চার মাস ধরে কঠোর পরিশ্রম করে কৃষক মাত্র ঘরে তুলতে শুরু করেছেন তরমুজ। একদিকে রোজা অন্যদিকে প্রচণ্ড গরমের কারণে খুলনা জেলার দাকোপ, বটিয়াঘাটা, কয়রা ও পাইকগাছার তরমুজের চাহিদাও বেশ। সেই চাহিদাকে পুঁজি করে মধ্যস্বত্বভোগীদের পোয়াবারো হলেও কৃষকরা দেখছেন পুঁজি উঠে আসার বিষয়টি। ক্ষেত থেকে তারা একটি তরমুজ বিক্রি করছেন ৩০-৩৫ টাকায়। কিন্তু ক্রেতার হাতে সেই তরমুজ যাচ্ছে ১৫০-২০০ টাকায়। মধ্যস্বত্বভোগীরা বিপুল পরিমাণ লাভ করলেও কৃষক যা পাচ্ছেন, তাতেই তারা খুশি। তবে অনেক এলাকায় প্রাকৃতি বিপর্যয়ের কারণে কৃষকরা লোকসানের আশঙ্কা করছেন।
Advertisement
খুলনার কৃষি অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি বছর খুলনায় ১২ হাজার ২২৫ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে। এর মধ্যে দাকোপ উপজেলায়ই চাষ হয়েছে ৬ হাজার ৩২০ হেক্টর জমিতে। যা গত বছরের তুলনায় একটু কম। বাকি প্রায় ৬ হাজার হেক্টর চাষ হয়েছে বটিয়াঘাটা, কয়রা, পাইকগাছা, তেরখাদা, রূপসা উপজেলায়।
কৃষকরা মনে করেছিলেন, এবার রোজার সময় তাদের তরমুজ বাজারে আসবে। কিন্তু খুলনার কৃষকদের উৎপাদিত তরমুজ বাজারে আসার আগেই বরিশাল বিভাগের তরমুজে বাজার সয়লাব হয়ে যায়। বিশাল বিশাল সেই তরমুজ ক্রেতাদের তৃপ্তি মেটাতে সক্ষম না হওয়ায় তারা অপেক্ষা করতে থাকেন খুলনা জেলার তরমুজের জন্য। রোজা ১৫-১৬টি পার হলেই বাজারে আসে স্থানীয় তরমুজ। যা ক্রেতাদের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়।
খুলনার পাইকারি মোকাম কদমতলায় খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, দাকোপ পাইকগাছার মাঝারি সাইজের তরমুজ গড়ে বিক্রি হয়েছে ১০০ পিস ৬ হাজার টাকায়। ছোট-বড় সব তরমুজের গড় মূল্য প্রতি পিস ৬০ টাকা। দাকোপ বটিয়াঘাটার আরও কাছে নগরীর ময়লাপোতা এলাকায় ভ্যান ও ফলের দোকানে সেই তরমুজ বিক্রি হয়েছে ২০০-২২০ টাকায়। শুধু ময়লাপোতা এলাকায়ই নয়, নগরীর প্রায় সব জায়গায় ৩০-৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে সেই তরমুজ।
Advertisement
আরও পড়ুন: দ্বিগুণের বেশি লাভের আশা কৃষকের
নগরীর কদমতলা মোকাম ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে অন্য জেলার তরমুজ নেই। গরমে চাহিদা বাড়ায় সবাই তাকিয়ে আছেন দাকোপের তরমুজের দিকে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা অনেকে দাকোপে গিয়ে তরমুজ কিনে আনছেন। আকারে একটু ছোট হলেও দাকোপের তরমুজ কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ক্রেতারা।
বটিয়াঘাটা উপজেলার গঙ্গারামপুর ইউনিয়নের দেবিতলা এলাকার তরমুজ চাষি ভূপতি রায় জানান, স্থানীয় বাজারে এই তরমুজের বিশাল চাহিদা থাকায় এলাকার কৃষকদের মধ্যে এ নিয়ে বেশ আগ্রহ দেখা দিয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় তরমুজ খুব ভালো হয়েছে। তবে সঠিক সময়ে বৃষ্টি না হওয়ায় তরমুজের আকার হয়েছে ছোট।
ফুলতলা গ্রামের মিরান ৪ বিঘা জমিতে প্রথমবারের মতো তরমুজ চাষ করেছেন। অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি বীজ বপন করেন। পানি, সার, ওষুধ দেওয়াসহ যাবতীয় কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে সম্পন্ন করেন তিনি।
Advertisement
গত কয়েক দিন আগে হঠাৎ বৃষ্টিতে তরমুজ গাছের গোড়া পচন ধরে, এরপরই শুরু হয় খরা। যা তাকে বেশ ক্ষতির মুখে ঠেলে দিয়েছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে তার তরমুজ সাদা হয়ে গেছে। যা বিক্রির অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
