মেধা সম্পদ অধিকার (আইপিআর) হল ব্যক্তি বা সত্ত্বাকে তাদের সৃজনশীল কাজ, উদ্ভাবন এবং অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক আবিষ্কারের জন্য প্রদত্ত আইনি অধিকার। এই অধিকার মালিককে তাদের মেধা সম্পদের ব্যবহার, প্রজনন এবং বিতরণ নিয়ন্ত্রণ করতে আইনানুগ ক্ষমতা প্রদান করে। উদ্ভাবন এবং সৃজনশীলতার প্রচার এবং নির্মাতাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য মেধা সম্পদ অধিকার অপরিহার্য। বাংলাদেশে, আইপিআর-এর ধারণা নতুন না হলে জনগণ এই ধারণার সাথে তেমন পরিচিত নয়। তবে, সরকারি পর্যায়ে দেশে মেধা সম্পদ অধিকারের প্রচার ও সুরক্ষার জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
Advertisement
আইপিআর-এর গুরুত্ব এবং উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতার প্রচার সম্পর্কে বিশ্ববাসীর সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর ২৬শে এপ্রিল বিশ্ব মেধাস্বত্ব অধিকার দিবস পালিত হয়। দিবসটি নতুন ধারণা এবং উদ্ভাবনের বিকাশকে সুরক্ষা এবং উত্সাহিত করার ক্ষেত্রে আইপিআর-এর তাত্পর্য সম্পর্কে জনসাধারণের জ্ঞান বৃদ্ধির একটি সুযোগ হিসাবে কাজ করে। এটি আইপিআরকে সুরক্ষিত রাখতে এবং তাদের লঙ্ঘন প্রতিরোধ করার জন্য শক্তিশালী আইন ও প্রবিধানের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিও তুলে ধরে।
আইপিআর দিবস উদযাপনের লক্ষ্য হল আইপিআর-এর প্রতি সম্মানকে উৎসাহিত করা এবং উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতার সংস্কৃতি গড়ে তোলা। প্রতি বছরের মতো, ২০২৩ সালের বিশ্ব আইপিআর দিবসের কেন্দ্রীয় প্রতিপাদ্য হল "নারী এবং আইপি: উদ্ভাবন এবং সৃজনশীলতাকে ত্বরান্বিত করা"। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ সরকারও আইপিআর এর প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আইপিআর দিবস পালন করছে।
কপিরাইট আইন, পেটেন্টস অ্যান্ড ডিজাইন অ্যাক্ট এবং ট্রেডমার্ক অ্যাক্টসহ বেশ কিছু আইন বাংলাদেশে মেধা সম্পদের অধিকার রক্ষা করে। এই আইনগুলো বিভিন্ন ধরণের সৃষ্টির, যেমন সাহিত্য ও শৈল্পিক কাজ, উদ্ভাবন এবং ট্রেডমার্ক এর মেধা সম্পদের অধিকার রক্ষা করে। কপিরাইট আইন সাহিত্যিক, শিল্পী এবং বাদ্যযন্ত্র বাদকের কাজের মেধা সম্পদের অধিকার রক্ষা করে। অন্যদিকে পেটেন্ট এবং ডিজাইন আইন উদ্ভাবন এবং শিল্প নকশার মেধা সম্পদের অধিকার রক্ষা করে। ট্রেডমার্কস অ্যাক্ট ট্রেডমার্ক, সার্ভিস মার্কস এবং ব্যবসায়ী নামের মেধা সম্পদের অধিকার সুরক্ষা করে।
Advertisement
বাংলাদেশে মেধা সম্পদ অধিকারের বর্তমান অবস্থা খুব বেশি উৎসাহব্যঞ্জক নয়। সরকারের তরফে আইপিআর-এর প্রচার ও সুরক্ষার জন্য উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এখনও বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা প্রয়োজন। প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হল মেধা সম্পদ অধিকার সম্পর্কে সাধারণ জনগণ এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে সচেতনতার অভাব। এই সচেতনতার অভাব মানুষকে মেধা সম্পদ অধিকারের প্রতি কম সম্মান প্রদর্শন করা এবং উচ্চ মাত্রার লঙ্ঘনের হারের দিকে পরিচালিত করে।
