ঈদের দ্বিতীয় দিন (রোববার) দুপুর ১২টার দিকে কল্যাণপুর থেকে তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে শাহবাগের শিশুপার্কে বেড়াতে যান শাহাদাত হোসেন। পার্কের সামনে গিয়ে দেখেন, প্রধান ফটকে তালা ঝুলছে। কিন্তু কেন তালা ঝুলছে তা জানানোর মতো কোনো লোকও নেই। পরে উঁকি দিয়ে দেখেন, ভেতরে পার্কের কোনো অস্তিত্ব নেই। কংক্রিটের বিভিন্ন ধরনের কাজ চলছে।
Advertisement
আলাপকালে শাহাদাত হোসেন বলেন, আমার জানা মতে চার থেকে পাঁচ বছর আগে শাহবাগ শিশুপার্কের সংস্কার কাজ শুরু হয়। ভেবেছিলাম, এতদিনে হয়তো সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে। নতুন নতুন রাইড বসানো হয়েছে। কিন্তু এখানে এসে দেখি, চিত্র ভিন্ন। পার্কটির কোনো অস্তিত্বই নেই।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাত বছরের ছেলেকে নিয়ে সস্ত্রীক শিশুপার্কের সামনে যান ঝিগাতলার বাসিন্দা রোকন উদ্দিন। সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে নামতেই দেখেন, সবাই পার্কের সামনে থেকে ফেরত যাচ্ছে। এমন দৃশ্য দেখে কিছুটা চিন্তায় পড়ে যান। কিছুক্ষণের মধ্যে হতাশ হয়ে ফিরে যান।
যাওয়ার আগে রোকন উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, আগে শাহবাগ শিশুপার্কের রাইডের ফি অন্যান্য পার্কের তুলনায় অনেক কম ছিল। তাই এ পার্কটি সবার পছন্দের শীর্ষে ছিল। কিন্তু এখন উন্নয়নের নামে সব ধ্বংস করে ফেলেছে। নতুন রাইড বসানো বা পার্কটি খোলার কোনো উদ্যোগ নেই।
Advertisement
শাহবাগ শিশুপার্কের (সাবেক শহীদ জিয়া শিশুপার্ক) জায়গার মালিক গণপূর্ত অধিদপ্তর। পার্কটি পরিচালনার দায়িত্ব ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি)। তবে চার বছর আগে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের আওতায় পার্কটির নিচে আন্ডারগ্রাউন্ড গাড়ি পার্কিংয়ের কাজ শুরু করে গণপূর্ত অধিদপ্তর। তাদের পার্কিং নির্মাণের কাজ শেষ হতে সময় লাগবে আরও এক বছর। এরপর পৃথক প্রকল্পের মাধ্যমে পার্কে রাইড স্থাপন করবে ডিএসসিসির যান্ত্রিক বিভাগ। সব মিলে পার্ক চালু করতে আরও অন্তত দুই বছর সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে পার্কের সামনে একটি বিজ্ঞপ্তি টানিয়ে এটি বন্ধ ঘোষণা করেছিল ডিএসসিসি। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতাস্তম্ভ নির্মাণ (৩য় পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় শিশু পার্কের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের কাজ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন থাকায় অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়ানোর লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় শিশুপার্ক সর্ব সাধারণের জন্য বন্ধ থাকবে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওই প্রকল্পের কার্যাদেশ অনুযায়ী স্বাধীনতাস্তম্ভ নির্মাণ (৩য় পর্যায়) প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু হয়ে ২০১৯ সালের মধ্যেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। একই সময়ের মধ্যে শিশুপার্কের নিচে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আগতদের গাড়ি পার্কিং ও কিছু অবকাঠামো সংস্কার কাজ শেষে এটি খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বরাদ্দ নিয়ে জটিলতার কারণে এখন পর্যন্ত পার্কের কাজ শুরুই হয়নি। এই কাজ শেষ করতে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্প মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিশুপার্কটির আধুনিক রাইড স্থাপনের কাজটি করবে ডিএসসিসি। এর জন্য স্বাধীনতাস্তম্ভ নির্মাণ (৩য় পর্যায়) প্রকল্পের মূল বরাদ্দ ২৬৫ কোটি টাকা থেকে ৭৮ কোটি টাকা ডিএসসিসি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু ডিএসসিসি শুরু থেকেই বরাদ্দ নিয়ে আপত্তি জানায়।
