বংশ পরম্পরায় পাকিস্তান আমল থেকে ঘানিতে খাঁটি সরিষার তেল তৈরি করছেন আব্বাস আলী (৬০)। একসময় নিজে ঘানি টানলেও এখন টানছে ঘোড়া। আব্বাস আলীর দাবি, তার ঘানি ভাঙানো সরিষার তেল শতভাগ খাঁটি। এ তেলের চাহিদা রয়েছে জেলাজুড়ে।
Advertisement
জামালপুরের সরিষাবাড়ী পৌরসভার পপুলার মোড় সংলগ্ন সরিষাবাড়ী-জামালপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশেই আব্বাস আলীর বসবাস। ঘানি টেনেই বড় করেছেন সন্তানদের। এখন তারা বড় হয়েছেন। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে হাল ধরেছেন বাবার পেশায়।
সরেজমিন দেখা যায়, শহরের আঞ্চলিক মহাসড়কে পাশেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ ও ঘর ঘর শব্দে ঘুরছে কাঠের তৈরি ঘানি। গরুর পরিবর্তে ঘানি টানছে ঘোড়া। পাটাতনে বসে আছেন আব্বাস আলী। ফোঁটায় ফোঁটায় তেল চুয়ে পড়ছে নিচে রাখা প্লাস্টিকের বোতলে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিরামহীন চলে তার এ কর্মযজ্ঞ। প্রতিদিন একেকটি ঘানি থেকে গড়ে প্রায় ১১ কেজি তেল উৎপাদন করতে পারেন তিনি।
আক্ষেপ করে আব্বাস আলী জাগো নিউজকে বলেন, মাঝেমধ্যে কিছু লোক এসে ভিডিও করে নিয়ে যান। তারপর তাদের ছবি ব্যবহার করে ক্রেতাদের কাছে ভেজাল পণ্য বিক্রি করেন। তিনি বলেন, ‘আমি গ্রাহকদের এক পয়সাও ঠকাই না। আমার তেলে এক ফোঁটাও ভেজাল নেই। বিশ্বাস না হলে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।’
Advertisement
আব্বাস আলীর পাঁচটি ঘানি রয়েছে। দুটি তার ছেলে আর তিনটি তিনি নিজে চালান। প্রতিদিন গড়ে ৫০-৫৫ লিটার তেল উৎপাদন করেন। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসে খাঁটি সরিষার তেল কিনে নিয়ে যান। প্রতি লিটার বিক্রি করেন ৩২০ টাকা দরে।
আব্বাস আলীর স্ত্রী খোদেজা বেগম। ৫০ বছরের দাম্পত্য জীবনে স্বামীর সুখে-দুঃখে পাশে রয়েছেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আগে নিজে ঘানি টেনেছেন। পরে গরু। এখন ঘোড়া দিয়ে টানছেন। তাদের তেল স্বাদে ও মানে অনেক ভালো। এ তেল জামালপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, ঢাকাসহ দেশের বাইরেও যাচ্ছে। তবে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী তাদের নাম ব্যবহার করে তেলে ভেজাল মিশিয়ে সুনাম নষ্ট করছেন।
আব্বাস আলীর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে তেল নিতে আসেন হালিমা নামের এক নারী। তার বাড়ি পঞ্চপীর। এর আগেও তিনি দুবার তেল নিয়েছেন। দীর্ঘ পথ হেঁটে তেল নিতে এসেছেন তিনি। কথা হয় তার সঙ্গে।
হালিমা খাতুন বলেন, ঘানিতে ভাঙা তেলের সঙ্গে মেশিনের তেলের ভিন্নতা রয়েছে। এর ঘ্রাণ অন্যরকম একটি ভালোলাগা তৈরি করে। এটি বিভিন্ন রকম ভর্তা তৈরিতে ব্যবহার করে থাকেন তিনি। মুড়ি মাখানোর কাজেও ব্যবহার হয় এ তেল।
Advertisement
মাসিক ১২ হাজার টাকা বেতনে এখানে কাজ করছেন চাঁন মিয়া (৬৫)। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, কৃষিকাজের পাশাপাশি দৈনিক ৬-৭ ঘণ্টা কাজ করছেন।এক মণ সরিষায় প্রায় ১১ কেজি তেল পাওয়া যায়। ঘানি তৈরিতে ব্যবহার করা হয় কড়ই কাঠ, বেল কাঠ ও আমগাছের কাঠ। এছাড়া যে যেমনটা ব্যবহার করেন। ঘানি ভাঙানোর কাজ করে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভালোই আছেন বলে জানান চাঁন মিয়া।
সরিষা তেলের নানাবিধ উপকারিতার বিষয়ে জামালপুর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. আরিফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, সরিষার তেল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে আশ্চর্যজনকভাবে কাজ করে। এটি স্বাস্থ্যগত সুবিধায় পূর্ণ। সরিষা তেল কোলেস্টেরল ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে, হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। এতে থাকা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান, ভিটামিন, মিনারেল চুলের অকালপক্বতা রোধ করে। এ তেল খাওয়ার পাশাপাশি বাহ্যিকভাবে ব্যবহার শরীরে রক্ত সঞ্চালন ও তাপমাত্রার ভারসাম্য বজায় রাখে।
তিনি আরও বলেন, সরিষার তেলে উচ্চমাত্রায় ভিটামিন ই থাকে। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি এবং অন্যান্য দূষিত পদার্থ থেকে ত্বককে সুরক্ষায় এ জুড়ি নেই।
উপজেলা সমাজসেবা অফিসার আরিফুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘শুনেছি আব্বাস আলী দীর্ঘদিন ধরেই ঘোড়ার সাহায্যে খাঁটি সরিষার তেল উৎপাদন করে আসছেন। তিনি উপজেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরে সঙ্গে যোগাযোগ করলে সহযোগিতা করা হবে।
সরিষাবাড়ী উপজেলা কৃষি অফিসার অনুপ সিংহ জাগো নিউজকে বলেন, গরু কিংবা ঘোড়া দিয়ে ঘানিতে সরিষা তেল উৎপাদন একটি গ্রামীণ ঐতিহ্য। দীর্ঘদিন ধরে আব্বাস আলী এটি করে আসছেন। এটি সত্যিই ভালোলাগার বিষয়।
এসআর/এমএস