মতামত

পাকিস্তানি ধারার রাজনীতিকে উৎসাহ জোগানো যাবে না

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ঘণ্টাধ্বনি শোনা গেছে। শুরু হয়েছে রাজনৈতিক প্রস্তুতি। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য, বিএনপি ও তার মিত্ররা উঠেপড়ে লেগেছে। বিএনপি সরকার পরিবর্তন চায়, কিন্তু নির্বাচনে অংশ নিতে তাদের অনীহা। দেশ শাসন করবে রাজনৈতিক সরকার, আর নির্বাচন করবে অরাজনৈতিক সরকার-  এই নীতিহীন অবস্থান নিয়ে বসে আছে বিএনপি।

Advertisement

আওয়ামী লীগের বিরোধিতা অবশ্য নতুন কিছু নয়। গণবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি কখনো চায়নি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসুক। আওয়ামী লীগের গণসম্পৃক্ততা, অসাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চরিত্রই সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীলদের দলটির প্রতি বিমুখ করে রেখেছে। এমনকি আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা ঠেকানোর জন্য তারা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিএনপি-জাতীয় পার্টির জন্ম দিয়েছে। স্বাধীনতার শত্রুদের ক্ষমতায় এনেছে। স্বাধীনতার আদর্শ ও চেতনাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে।

স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের পাহারায় তারা দেশে একটি নব্যধনী শ্রেণি ও শক্তিশালী কায়েমি স্বার্থ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, কালো টাকাকে সমাজ ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ করে দিয়েছে। এসব কাজে তারা মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যযুগীয় মৌলবাদ ও পশ্চিমা গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম ও সাম্রাজ্যবাদের সেবাদাস বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ন্যাটো ও সিআইএর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছে। আওয়ামী লীগ কখনো একটি বামপন্থী বা সোশ্যালিস্ট দল ছিল না, ছিল একটি মাল্টিক্লাস লেফ্ট অব সেন্টার পার্টি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দলটি এই চরিত্র বজায় রাখতে পারেনি।

এই দলেও ক্রমেই কায়েমি স্বার্থবাদীদের ভিড় বেড়েছে। ডানপন্থার দিকে, সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে আপসের দিকে ঝোঁক বেড়েছে। কখনো কখনো সহজে ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের ইচ্ছা ও স্বার্থের সঙ্গেও আওয়ামী লীগ আপস করেছে। কিন্তু দীর্ঘ গণআন্দোলনের ঐতিহ্যবাহী দল গণসম্পৃক্ততা সম্পূর্ণ ত্যাগ করে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের কাছে এখনো পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করেনি। সে জন্যই আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা ঠেকানো এবং তাদের স্বার্থরক্ষার বাহন হিসেবে সব শক্তি বিএনপিকেই বেছে নিয়েছে।

Advertisement

একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, এদেশে বোমা-গ্রেনেড-হত্যা-ক্যু-ষড়যন্ত্রের রাজনীতির সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছে আওয়ামী লীগসহ তার মিত্ররা। আর এসবের প্রতিকারের জন্যও তাদেরকেই এককভাবে ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড হামলায় হত্যা করা গেলে বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রসঙ্গ মুখে আনার জন্য মানুষ খুঁজে পাওয়া যেত কিনা সন্দেহ। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন সম্ভব না হলে এই বিচার যেভাবে ঝুলে গিয়েছিল তা হয় ঝুলে থাকত কিংবা কোনো কারসাজিতে খুনিদের অব্যাহতি দেওয়া হতো।

২০০৮ সালে সাধারণ নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ী হওয়ায় ইতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যার চূড়ান্ত বিচার সম্ভব হয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সম্মিলিত আন্দোলনের ফলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে ইনডেমনিটি বিলও বাতিল হতো না, মামলা করার পথও সুগম হতো না; বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও তার রায় ছিল সুদূরপরাহত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আওয়ামী লীগের ছোটখাটো ভুলত্রুটি নিয়ে যারা অতি সোচ্চার তাদের এই রাজনৈতিক বাস্তবতাটা বিবেচনায় রাখতে হবে। না হলে ভুল পথে হাঁটা হবে।

