রমজান শেষে খুশির বার্তা নিয়ে আবারও এসেছে ঈদুল ফিতর। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর মুসলমানরা ঈদুল ফিতর উদযাপন করে। ঈদ উৎসব নিছক ধর্মীয় নয়, এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বও রয়েছে। আর ঈদের উৎসবও সর্বজনীন। ঈদের সামাজিক অর্থ হলো উৎসব, আর ভাষাগত অর্থ হলো বারবার প্রত্যাবর্তন। তাই প্রতি বছর মুসলমানদের জীবনে ফিরে আসে খুশির ঈদ।
Advertisement
বাংলাদেশে ঈদ জাঁকজমকপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে পালিত হয়। এই দিনে সবাই যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী ভালো পোশাক পরে। বাড়িতে ভালো মানের খাবারের ব্যবস্থা করে। আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীরাও এই আনন্দে শরিক হন। দরিদ্র জনগোষ্ঠীও এই দিনটিকে যথাযথ মর্যাদা ও আনন্দের সাথে পালন করে। এই দিনে মুসলমানরা ঈদগাহ বা মসজিদে নামাজ পড়েন।
ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে। তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে ঈদের আবেগ ও আনন্দ শেয়ার করা হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সমাজের ধনী ও সামর্থ্যবানরা দরিদ্রদের একটি নির্দিষ্ট হারে যাকাত ও ফিতরা বিতরণ করে, যা ধনীদের জন্য ধর্মীয়ভাবে বাধ্যতামূলক।
বাংলা অঞ্চলে আজও ঈদ ও ঈদ উৎসবের ইতিহাস সঠিকভাবে জানা যায় না। বাংলাদেশে রোজা ও ঈদ-উল-ফিতর উদযাপনের ইতিহাস বিভিন্ন ঐতিহাসিক বই, সূত্র এবং যোগাযোগ থেকে কিছুটা জানা যায়। ঐতিহাসিক ও পণ্ডিতরা উল্লেখ করেছেন যে ঈদ উৎসব ধ্রুপদী ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
Advertisement
তাঁরা আরও বলেন, যদিও দ্বাদশ শতাব্দীতে বাংলায় ইসলামের আগমন ঘটে তবে শাস্ত্রীয় ইসলাম চার থেকে পাঁচশ বছর ধরে নিবিড়ভাবে অনুসরণ করা হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। সেকালের বাংলায় ঈদ উৎসবের তেমন কোনো ঘটনা লক্ষ্য করা যায় না। কারণ দুটি হতে পারে: এক- গ্রাম বাংলার মুসলমানরা দরিদ্র ছিল এবং দুই- মুসলমানদের মধ্যে স্বতন্ত্র সম্প্রদায়বোধ প্রবল ছিল না। ফলে ধর্মীয় উৎসবকে সামাজিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করার শর্ত তৈরি হয়নি। এবং এটি সর্বজনবিদিত যে একটি দৃঢ় সামাজিক ভিত্তি ছাড়া কোনো উৎসব উদযাপন প্রতিষ্ঠা করা যায় না। সপ্তদশ, অষ্টাদশ, ঊনবিংশ শতাব্দীতেও বৃহত্তর বাংলায় ঈদ উৎসব দেখা যেত না।
অভিজাত লোকেরা (নবাব বা বাদশা) ঈদ উদযাপন করত, কিন্তু তা তাদের এবং উচ্চবিত্তদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ঈদ সাধারণ মানুষের সামাজিক উৎসব হিসেবে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেনি। উনিশ শতক জুড়ে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন শহুরে জীবন এবং গ্রামীণ ধনী বা শিক্ষিত সমাজকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। অন্যান্য ধর্মের কঠোর আচরণবিধি বাংলায় ইসলাম ধর্মের প্রসারে সহায়তা করে। ফলে ইসলাম ধর্মের নানা অনুষঙ্গ ও উৎসবাদি প্রচলিত হতে থাকে। সাধারণ মানুষ এসব উৎসব পালন করা শুরু করে।
যাই হোক, ঈদ-উল-ফিতর ভালোবাসা ও মিলনের উৎসব, মানুষের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি গড়ে তোলার উদযাপন। এটা সবার জন্য আনন্দ নিয়ে আসে। ঈদ সকল মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। জাতীয় জীবনে এর আবির্ভাব সর্বত্র দেখা যায়। সব ক্ষেত্রে, এর ইতিবাচক প্রভাব উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন ধর্মের মানুষও ঈদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুফল ভোগ করে।