আরেকটি চ্যালেঞ্জ হল ধীরগতির আইনি ব্যবস্থা। বাংলাদেশে মেধা সম্পদ অধিকার সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়া ধীর এবং জটিল, এবং মামলাগুলো নিষ্পত্তি হতে কয়েক বছর সময় লেগে যায়। আইনি ব্যবস্থায় এই বিলম্ব প্রায়ই কোনো কিছুর স্রষ্টা এবং উদ্ভাবকদের তাদের মেধা সম্পদের অধিকারের জন্য আইনি সুরক্ষা চাইতে নিরুৎসাহিত করে। উপরন্তু, আইনী ব্যবস্থায় ছোট এবং মাঝারি আকারের ব্যবসায়ীদের প্রবেশাধিকার নেই। তাছাড়া, যাদের আছে তাদের আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সংস্থান নাও থাকতে পারে।
আইপিআর আইন এক দেশ থেকে অন্য দেশে ব্যাপকভাবে ভিন্ন হতে পারে। গবেষক এবং বিনিয়োগকারীরা যারা বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করছেন বা বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভের চেষ্টা করছেন তারা এই পরিস্থিতিকে বিভ্রান্তিকর মনে করতে পারেন। মেধা সম্পদ অধিকার আইন এবং প্রবিধানের বিভ্রান্তিকর প্রকৃতির কারণে অনেক মানুষ আইপিআর সম্পর্কে অসচেতন এবং ভুল ধারণা পোষণ করে।
উপরন্তু, কিছু ব্যক্তি এবং কোম্পানি তাদের নিজস্ব স্বার্থে আইপিআর উপেক্ষা করতে পারে। তারা ভুলভাবে অনুমান করে যে তারা অন্যের আইপিআর লঙ্ঘনকারী হিসেবে ধরা পড়লে সেই প্রক্রিয়া থেকে বের হতে হলে অনেক খরচ করতে হবে। আইপিআর-এর প্রতি এই ধরণের অবহেলা এই বিষয়টির তাৎপর্য সম্পর্কে অজ্ঞতা বিস্তারে অবদান রাখতে পারে।
Advertisement
এই সকল চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, বাংলাদেশ সরকার দেশে মেধা সম্পদ অধিকারের প্রচার ও সুরক্ষার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলোর মধ্যে একটি হল ২০১৮ সালে জাতীয় উদ্ভাবন এবং মেধা সম্পদ অধিকার (আইপিআর) নীতি গ্রহণ করা। এই নীতির লক্ষ্য হল বাংলাদেশে মেধা সম্পদ অধিকারের উন্নয়ন ও সুরক্ষার জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা।
আইপিআর নীতি মেধা সম্পদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, মেধা সম্পদের অধিকার প্রয়োগের জন্য আইনি ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা এবং উদ্ভাবন এবং সৃজনশীলতার প্রচারসহ বেশ কয়েকটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে। এই নীতির লক্ষ্য হল দেশে মেধা সম্পদ অধিকারের প্রচার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা (যেমন সরকারী সংস্থা, একাডেমিয়া এবং বেসরকারি খাত)।
বাংলাদেশের জন্য উদ্ভাবন, সৃজনশীলতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন সুযোগ উপস্থাপন করতে পারে আইপিআর। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ সরকার আইপিআর আইন ও প্রবিধানকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে, যার ফলে দেশে নিবন্ধিত পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক এবং কপিরাইটের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানও বেশ কিছু সুযোগ রয়েছে যা আইপিআর বাংলাদেশে নিয়ে আসতে পারে।
শক্তিশালী আইপিআর আইন নতুন ধারণা এবং উদ্ভাবনের নির্মাতাদের আইনি সুরক্ষা প্রদান করে উদ্ভাবন এবং সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করতে সাহায্য করতে পারে। এটি নতুন পণ্য, পরিষেবা এবং প্রযুক্তির বিকাশের দিকে নিয়ে যেতে পারে যা সমাজকে উপকৃত করতে পারে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে।
অন্যদিকে, একটি কার্যকর আইপিআর ব্যবস্থার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের মেধা সম্পদ অধিকার সুরক্ষিত করার হলে বাংলাদেশকে বিদেশী বিনিয়োগের জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত করা সম্ভব। এটি বিদেশী বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তি স্থানান্তর বৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।