এদেশে এখন পর্যন্ত যত নাশকতা, বোমাবাজি, গ্রেনেড হামলা, জঙ্গি হামলা, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার সব ক’টির শিকার হয়েছে- আওয়ামী লীগ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অন্য কোনো রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, প্রগতিশীল ধারার রাজনীতিবিদ, বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ব্যক্তি, সংস্থা বা অনুষ্ঠান। এখন পর্যন্ত  জামায়াত-বিএনপি কিংবা অন্য কোনো সাম্প্রদায়িক ভাবধারায় বিশ্বাসী কোনো ব্যক্তি, দল বা সংস্থা কিংবা তাদের কোনো অনুষ্ঠানে কোনো রকম হামলা-খুন, বোমা-গ্রেনেড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেনি।

ঢিলটা কে  ছুড়েছে তা অনেক ক্ষেত্রে উদঘাটিত না হলেও ঢিলটা কার বা কাদের ওপর পড়ছে তা দেখেও কিন্তু আমরা সহজেই বুঝতে পারি কে বা কারা টার্গেট। আর এ ক্ষেত্রে কারো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, যে ঢিলটা কারা ছুড়ছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিই যে মৌলবাদী ষড়যন্ত্রকারী পাকিস্তানি ভাবধারাপুষ্ট চক্রের মূল টার্গেট- একথা কবুল করে নিতে বিরাট কোনো গবেষণার দরকার হয় না। বিএনপি সব হামলা, সব ষড়যন্ত্র ও নাশকতার দায় আওয়ামী লীগের ওপর চাপিয়ে, এসব ঘটনার তদন্ত ও বিচারকাজে বাধা সৃষ্টি করে অথবা মামলার তদন্ত ও বিচারকাজ ইচ্ছেমতো প্রভাবিত করে নিজেদের ষড়যন্ত্রকারীর দোসর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

Advertisement

পাকিস্তানপন্থী ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক শক্তির ষড়যন্ত্রের রাজনীতির প্রাণভোমরা এখন বিএনপি। আর তাদের ‘বি-টিম’ হিসেবে কাজ করা সংগঠনের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পাকিস্তানপন্থী ভাবধারাপুষ্ট একটি মৌলবাদী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করতে বর্তমানে এক ডজনেরও বেশি ধর্মাশ্রয়ী দল ও গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে এবং তারা নানা নামে ও ছদ্মবেশে নিরন্তর অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কাজেই বিএনপি ও তাদের দোসরদের অপতৎপরতা সম্পর্কে সজাগ এবং সতর্ক থাকা, তাদের ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে গণমানুষের অধিকার আদায় এবং সুষ্ঠুধারার গণতান্ত্রিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করাটা বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

দল হিসেবে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ প্রায় চার দশক ধরে চলা আওয়ামীবিরোধী তথা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রচারণাকে অকার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখার পরও আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশের রাজনীতিতে ভিলেন হিসেবে চিহ্নিত করার নিরন্তর যে প্রচারণা সেই প্রচারণায় দেশের নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত হয়েছে। তারা মনে করেছে, ‘আওয়ামী লীগ মানে হচ্ছে, দুঃশাসন, বিভীষিকা, হত্যা-খুন-লুটপাট। ভারতের কাছে দেশকে, দেশের স্বার্থকে বিকিয়ে দেওয়া। ইসলামের টুঁটি টিপে ধরা।’