সামাজিক গুরুত্ব ছাড়াও এর অর্থনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্ব রয়েছে। ঈদ উৎসবকেন্দ্রিক আয়োজনও কম নয়। ঈদকে সামনে রেখে ঈদের বাজার চাঙ্গা হয় যা একই সঙ্গে দেশের অর্থনীতিকেও মজবুত করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঈদের বাজারে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয় বলে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা মনে করেন। দারিদ্র্য হ্রাস, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ায় ঈদকেন্দ্রিক লেনদেন প্রতি বছর বাড়ছে।
Advertisement
ঈদ উপলক্ষে প্রবাসীরা অনেক রেমিট্যান্স দেশে পাঠান। ঈদের সময় বৈদেশিক অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রামীণ অর্থনীতি আরও চাঙ্গা হয়। ব্যাংকিং খাতও শক্তিশালী হয়। এ উপলক্ষে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে অন্য সময়ের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি লেনদেন হয়।
ঈদের সময় এই আনন্দ উৎসব উপভোগ করতে সবাই চায় প্রিয়জনের কাছাকাছি থাকতে। বাংলাদেশের অনেক মানুষ জীবিকার সন্ধানে ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে বাস করে। আর তাদের অধিকাংশ পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন গ্রামে থাকে। তাই ঈদের উৎসবে তারা নাড়ির টানে গ্রামে ফেরে। বাড়ি না ফিরলে অধিকাংশ পরিবারই ঈদ উদযাপন অসম্ভব বলে মনে করে। তাই পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে গ্রামে ফেরেন তারা।
এ ছাড়া ঈদের সময় অপেক্ষাকৃত বেশি ছুটি থাকায় অনেকেই আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যেতে পারেন। এ কারণে সামাজিক সম্পর্ক জোরালো হয়। ঈদে মানুষের যাতায়াত বেশি হয়। ফলে ট্রেন, বাস ও লঞ্চে আসন না পাওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে অভ্যন্তরীণ যাত্রীরা প্রতি বছরই ভোগান্তিতে পড়েন।
অন্যান্য সমস্যা হচ্ছে অতিরিক্ত যাত্রী বহন, যানজট সৃষ্টি, সড়ক দুর্ঘটনা ইত্যাদি। গণপরিবহনের উচ্চ ভাড়া এবং সময়সূচীর ব্যাঘাত যাত্রীদেরকে ভোগান্তিতে ফেলায়। তাছাড়া ঈদের আগে ও পরে সড়ক দুর্ঘটনায় অনেকে নিহত ও আহত হয। সুতরাং, তাদের পরিবারে ঈদের আনন্দের পরিবর্তে নেমে আসে বিষাদের ছায়া।
দেশের বেশির ভাগ মানুষ যখন দুর্ভোগ ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গ্রামে ছুটে যায়, সে সময় অনেক বিত্তবান ব্যক্তিরা দেশ ছেড়ে বিদেশে ঈদ উপভোগ করতে যান। ধনী-গরিবের এই বৈষম্য ঈদ উৎসবের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঈদ উদযাপনের জন্য উৎসব ভাতা পান। এখনো দিনমজুর, কৃষক, রিকশাচালকসহ অনেক নিম্ন আয়ের মানুষ এসব সুবিধা বঞ্চিত। তাছাড়া অন্যান্য পেশার মানুষ কয়েকদিন ঈদের ছুটি উপভোগ করতে পারলেও উৎসবের দিনেও কাজ করতে হয় কৃষক-দিনমজুরদের। এদিকে ঈদের আগে বেতন-বোনাস না পাওয়ায় বেসরকারি খাতের অনেক শ্রমিক ও তাদের পরিবারের ঈদ উৎসব ম্লান হয়ে যায়।
