ঈদ আসে আনন্দ নিয়ে। বাঙালি মুসলমানের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। আনন্দ নিয়ে আসার কথা থাকলেও সব ঈদ পরিপূর্ণ আনন্দ নিয়ে আসতে পারে না। কখনো করোনা, কখনো যুদ্ধ, কখনো আবহাওয়া, কখনো দুর্ঘটনা- ঈদের আনন্দে বিঘ্ন ঘটায়। অনেকদিন পর বাংলাদেশে ঈদ এসেছিল আনন্দের জোয়ার নিয়ে। ইউক্রেন যুদ্ধ এখনও আছে, তবে তার ধকল অনেকটাই গা সওয়া হয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির চাপও কিছুটা সয়ে এসেছে। ফলে এবার ঈদ সত্যিকার অর্থেই বাংলার ঘরে ঘরে আনন্দ নিয়ে এসেছিল।
Advertisement
বঙ্গবাজার, নিউ সুপার মার্কেটসহ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বাদ দিলে বড় ছোট সব শপিং মল, এমনকি ফুটপাতের বাজারেও ছিল মানুষের ঢল। সব মানুষ ঈদের জামা পেয়েছে, এমনটি বলা পরিসংখ্যানের বিবেচনায় হয়তো সত্যি হবে না। তবে প্রায় সবাই নতুন জামা পরে ঈদ করেছেন এমনটি বলাই যায়। আসলে ঈদ এলে যাকাত, ফিতরা, ব্যক্তিগত দান এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের চেষ্টা থাকে; সবার ঘরে যেন একটু হলেও ঈদের আনন্দ পৌঁছে দেয়া যায়। আর ভাগাভাগি করলেই ঈদের আনন্দ বাড়ে। সেটাই ইসলামে ঈদের মূল চেতনা। তাই বলাই যায়, চোখের সামনে কেউ নিরানন্দ ঈদ কাটায়নি এবার।
ঈদের সময়ও যারা ঢাকায় থাকেন, তাদের আনন্দে বাড়তি মাত্রা আনে ফাঁকা রাজপথ। বছরজুড়ে যানজটে স্থবির ঢাকা, ঈদের নতুন চেহারা পায়। ঈদের সময়টা ঢাকা থাকে একদম ফাঁকা। ভিড় শুধু বিনোদন কেন্দ্রে, পার্কে, চিড়িয়াখানায়। এবার ঈদের বিনোদন আকর্ষণে নতুন যুক্ত হয়েছে মেট্রোরেল। অনেকেই ঈদের ছুটিতে বেড়ানোর তালিকায় রেখেছিলেন মেট্রোরেলকে। ঈদ এলেই পুরান ঢাকার ঘোড়ার গাড়ি চলে আসে মানিক মিয়া এভিনিউতে। ঈদের সবাই ভিআইপি। সব রাস্তা সবার জন্য খোলা। নতুন জামা পরে, এক রিকশায় অনেকে মিলে ভিআইপি রোড দাপিয়ে বেড়ানোও ঈদের আনন্দে নতুন মাত্রা আনে। ফাঁকা রাস্তায় গান শুনতে শুনতে লংড্রাইভে যাওয়াও কারো কারো ঈদের আনন্দ। এছাড়া ঢাকার আশপাশে খোলা জায়গায়, নদীর তীরে, নৌকায়ও ছিল মানুষের আনন্দ খোঁজার তাড়া। স্বজনদের বাসায় বেড়াতে যাওয়াও যেন ঈদেরই অংশ।
তবে শহরবাসী মানুষের সবচেয়ে বড় ঈদ হলো বাড়ি ফেরা, মানে ফেলে আসা গ্রামের বাড়িতে সবাই মিলে একসাথে ঈদ উদযাপন করা। পেটের টানে ঢাকায় ছুটে আসা অনেক মানুষের প্রাণটা বাধা থাকে গ্রামে, যেখানে পোতা আছে তার নাড়ি, যেখানে তার শিকড়। প্রতিবছরই ঈদে বাড়ি ফেরা মানেই অনন্ত ভোগান্তি। এবার ভোগান্তি একেবারে হয়নি, সেটা বললে নিশ্চয়ই কেউ কেউ আপত্তি করবেন। কিন্তু গত অনেকবছরের মধ্যে এবারের বাড়ি ফেরা ছিল সত্যিই আনন্দদায়ক। রেলভ্রমণ তুলনামূলক আরামদায়ক ও নিরাপদ। তাই বাড়ি ফিরতে সবার প্রথম পছন্দ ট্রেন।
Advertisement
তবে সেই ঈদের আগে ট্রেনের টিকেট কাটতেই সবার ঘুম ছুটে যায়। এবার ট্রেনের শতভাগ টিকেট বিক্রি হয়েছে অনলাইনে। ফলে স্টেশনে গিয়ে আগের রাত থেকে অপেক্ষার দিন ফুরিয়েছে। শতভাগ অনলাইন নিয়ে অনেকের আপত্তি ছিল। যারা টিকেট পাননি, তারা সবসময়ই আপত্তি করবেন। অনলাইনে দেয়াতে যত জন মানুষ টিকেট পেয়েছেন, অফলাইনেও তো ততজনই পেতেন। তার মানে বঞ্চিত মানুষের সংখ্যা সমানই হতো। তাই অনলাইনে টিকেট বিক্রি করে, কমলাপুরে লাইন ধরার ভোগান্তিটা অন্তত দূর করা গেছে। টিকেট পেলেও সেই সিট পর্যন্ত পৌঁছানো ছিল আরেক লড়াই। এবার সে লড়াইয়েরও অবসান ঘটেছে। টিকেট ছাড়া কারো স্টেশনে ঢোকারই সুযোগ ছিল না, সুযোগ ছিল না ছাদে চড়ারও। ট্রেনের বিলম্বেরও বড় কোনো অভিযোগ ছিল না। তাই এবার ট্রেনে ঈদযাত্রা ছিল স্বস্তির, আনন্দের।
