দেশজুড়ে

‘লাল ফিতায়’ বন্দি নোয়াখালী বিমানবন্দর

নোয়াখালী সদর উপজেলায় পরিত্যক্ত এয়ারস্ট্রিপকে পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দরে রূপান্তরে আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে দীর্ঘ একযুগ ধরে। পরপর তিন বিমান মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সরেজমিন পরিদর্শনের পর পরও ভাগ্য খোলেনি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নোয়াখালী বিমানবন্দরের।

Advertisement

স্বাধীনতার আগে ফসলি জমিতে কীটনাশক ছিটানোর জন্য উপজেলার ধর্মপুর ইউনিয়নের চর শুল্লুকিয়া গ্রামে ১৬ একর ভূমির ওপর একটি এয়ারস্ট্রিপ ছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সেটি যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার অভাবে পরিত্যক্ত হয়ে যায়। ওই এয়ারস্ট্রিপে ৩০ একর জমি অব্যবহৃত পড়ে আছে।

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নোয়াখালী সফরেও বিমানবন্দরের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়নসহ প্রবাসীদের কথা চিন্তা করে নোয়াখালী এয়ারস্ট্রিপকে পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দরে রূপ দেওয়ার উদ্যোগ নেয়।

২০১৭ সালে ১ আগস্ট নোয়াখালী-৫ আসনের সংসদ সদস্য সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে তৎকালীন বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেননকে চিঠি লেখেন। ওই চিঠিতে বলা হয়, পরিত্যক্ত স্থানটিতে একটি রানওয়েসহ ছোট টার্মিনাল আছে। জনস্বার্থ বিবেচনা করে নোয়াখালী সদর উপজেলায় অব্যবহৃত এয়ারস্ট্রিপে একটি নতুন বিমানবন্দর স্থাপনের জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান। বিমানমন্ত্রীও বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখার আশ্বাস দেন।

Advertisement

এরপর ২০১৮ সালের ২২ জুলাই তৎকালীন বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামাল এবং ২০২২ সালের ১৪ জানুয়ারি বর্তমান বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী এম মাহবুব আলী নোয়াখালী বিমানবন্দর এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করেন। তারা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে অচিরেই নোয়াখালী বিমানবন্দরের কাজ শুরু হওয়ার আশ্বাস দিলেও আজও প্রকল্পটি ‘লাল ফিতায়’ বন্দি।

এখানে মূলত ছোট আকারের বিমান অবতরণের জন্য স্বল্প পরিসরের রানওয়ে সমৃদ্ধ স্থান ‘এয়ারস্ট্রিপ’ আছে। তৎকালীন এই এয়ারস্ট্রিপের ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইএটিএ) কোড ছিল ‘জেডএইচএম’। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইকাও) কোড ছিল ‘ভিজিএসএইচ’। পরিত্যক্ত রানওয়েকে কাজে লাগিয়ে অনায়াসে বিমানবন্দরের উপযোগী করা যেতে পারে বলে জানিয়েছেন সমীক্ষা কর্মকর্তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকার নোয়াখালীতে প্রস্তাবিত বিমান বন্দরটি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে হস্তান্তর করেছে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গত বছরের ১-৫ মার্চ নোয়াখালীতে প্রস্তাবিত বিমান বন্দরে অবস্থান করে তাদের হেলিকপ্টার উড্ডয়ন করে। এরপর থেকে তারা স্থায়ীভাবে এখান থেকে তাদের হেলিকপ্টার উড্ডয়নে নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন।

সাবেক বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামাল জাগো নিউজকে বলেন, বৃহত্তর নোয়াখালীর বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ব্যাপক। এটি বিবেচনা করে সরকার নোয়াখালীতে একটি বিমানবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। বিমানবন্দরের নির্মাণ কাজের পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষে সমীক্ষার জন্য নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে দায়িত্ব দিয়ে তিন মাসের মধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাই কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে নোয়াখালীর বিমানবন্দর ও অবকাঠামো নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার কথা ছিল।

Advertisement

সাবেক এ বিমানমন্ত্রী আরও বলেন, নোয়াখালীর বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠী দেশের বাইরে আছেন। দেশের শিল্পোদ্যোক্তাদের একটি বড় অংশের বাড়ি নোয়াখালী। নোয়াখালীর দক্ষিণে শিল্পাঞ্চল ও সেনানিবাসসহ অসংখ্য ছোট ও মাঝারি ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে। এখানে বিমানবন্দর হবে ইকোনমিকেলি ভায়াবেল। তাই দ্রুত এ জেলায় একটি বিমানবন্দরের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।

অন্যদিকে বর্তমান বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী এম মাহবুব আলী জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে এর আগেও বিমানবন্দরের স্থানটি পরিদর্শন করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমরা আবারও পরিদর্শনে যাই। বিমান খাতে এরই মধ্যে বড় ধরনের একটি বিপ্লব হয়েছে। রানওয়েসহ পুরো এলাকাটি আমরা ঘুরে দেখেছি। নোয়াখালীবাসীর প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা করছি।

এদিকে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়াসহ উপকূলীয় কোম্পানীগঞ্জে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা আছে। এখানকার স্বর্ণদ্বীপে সেনাঘাটি, মুছাপুরে নৌবন্দরসহ দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে উঠছে অর্থনৈতিক অঞ্চল। এছাড়া এ জেলার বেশিরভাগ মানুষ জীবিকার তাগিদে ইউরোপ আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে থাকে। দেশের অর্থনীতির এক তৃতীয়াংশ যোগান দেয় এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা। পুরোনো এয়ারস্ট্রিপকে পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দরে রূপ দিলে দেশের অর্থনীতিতে তা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।

নোয়াখালী জেলা প্রশাসক (ডিসি) দেওয়ান মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, নোয়াখালীতে বিমানবন্দর স্থাপন অতীব জরুরি। এখানে সম্ভাব্যতা যাচাইও করা হয়েছে। বিষয়টি এখন সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তের জন্য আটকে আছে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা চাইলে ওপর মহলে কথা বলে বিষয়টির সুরাহা করতে পারেন।

নোয়াখালী-৪ (সদর-সুবর্ণচর) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, বিষয়টি আমার জানা নাই। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ভালো বলতে পারবেন। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ খায়রুল আনম সেলিমকেও জিজ্ঞেস করতে পারেন।

তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিমের মোবাইল নম্বরে বারবার কল দিলেও রিসিভ না করায় তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ইকবাল হোসেন মজনু/এসজে/এমএস