পাকিস্তানি ভাবধারাপুষ্ট বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারী অপশক্তিদের এই অপপ্রচার আওয়ামী লীগকে যে নানা সময়ে কোণঠাসা ও বিব্রত করে তাতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের অনেক মানুষই মোটামুটি এই ধারণায় বিশ্বাসী। এই অপবিশ্বাসের মূল উপড়ে ফেলার জন্য যে ধরনের মতাদর্শিক লড়াই চালানো দরকার, তেমন কিছু খুব একটা চোখে পড়ে না। ক্ষমতায় গিয়েও দলের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বকে সুসংহত করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। প্রতিপক্ষ যেখানে প্রবল ও শক্তিশালী সেখানে যে দৃঢ়তা, সততা, নমনীয়তা ও উদারতা প্রয়োজন ছিল তা আওয়ামী লীগ দেখাতে পারেনি।

এমনকি কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা পালনকারী ছোট দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই চালানোর তেমন ধারাবাহিক উদ্যোগ ও আন্তরিকতা চোখে পড়েনি। আশির দশকে আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে বাকশাল গঠন ও নব্বইয়ের দশকে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরাম গঠন আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করেছে। এর ফলে ১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির বিজয় সহজতর করেছে।

একাত্তরের চেতনায় বিশ্বাসী অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও বিভক্তির রাজনীতির ক্ষতিকর দিকটি অনুধাবন করতে হবে। আওয়ামী লীগের কিছু ত্রুটি-দুর্বলতা-সীমাবদ্ধতা আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ধারার পক্ষে তাদের অবস্থান এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকারকে অস্বীকার করা যাবে না। আওয়ামী লীগ আর যা-ই করুক, হত্যা-ক্যু-জঙ্গিবাদী-হঠকারী রাজনীতি করে না। আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে প্রগতিশীল ধারার অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব বলে মনে হয় না।

জঙ্গিবাদী-সুবিধাবাদী রাজাকারি চেতনাকে কবর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে আওয়ামী লীগকে এড়িয়ে নয়, আওয়ামী লীগকে ক্ষতিগ্রস্ত করে নয়, তাদের সঙ্গে নিয়েই চূড়ান্ত লড়াইটা করতে হবে। এজন্য কিছুটা ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে একাট্টা হয়ে কাজ করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সব দল, ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়কে। আর আওয়ামী লীগের বিপদ ও বিপর্যয়ে হাত গুটিয়ে বসে থেকে নীরবে দেখে গেলে চরম মূল্য দিতে হবে সবাইকেই।

মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান দ্বন্দ্ব হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক ধারা বনাম পাকিস্তানি তথা মৌলবাদী-ধর্মান্ধ-জঙ্গিবাদী ধারা। প্রথম ধারাকে শক্তিশালী ও সংহত না করলে দেশ চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। দেশকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার জন্য ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে হবে আওয়ামী লীগকেই। কাজেই সবাইকে নিয়ে চলার উদ্যোগটিও নিতে হবে আওয়ামী লীগকেই। জেনে বা না জেনে যারা ‘তৃতীয় শক্তি’, ‘বিকল্প শক্তি’ খোঁজার নামে আওয়ামী লীগকে দুর্বল করার কাজে অংশীদার হয়েছেন বা হচ্ছেন, তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হওয়া উচিত দেশের রাজনৈতিক শক্তির বর্তমান মেরুকরণ দেখেই।

সমালোচনা-আত্মসমালোচনা অবশ্যই থাকবে এবং চলবে কিন্তু সেটা যেন কোনোভাবেই পাকিস্তানি ধারার রাজনীতির যারা ধারক-বাহক তাদের উৎসাহ জোগানোর নামান্তর না হয়। একাত্তরে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা যে বিজয় ছিনিয়ে এনেছি, সেই বিজয় কেড়ে নিতে দেওয়া যাবে না কাউকে, কোনোভাবেই। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আবার একাত্তরের মতো দৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে সবাইকে। ভুলে গেলে চলবে না, ব্যক্তির চেয়ে দল বড় আর দলের চেয়ে বড় দেশ। দেশ বিপন্ন হয়, এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকাই দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত।

২৪ এপ্রিল, ২০২৩

লেখক : রাজনীতিবিদ, লেখক ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।

এইচআর/জিকেএস