিনি ছিলেন বোকাই নগরে। তার লেখা থেকে জানা যায়, ‘সন্ধ্যায় মোমবাতির আলোয় যখন নতুন চাঁদ দেখা যেত, তখন শিবিরে বেজে উঠতো শাহি তুর্য অর্থাৎ রণশিঙ্গা এবং একের পর এক গোলন্দাজ বাহিনী ছুড়তে থাকতো গুলি, যেন তা আতশবাজি। সন্ধ্যা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত চলতো এ আতশবাজি। শেষরাতের দিকে বড় কামান দাগানো হতো। কামানের তীব্র শব্দে ভূমিকম্প অনুভূত হতো।’

অধ্যাপক আবদুর রহিমের লেখা থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশে মুগল সেনাদের ছাউনি থেকে ঈদের আনন্দবার্তা ঘোষণা করা হতো। এতে প্রকাশ পায় কীভাবে ঈদ উৎসবকে স্বাগত জানাতো। এই আনন্দ-উৎসবে আমোদ-প্রমোদ করতো এবং এর জন্য শুকরিয়া আদায় করতো। ঈদের দিন সব বয়সের নারী-পুরুষ নতুন কাপড় পরতেন। নতুন পোশাকে সজ্জিত হয়ে শোভাযাত্রা করে ঈদগাহে যেতেন।

Advertisement

সুবেদার ইসলাম খানের সেনাপতি মির্জা নাথানের বর্ণনা থেকে অনুমান করা যায়, তখনকার ঢাকায়ও মুগলরা খুব জাঁকজমকপূর্ণভাবে ঈদ উদযাপনের করতেন। সুবেদার ইসলাম খান ঢাকার ইসলামপুরে বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকাবাইচের ব্যবস্থা করতেন। এ সময় স্বয়ং সুবেদার ইসলাম খান উপস্থিত থাকতেন।

জানা যায়, দ্বিতীয় মুর্শিদ কুলি খাঁর সময় জয় করা হয়েছিল ত্রিপুরা। তখন ঈদের দিন নবাব খুশি হয়ে গরিবদের মধ্যে এক হাজার টাকা বিতরণ করার আদেশ দেন। ঢাকার কেল্লা থেকে এক ক্রোশ দূরে ঈদগাহে যাওয়ার পথে রাস্তায় ছড়ানো হয়েছিল এই মুদ্রা।

আরও পড়ুন: পল ফায়ারাবেন্ড: একজন এনার্কিস্টের কথকতা

মুগল আমলের সবচেয়ে বড় ঈদগাহের নিদর্শন এখনো দৃশ্যমান। ১৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট শাহজাহানের ছেলে শাহ সুজার প্রধান অমাত্য মীর আবুল কাসেম ধানমন্ডির শাহি ঈদগাহ প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকায় অবস্থিত মুগল স্থাপত্য নিদর্শনগুলোর অন্যতম এই ঈদগাহ। ধানমন্ডি ঈদগাহটি দৈর্ঘে ১৪৫ ফুট ও প্রস্থে ১৩৭ ফুট। ৪ ফুট উঁচু করে ভূমির ওপরে এটি নির্মিত হয়, যাতে বন্যা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ঈদগাহটি চারদিকে ১৫ ফুট উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রথমদিকে এখানে শুধু সুবেদার, নায়েবে নাজিম ও অভিজাত মুগল কর্মকর্তা এবং তাদের স্বজন-বান্ধবরাই নামাজ পড়তে পারতেন। সাধারণ নগরবাসী এতে প্রবেশ করার তেমন একটা সুযোগ পেতেন না। পরে ঈদগাহটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

ঈদের নামাজ পড়ানোর জন্য রাজারা ইমাম নিয়োগ করতেন। শহরের বাইরের বিরাট উন্মুক্ত জায়গায় অথবা গ্রামে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হতো এবং এসব স্থানকে ঈদগাহ বলা হতো।

মুগল আমলে ঢাকায় ঈদ মিছিল বলে একটা কথা ছিল। সে মিছিলে শামিল হতেন সবাই। উনিশ শতকের প্রথমদিকে আলম মুসাওয়ার নামে এক শিল্পী ঢাকার ঈদ মিছিলের ছবি এঁকেছিলেন। মোট ৩৯টি ছবি আঁকেন তিনি। চিত্রগুলোয় দেখা যায়, ঈদের মিছিলগুলো নায়েব-নাজিমদের নিমতলী প্রাসাদ, চকবাজার, হোসেনি দালান প্রভৃতি স্থাপনার সামনে দিয়ে যাচ্ছে। ঈদের দিন নায়েব-নাজিমদের বাসস্থান নিমতলী প্রাসাদের ফটক থেকে বিভিন্ন পথ ঘুরে, চকবাজার, হোসেনি দালান হয়ে মিছিল আবার শেষ হতো মূল জায়গায় এসে। মিছিলে থাকতো জমকালো হাওদায় সজ্জিত হাতি, উট ও পালকি।

মুগল আমলে বাদশাহী বাজারে অর্থাৎ বর্তমান চকবাজারে ঈদ মেলার আয়োজন হতো বলে অনুমান করা হয়। বিশেষ করে তখনকার প্রশাসনিক সদর দপ্তর ঢাকা কেল্লার আশপাশের এলাকা ঈদের সময়টায় থাকত জমজমাট। চকবাজার এবং রমনা ময়দানের সেই ঈদ মেলায় বিভিন্ন রকমের বাঁশের তৈরি খঞ্চা ডালা আসতো। কাঠের খেলনা, ময়দা এবং ছানার খাবারের দোকান বসতো সুন্দর করে সাজিয়ে।

আরও পড়ুন: আমাদের যত কুসংস্কার: কালে কালে প্রচলিত

মুগলদের রাজত্বকালে ঈদের দিন তৈরি হতো বিভিন্ন ধরনের শাহি খাবার। সকালের নাশতায় খাওয়া হতো বাকরখানি, পরোটা, মাংস আর কয়েক পদে রান্না করা শাহি সেমাই। দুপুরের খাবারে থাকতো মোরগ পোলাও, কোরমা, পরোটা, কালিয়া, জর্দা। রাতেও এমন সব খাবারের আয়োজন করা হতো। মুগলদের ঈদের সব রান্নায় মালাই ব্যবহার করা হতো।

লেখক: শিশুসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী।

এসইউ/জেআইএম