আইপিআর ছোট এবং মাঝারি আকারের উদ্যোগগুলোর (এসএমই) জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, যা প্রায়শই বাজারে প্রতিযোগিতা করার জন্য উদ্ভাবন এবং সৃজনশীলতার উপর নির্ভর করে। একটি শক্তিশালী আইপিআর ব্যবস্থা এসএমইকে তাদের মেধা সম্পদের অধিকার রক্ষা করতে এবং বৃহত্তর কোম্পানির সাথে সমানভাবে প্রতিযোগিতা করার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি সরঞ্জাম সরবরাহ করতে পারে।
কার্যকরী আইপিআর আইন ও প্রবিধান বিদেশী কোম্পানিগুলোকে আশ্বস্ত করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে সহজতর করতে পারে এই নিশ্চয়তা প্রদান করে যে বাংলাদেশে তাদের মেধা সম্পদের অধিকার রক্ষা করা হবে। এতে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে।
যেহেতু বিশ্ব ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল এবং জ্ঞান-ভিত্তিক হয়ে উঠছে, আইপিআর আগের চেয়ে আরও বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে। বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম এমন একটি স্থিতিশীল জ্ঞান-ভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশে। একটি শক্তিশালী আইপিআর ব্যবস্থা এই লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করতে পারে।
আইপিআর-এর সম্ভাবনা বিবেচনা করে, সরকার বাংলাদেশে মেধা সম্পদ অধিকারের প্রচার ও সুরক্ষার জন্য বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছে। পেটেন্ট, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক বিভাগ (ডিপিডিটি) বাংলাদেশে পেটেন্ট, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক প্রদান এবং নিবন্ধনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। কপিরাইট অফিস নিবন্ধন এবং কপিরাইট সুরক্ষার জন্য দায়ী। উপরন্তু, সরকার মেধা সম্পদ অধিকার সংক্রান্ত বিরোধগুলো নিষ্পত্তির করার জন্য মেধা সম্পত্তি অধিকার ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে।
সরকার সাধারণ জনগণ এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে মেধা সম্পদ অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যও বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ডিপিডিটি নিয়মিতভাবে কর্মশালা এবং প্রশিক্ষণ সেশনের আয়োজন করে যাতে মানুষ মেধা সম্পদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়। সরকার দেশে মেধা সম্পদ অধিকার প্রচারের জন্য একটি জাতীয় সচেতনতা প্রচারও শুরু করেছে।
যাই হোক, এখনও অনেক পথ যেতে হবে। বাংলাদেশ সরকারকে মেধা সম্পদ অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে এবং এই অধিকারগুলো কার্যকর করার জন্য আইনি ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতার জন্য আরও অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে সরকারকে কাজ করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায় যে আইপিআর বাংলাদেশের জন্য উদ্ভাবন, সৃজনশীলতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন সুযোগ তৈরি করতে পারে। আইপিআর সংক্রান্ত আইন ও প্রবিধানকে শক্তিশালী করে এবং মেধা সম্পদ সুরক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণকে সচেতনতা করে বাংলাদেশ এই অঞ্চলে উদ্ভাবন এবং সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রদান করতে পারে।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।
এইচআর/জিকেএস