Advertisement
তখন ডিএসসিসির পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়কে বলা হয়, শিশুপার্কের বিদ্যমান রাইডগুলো ঝুঁকিপূর্ণ, নতুন রাইড বসাতে হবে। রাইড বসানো ও পার্কের উন্নয়নে এ বরাদ্দ অপর্যাপ্ত। এ নিয়ে দীর্ঘদিন চিঠি চালাচালি হয়। আড়াই বছর আগে দক্ষিণ সিটিকে নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে শিশুপার্কের আধুনিকায়ন করতে বলে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। পরে ডিএসসিসি প্রায় সাড়ে ৬০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প তৈরি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
ডিএসসিসির যান্ত্রিক বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আনিছুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, দুই বছর আগে ওই প্রকল্প স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে প্রকল্পটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে গেছে। কিন্তু একনেকে অনুমোদনের জন্য তা উপস্থাপন হয়নি। কিছু কাজ বাকি আছে। প্রকল্প অনুমোদনের পর অর্থছাড় হলে দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়া ও পার্কের অবকাঠামো উন্নয়ন শুরু হবে।
রোববার (২৩ এপ্রিল) সরেজমিনে দেখা যায়, আগে শিশুপার্কটি যে জায়গায় ছিল, তার বেশির ভাগ অংশেই স্বাধীনতাস্তম্ভ নির্মাণ (৩য় পর্যায়) প্রকল্পের আওতায় ভূগর্ভস্থ গাড়ি পার্কিংয়ের কাজ চলছে। আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিংয়ের ছাদ মাটি থেকে প্রায় চার ফুট উঁচু। এরমধ্যে কোন মডেলে পার্কিং হবে বা শিশু পার্কের নকশা কেমন হবে তার কোনো তথ্য বা থ্রিডি ছবি টানানো নেই। শুধু ফটকে ছোট্ট একটা টিনে লেখা ‘সাবধান পার্কের উন্নয়নের কাজ চলিতেছে।‘
সাংবাদিক পরিচয়ে ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, শিশুপার্কের ভেতরে যে রাইডগুলো ছিল এখন তার অধিকাংশ রাইডের অস্তিত্ব নেই। চরকি জাতীয় পৃথক দুটি রাইড আট ফুট উঁচু টিন দিয়ে ঘেরা। পার্কের পশ্চিম পাশে ঝোপঝাড়ে ফেলে রাখা হয়েছে বিমানবাহিনীর উপহার দেওয়া জেটবিমান। বিমানের ওপর ধুলাবালিসহ লতাপাতা ছড়িয়ে রয়েছে। শিশুপার্কটিতে কোনো শ্রমিককে কাজ করতে দেখা যায়নি। আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিংয়ে পানি জমে মশার লার্ভা ছড়াতে দেখা গেছে।
শহীদ জিয়া শিশুপার্ক এখন ‘হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শিশুপার্ক’:
২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) দ্বিতীয় পরিষদের ১১তম বোর্ড সভায় শহীদ জিয়া শিশুপার্কের নাম ‘হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শিশুপার্ক’ করা হয়েছে। এর আগে ২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধীন এলাকার সড়ক, ভবন ও স্থাপনা নামকরণ সংক্রান্ত উপ-কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভার সুপারিশের আলোকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কেন্দ্রীয় শিশুপার্কটির নাম ‘হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শিশুপার্ক’ নামে নামকরণের প্রস্তাব করা হলে তা সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন পায়। বোর্ডসভায় ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস সভাপতিত্ব করেন।
এমএমএ/এমএইচআর/জেআইএম