মতামত

চীনের ষষ্ঠ সৌরপদ ‘কু ইয়ু’ এবং চা

‘মাছে-ভাতে বাঙালি’র চা না-হলেও চলে না। সকালে নাশতার টেবিলে চায়ের পেয়ালা থাকা চাই-ই চাই। অথচ দুশ বছর আগেও বাঙালি চা কী জিনিস—জানতো না। যতদূর জানি, বাংলায় চা-শিল্পের প্রথম প্রচলন করেছিলেন রবার্ট ব্রুস নামের এক ইংরেজ ভদ্রলোক। তিনি ১৮৩৪ সালে আসামে প্রথম চা-গাছের সন্ধান পান। আর ‘আসাম চা কোম্পানি’র মাধ্যমে তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের আসামেই, ১৮৩৯ সালে, বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়।

Advertisement

তবে, বাঙালিকে চা-পানে অভ্যস্ত করাতে ইংরেজদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। শুরুর দিকে কলকাতার বৌবাজার ও ঠনঠনিয়ায় তারা বিনামূল্যে চা-পানের ব্যবস্থা করে। পরে এই সিলসিলা ছড়িয়ে পড়ে বাংলাজুড়ে। বিনামূল্যে চা খাওয়ানোর পাশাপাশি চলতে থাকে প্রচার-প্রচারণা। বিশেষ করে, বড় বড় রেলস্টেশনে, বড় বিজ্ঞাপন বোর্ডে চায়ের গুণকীর্তন লিখে চলতে থাকে প্রচারণা।

চীনের একটি চা-বাগানে লেখক

‘চায়ে মাদকাসক্তি নেই’, ‘জীবনীশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক’, ‘খেতে সুস্বাদু’, ‘কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই’, চা ‘ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, কলেরা, আমাশয়, প্লেগ দূর করে’ বলেও সেসব বোর্ডে দাবি করা হতে থাকে। এ ধরনের বিজ্ঞাপন বোর্ডে একটি বাক্য নাকি ছিল কমন, আর সেটি হচ্ছে: ‘থাকলে মায়ের বাপের আশীর্বাদ, ভালো চা আর কাপড় যায় না বাদ’।

Advertisement

বাঙালি নাকি মাগনা পেলে আলকাতরাও খায়। চা তো নির্দোষ পানীয়! ধীরে ধীরে চা-কে বাঙালি আপন করে নিতে শুরু করে। কিন্তু কোনো কোনো ত্যাঁদড় বাঙালি যে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াননি—তা কিন্তু নয়! খোদ বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায় চায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন। তিনি ‘দেশ’ পত্রিকায় লেখেন ‘চায়ের প্রচার ও দেশের সর্বনাশ’ শীর্ষক নিবন্ধ। চা চাষের ফলে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে তিনি লেখায় যুক্তি দেন। বাঙালি সমাজের একটা বড় অংশ তাঁর পেছনে এসে দাঁড়ায়।

চা-পাতা শুকানোর কাজ চলছে

কিন্তু ইংরেজ ছিল নাছোড়বান্দা। চায়ের উপকারিতা নিয়ে তারাও প্রচার-প্রচারণা চালাতে থাকে। পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে একের পর এক বিজ্ঞাপন। চায়ের গুণ বর্ণনা করে, ১৯০০ সালের দিকে, গিরিশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘চা প্রস্তুতপ্রণালি শিক্ষা’ নামের পুস্তিকা প্রকাশ করেন। পরে, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, বিদ্রোহী কবি নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মতো বিখ্যাত বাঙালিও চায়ের পক্ষে কলম ধরেন। তাদের লেখায় চায়ের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ পেতে থাকে। এখন বাঙালির সকাল-বিকাল চা না হলে চলে না।

আসলে, শুধু বাঙালির নয়, বিশ্বের অধিকাংশ মানুষেরই এখন আর কমবেশি চা না হলে চলে না। বিশ্ববাসী সবচেয়ে বেশি পান করে পানি। এরপরই চায়ের স্থান। বিশ্বের মানুষ সবমিলিয়ে যতটুকু কফি, হালকা পানীয় ও মদ পান করে, প্রায় ততটুকু চা পান করে। এমনই এর জনপ্রিয়তা!