বটিয়াঘাটা উপজেলার কৃষি অফিসার মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ‘গত বছর বটিয়াঘাটা উপজেলায় তরমুজ চাষ হয়েছিল সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর জমিতে। এবার হয়েছে ৩ হাজার হেক্টর জমিতে। প্রাকৃতিক কারণে কিছু কিছু এলাকার তরমুজের ফলন ভালো হয়নি।
আরও পড়ুন: তরমুজের বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে হাসি
দেবিতলা গ্রামের কৃষক ভূপতি রায় বলেন, ‘আমি অসুস্থ তবুও স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে আড়াই বিঘা জমিতে তরমুজ লাগাই। তাতে আমার খরচ হয় ৭০ হাজার টাকা। এখন বিক্রির উপযোগী হয়েছে। ব্যাপারিরা সেই তরমুজের দাম বলছে ৮০ হাজার টাকা।’
ফরিদপুর এলাকার তরমুজ ব্যবসায়ী মো. আব্দুল জব্বার বটিয়াঘাটার ফুলতলা মঠ এলাকার ৪ বিঘা জমির তরমুজ কিনেছেন মাত্র ৬০ হাজার টাকায়। তিনি বলেন, ‘অনুমান করেছিলাম ১ হাজার পিস তরমুজ পাবো কিন্তু পেয়েছি ৭০০ পিস। এতে আমার কিছুটা লোকসান হবে।’
এদিকে বটিয়াঘাটায় তরমুজ খুব ভালো না হলেও দাকোপ উপজেলার প্রায় সব এলাকায়ই তরমুজ ভালো হয়েছে। দাকোপ এলাকার কৃষকরা জানান, দুইভাবে তাদের তরমুজ বিক্রি হয়। ঢাকা থেকে ব্যবসায়ীরা দাকোপে এসে মাঠ থেকে সরাসরি তরমুজ কেনেন। তারাই ট্রাকে করে তরমুজ নিয়ে যান। চলতি সপ্তাহে ছোট আকারের তরমুজ (৩-৫ কেজি) প্রতি বিঘা বিক্রি হয়েছে ৭০-৮০ হাজার টাকা। একই তরমুজ গত বছর বিক্রি হয়েছে ৩০-৩৫ হাজার টাকা। এছাড়া বড় আকারের (৮ কেজির উপরে) তরমুজ বিক্রি হচ্ছে ১ লাখ টাকায়।
এছাড়া কোনো কোনো কৃষক নিজেই তরমুজ নিয়ে খুলনার কদমতলায় পাইকারি বিক্রি করেন। পাইকারি তরমুজ বিক্রি হয় পিস হিসেবে। ছোট আকারের তরমুজ (৩-৫ কেজি) প্রতি পিস আজ বিক্রি হয়েছে ৫০-৬০ টাকা পিস। বড় তরমুজ বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকা পিস।
দাকোপ উপজেলার পানখালী ইউনিয়নের কৃষক আজগর হোসেন জানান, শুরুতে প্রতি বিঘা ৪০-৪৫ হাজার টাকায় বিক্রি হবে বলে তারা আশা করেছিলেন। কিন্তু এখন দাম ৭০ হাজারের ওপর। এতে কৃষকরা খুশি।
আরও পড়ুন: ২ হাজার কোটি টাকার বেশি তরমুজ বিক্রি হবে
দাকোপ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কে এম মাকসুদুন্নবী জানান, গত সোমবার পর্যন্ত আড়াই হাজার হেক্টর জমির তরমুজ বিক্রি হয়েছে। প্রতিদিন ৫০০-৬০০ হেক্টর জমির তরমুজ সংগ্রহ হচ্ছে। বেশিরভাগ তরমুজই ঢাকায় যাচ্ছে। ঈদের আগেই ৮৫ শতাংশ তরমুজ বিক্রি করা হবে।
কৃষকরা জানান, তরমুজ বিক্রিতে বড় বাঁধা হয়ে দেখা দিয়েছে পরিবহনে চাঁদাবাজি। প্রতিদিন অসংখ্য ট্রাক তরমুজ পরিবহনের জন্য দাকোপ থেকে বিভিন্ন রুটে যাচ্ছে। প্রায় মোড়ে তারা চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন। এ থেকে পরিত্রাণের দাবি জানিয়েছেন কৃষকরা।
খুলনা জেলার কৃষি অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) কৃষিবিদ মো. মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, ‘দাকোপে তরমুজ ভালো হয়েছে। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল বেশ ভালো দামেই বিক্রি করছেন। গত বছর দাকোপ উপজেলায় লাউডোবে ফেরি না থাকায় ব্যবসায়ীরা ট্রাক নিয়ে আসতে পারেননি। ফলে ক্ষেতেই পচে যায় অধিকাংশ তরমুজ। কিন্তু এবার লাউডোব ফেরিঘাটে দুটি ফেরি চালু হওয়ায় খুব সহজেই দাকোপের তরমুজ চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। কৃষক অনেকটা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘দাকোপের দিগন্তজুড়ে তরমুজ ক্ষেত। কৃষকের তরমুজ উত্তোলন, শত শত ট্রাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া, মাঝে মাঝে লঞ্চে তরমুজ ওঠানো; সবকিছু মিলিয়ে কৃষকের মাঝে যেন ঈদের আনন্দ বিরাজ করছে।
আলমগীর হান্নান/এসইউ/এএসএম