শুধু ট্রেন নয়, লঞ্চ এবং বাসেও বড় কোনো অভিযোগ ছিল না। পদ্মা সেতু হওয়ার পর লঞ্চের ওপর চাপটা এমনিতেই কমে এসেছে। এবার বাসযাত্রাও ছিল বিস্ময়কর রকমভাবে ভালো। ঈদের ছুটি একটু লম্বা হওয়াতে রাস্তার ওপর চাপটা কমে এসেছে। তাছাড়া ঢাকার চারপাশের রাস্তার উন্নতি, দেশজুড়ে শত শত সেতু ও সড়ক নির্মাণ যোগাযোগ নেটওয়ার্কে দারুণ উন্নতি হয়েছে। ব্যবস্থাপনাও ছিল চমৎকার। যানজটের কারণে রাস্তায় বসে ঈদ করার ঘটনা অন্তত এবার ঘটেনি। এবারের ঈদে সরকারের বিশেষ উপহার ছিল পদ্মা সেতুতে মোটর সাইকেল পারাপারের অনুমতি।
লাখো মানুষ এবার মোটর সাইকেলে বাড়ি ফিরেছেন। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, নিয়ম মেনে, লেন মেনে মোটর সাইকেল চালালে এই অনুমতি বহাল থাকবে। সবাই নিয়ম মানবেন, এটা আশা করা ভুল। তবে নিয়ম ভাঙ্গার প্রবণতা এবার কম ছিল। একটা বিষয় এবার পরিষ্কার হয়েছে, চাইলে ভালো ও নিরাপদ ঈদযাত্রাও অসম্ভব নয়। আশা করি এবারের উদাহরণ মাথায় রেখে আগামী বছরগুলোতেও ঈদযাত্রা স্বস্তির করতে সরকার আন্তরিক থাকবে।
প্রতিবছরই ঈদের আনন্দকে বেদনায় ঢেকে দেয় সড়ক দুর্ঘটনা। এবারও দুর্ঘটনা ঘটেছে, এমনকি ঈদের দিনেও দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে অনেকের প্রাণ। প্রতিটি মৃত্যুই বেদনাদায়ক। তবে এবার তুলনামূলকভাবে দুর্ঘটনা কম হয়েছে।
Advertisement
এবার ঈদে সবচেয়ে বড় শঙ্কা ছিল আবহাওয়া নিয়ে। ভয়ঙ্কর তাপদাহ এবার বিপর্যস্ত করে তুলেছিল জনজীবন। কিন্তু ঈদের সময় তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছিল। ঈদের দিন দেশের বিভিন্নস্থানে অল্প হলেও বৃষ্টি দারুণ স্বস্তি এনেছে।
ঈদের আনন্দকে আরো রঙিন করতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে থাকে নানা আয়োজন। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা বর্ণাঢ্য ঈদসংখ্যা প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন টেলিভিশন ও ওটিটি প্লাটফর্মে ছিল আকর্ষণীয় সব আয়োজন। ঈদের দুদিন আগে ‘হইচই’ এ মুক্তি পাওয়া ‘মহানগর-২’ রীতিমত হৈচৈ ফেলে দিয়েছে। চানরাইতে ‘চরকি’তে মুক্তি পাওয়া ‘মাইসেল্ফ অ্যালেন স্বপন’ও আনন্দ দিয়েছে অনেককে। এছাড়া বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে আছে সপ্তাহব্যাপী ঈদ আয়োজন।
এই লেখা যখন লিখছি, তখনও দেশজুড়ে ঈদের ছুটি। সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে ঈদের ছুটি শেষ হবে। তবে বলে দেয়াই যায়, এই সপ্তাহটাই দেশজুড়ে ঈদের আমেজ থাকবে। যারা বাড়তি ছুটি নিয়ে গ্রামে গেছেন, তারা ফিরবেন আস্তে ধীরে। যারা কক্সবাজার, বান্দরবান, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে ঘুরতে গেছেন, তাদেরও ফিরতে সময় লাগবে। ঢাকা আবার স্বাভাবিক হতে এই সপ্তাহটা লেগে যাবে। এই সুযোগে যারা ঢাকায় রয়ে গেছেন, তারা রসিয়ে রসিয়ে ঈদ উপভোগ করতে পারবেন।
ঈদের ছুটি শেষে আমরা আবার ব্যস্ত হয়ে যাবো অর্থনীতি, মূল্যস্ফীতি, রাজনীতি, নির্বাচন, দুর্ঘটনা, খুন আগুনে। তবু ঈদের আনন্দের রেশটুকু যেন থাকে। ঈদের সবাইকে নিয়ে আনন্দ করার যে চেষ্টা, সেই মানসিকতা যেন বজায় থাকে সবার মধ্যে, সবসময়।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/জেআইএম