Advertisement

চলছে চা বাছাইয়ের কাজ

চা মূলত এশিয়া ও আফ্রিকায় উৎপন্ন হয়। দক্ষিণ আমেরিকা এবং কৃষ্ণ সাগর ও কাসপিয়ান সাগর এলাকায়ও চা হয়। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি চা উৎপন্ন হয় চীনে (৪২ শতাংশ)। এরপরই ভারতের স্থান (২০ শতাংশ)। বিশ্বের মোট উৎপাদিত চায়ের (প্রায় ৭০ লাখ টন) ৭৫ শতাংশই উৎপন্ন হয় চীন, ভারত, কেনিয়া ও শ্রীলঙ্কায়। উৎপাদনের দিক দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও, ভোগের দিক দিয়ে ভারত বিশ্বে শীর্ষস্থানে আছে। মানে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি চা খাওয়া হয় ভারতে। অবশ্য, মাথাপিছু ভোগ হিসেব করলে, এক্ষেত্রে সব দেশের চেয়ে এগিয়ে আছে তুর্কিয়ে (তুরস্ক)। এই দেশের মানুষ বছরে মাথাপিছু আড়াই কিলোগ্রাম চা খায়। ভারতে মাথাপিছু বার্ষিক চা ভোগের পরিমাণ মাত্র ৭৫০ গ্রাম।

বাঙালিকে চা-পান শিখিয়েছে ইংরেজ, ইংরেজ তথা বিশ্বকে চা-পান শিখিয়েছে চীন এবং চীনকে চা-পান শিখিয়েছেন সম্রাট শেন নোং শি। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে, তিনি ঘটনাক্রমে চা আবিষ্কার করেন। কথিত আছে, সম্রাট শেন নোং শি-এর উপস্থিতিতে একবার ঘরের বাইরে একটি পাত্রে পানি গরম করা হচ্ছিল। এমন সময় কয়েকটি পাতা কোথা থেকে উড়ে এসে পড়ে সেই পানিতে। কিছুক্ষণের মধ্যে পাত্রের পানি হলুধাভ রঙ ধারণ করে। সম্রাট সে পানির স্বাদ গ্রহণ করে দেখলেন, পাতামিশ্রিত পানি শরীর সতেজ করে (আধুনিক কালে এসে আমরা জানি যে, চায়ের ‘ক্যাফেইন’র জন্য দায়ী)। এই পাতাই ছিল চা-পাতা। কথিত আছে, সম্রাট শেন কয়েকশ ধরনের গাছের পাতার স্বাদ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি চা-কে শুধু পানীয় নয়, বরং ওষুধ হিসেবে গণ্য করতেন। সেই থেকে চীনারা নিয়মিত চা পান করে আসছে।

কু ইয়ু কৃষিকাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময়

চীনে নানান কিছিমের চা উৎপন্ন হয়। চীনারা চা-পান করেও সারা বছর ধরেই। তবে, ষষ্ঠ সৌরপদ ‘কু ইয়ু’ তথা ‘শস্যবৃষ্টি’র সময়ে তারা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে চা পান করে। আমার লেখার নিয়মিত পাঠকরা জানেন, চীনের চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে বছরকে ভাগ করা হয় ২৪টি সৌর পদে (solar terms)। প্রাচীন চীনে হলুদ নদীর অববাহিকায় এই ২৪ সৌরপদের উৎপত্তি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই ২৪ সৌরপদ ‘চীনের পঞ্চম মহান আবিষ্কার’ (Fifth Great Invention of China) হিসেবে স্বীকৃত। ইউনেস্কোও একে মানবজাতির অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

প্রতিটি সৌরপদের আছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। প্রাচীনকাল থেকেই চীনারা সৌরপদ অনুসারে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে কৃষিকাজ আঞ্জাম দিয়ে আসছে। বছরের কোন সৌরপদে আবহাওয়া কেমন থাকবে—তা নামগুলো দেখলেই বোঝা যায়। সৌরপদ অনুসারে চীনারা তাদের খাওয়া-দাওয়ায়ও পরিবর্তন আনে, পরিবর্তন আনে পোশাক-আশাকে। এখন চলছে সৌরপদ ‘কু ইয়ু’। চীনা ভাষায় ‘কু’ মানে ‘শস্য’ এবং ‘ইয়ু’ মানে ‘বৃষ্টি’। এই সৌরপদের শুরু ২০ এপ্রিল এবং শেষ ৫ মে।