ঈদের খুশির দিনেও অনেক অসহায়-গরিব মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটায়। এছাড়া অনেক পথশিশু কাগজ সংগ্রহ করে বিড়ি-সিগারেট বিক্রি করে ঈদের দিন পার করে। ঈদের আনন্দ তাদের নাগালের বাইরে। তাদের পক্ষে নতুন পোশাক পরা, বিনোদন বা আনন্দ উপভোগ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তারা চিড়িয়াখানা এবং শিশু পার্কসহ বিভিন্ন শিশুদের বিনোদন কেন্দ্রে যায়, তবে ঈদ আনন্দ উপভোগের জন্য নয় বরং তাদের বেঁচে থাকার জন্য, জীবিকার সন্ধানে। তবে ধনীদের দয়ার কারণে কিছু গরীব মানুষ নতুন জামাকাপড় পরে ভালো খাবার খেয়ে ঈদ উদযাপন করে। ধনীদের পাশাপাশি গরিবদের ঘরেও ঈদ কিছুটা আনন্দ নিয়ে আসে।
ভ্রাতৃত্ববোধ ও জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলাই ঈদের মূল শিক্ষা। পুরনো দিনের বিদ্বেষ আর হানাহানির কথা ভুলে মুসলিমরা একে অপরকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে সাম্যের উৎসবে। পবিত্র ঈদুল ফিতরে জাতীয় ঐক্য, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ব সুসংহত হয়। কিন্তু পার্থক্যটা দেখা যায় আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের কথাবার্তা ও আচরণে। এমনকি এই পবিত্র উৎসবের দিনেও তারা রাজনৈতিকভাবে বৈরি আচরণ করে।
তাদের কণ্ঠে জাতীয় ঐক্যের বদলে অনৈক্য শোনা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা জাতিকে আরও উৎকণ্ঠিত করেছে। এই রাজনৈতিক উৎকণ্ঠার কারণে পবিত্র ঈদের জাতীয় সম্প্রীতি চরমভাবে ব্যাহত হয়। একদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি, আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে ঈদের আনন্দ সীমিত হয়ে পড়েছে অন্যদিকে জাতীয় নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক অনৈক্যের কর্মসূচি ঈদের রোমাঞ্চকে ম্লান করে দিয়েছে।
মুসলিম সমাজের প্রধান আনন্দ উৎসব ঈদ। আর এই উৎসবের মূলে রয়েছে সামাজিক ঐক্য। ঈদুল ফিতরের সকল অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা, আন্তরিকতা ও সহমর্মিতা বিনিময়ের মাধ্যমে মানবিক ও সামাজিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এটাই ঈদুল ফিতরের সামাজিক তাৎপর্য।
বিশ্বব্যাপী প্রতিটি মুসলমান যাতে ঈদুল ফিতরের আনন্দ উপভোগ করতে পারে সেজন্য রমজান মাসে অধিক হারে দান, যাকাত ও ফিতরা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ঈদ উৎসবে কেনাবেচা বেড়ে যায় যা অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করে। এটাই ঈদুল ফিতরের অর্থনৈতিক গুরুত্ব। পবিত্র ঈদ মানব সম্প্রীতির এক অনন্য নিদর্শন, যেখানে ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, কালো-সাদা নির্বিশেষে সবাই একই কাতারে মিলিত হয়।
যাই হোক, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে গত দুই বছরে ঈদ উৎসব তেমন জমেনি। এছাড়াও রমজান মাস শুরু হওয়ার আগে ও রোজার মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরণ ও ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে ঢাকার বঙ্গবাজার ও নিউ মার্কেটে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডে বহু ব্যবসায়ী সর্বস্বহারা হন।
এছাড়াও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নাভিশ্বাস ওঠেছে মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে সকল স্তরের মানুষের মধ্যে। তাই তাদের জন্য ঈদ উৎসব উদযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়াও আবহাওয়ার বৈরিতা বিশেষ করে তীব্র গরমে নিম্ন আয়ের ও খেটে খাওযা মানুষের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে। তাদের উপার্জন কমে যায় এবং ঈদ উৎসব ম্লান হয়ে যায়। তবে তা সত্ত্বেও ঈদ উৎসবের আর্থ-সামাজিক গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।
এইচআর/এমএস