ষষ্ঠ সৌরপদে বালুঝড় হয়

চীনের এক প্রাচীন প্রবাদে বলা হয়েছে: ‘বৃষ্টি শত শস্যের বৃদ্ধি নিয়ে আসে।’ কু ইয়ু সৌরপদের নামটি এসেছে এই প্রবাদ থেকে। এই সৌরপদে বৃষ্টি হয়, যা শস্য উৎপাদনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কু ইয়ু সৌরপদের আগমন মানে শীতের প্রস্থান। এ সময় দ্রুত তাপমাত্রা বাড়তে থাকে।

কু ইয়ু সৌরপদ কৃষিকাজের উত্তম সময়। আগেই বলেছি, এ সময় তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। বৃষ্টিপাতও হয়। বিভিন্ন শস্যের গাছও এ সময় দ্রুত বড় হতে থাকে। কৃষকদের অবশ্য সাবধান থাকতে হয়। কীটপতঙ্গের আক্রমণের মোক্ষম সময়ও এটি।

কু ইয়ু সৌরপদে চীনারা বিশেষভাবে চা পান করে

কু ইয়ু সৌরপদে চীনের বিভিন্ন স্থানে বালুঝড় হয়। সময়টা বসন্তের শেষ ও গ্রীষ্মের শুরু। তাপমাত্রার দ্রুত বৃদ্ধির কারণে মাটি শুকিয়ে যায়; বাতাসের তীব্রতাও থাকে বেশি। বালুঝড়ের জন্য এরচেয়ে বেশি কিছু লাগে না। চীনের রাজধানী বেইজিং আগে ঘন ঘন বালুঝড়ে আক্রান্ত হতো। তেমন দু-একটি ঝড়ের সাক্ষী আমি নিজেও। তবে, শহরের চারদিকে কৃত্রিম বন সৃষ্টির মাধ্যমে, বেইজিংকে এখন অনেকটাই বালুঝড়মুক্ত রাখা সম্ভব হচ্ছে।

আগেই বলেছি, কু ইয়ু সৌরপদে চীনারা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে চা পান করে, বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। এই সৌরপদের প্রথম দিন ঘটা করে চা পান করা এতদঞ্চলের একটি প্রাচীন রীতি। কু ইয়ু সৌরপদে উৎপন্ন চা ভিটামিন ও অ্যামিনো এসিডে সমৃদ্ধ, যা শরীর থেকে অতিরিক্ত তাপ বের করে দেয়। এ চা চোখের জন্যও কল্যাণকর। স্থানীয়রা এও বিশ্বাস করেন যে, কু ইয়ু সৌরপদের প্রথম দিন চা পান করলে দুর্ভাগ্য দূরে থাকবে।

চীনাদের প্রিয় সবজি

টুনা সিনেনসিস (toona sinensis) গাছকে ‘চীনা মেহগনি’ও বলা হয়। এ গাছটি চীনে ‘বিফ অ্যান্ড ওনিয়ন প্লান্ট’ নামেও পরিচিত। এই গাছের কচি পাতা থেকে পেঁয়াজের গন্ধ পাওয়া যায়। এই পাতা চীনজুড়েই সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। এতে ভিটামিন ই, আয়রন, ক্যালসিয়াম ও ক্লোরোফিল আছে। ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসাবিদ্যা অনুসারে, এই সবজি হজমের শক্তি বাড়ায় ও কাশি প্রশমন করে। এটি ত্বকের জন্যও ভালো। ষষ্ঠ সৌরপদের প্রথম দিন এই সবজি বিশেষভাবে খাওয়ার প্রথা প্রচলিত আছে চীনের উত্তরাঞ্চলে।

কু ইয়ু উৎসব

চীনে উৎসবের কমতি নেই। কু ইয়ু উৎসব তেমনি একটি উৎসব। চীনের উত্তরাঞ্চলের উপকূলীয় অঞ্চলের জেলে পল্লিগুলোতে মূলত এই উৎসব পালিত হয়। জেলেরা এই সৌরপদে বছরের প্রথম সমুদ্রযাত্রা শুরু করে, মাছ ধরার উদ্দেশ্যে। আর উৎসবের আয়োজন এ কারণেই। এ সময় তাঁরা সমুদ্রদেবতার পূজা করে এবং বিশ্বাস করে, দেবতা তুষ্ট হলে, তাদের জালে প্রচুর মাছ ধরা পড়বে ও তাঁরা নিরাপদে স্থলে ফিরে আসতে পারবে। বিগত দুই হাজার বছর ধরে এই বিশ্বাস ধরে রেখেছে ওরা।

লেখক: বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি), বেইজিং।alimulh@yahoo.com

এইচআর/ফারুক/এএসএম