গত ৬ এপ্রিল চিনির দাম কেজিতে তিন টাকা কমানোর ঘোষণা দেয় সরকার। সেই ঘোষণা অনুযায়ী প্রতি কেজি খোলা চিনি ১০৪ টাকা ও প্যাকেটজাত চিনি ১০৯ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু কোনো বাজারেই কমেনি চিনির দাম। ক্রেতাদের ঠিকই গুনতে হচ্ছে আগের মতো ১১৫ থেকে ১২০ টাকা। চিনির দাম কমালেও বাজারে না কমার এ ধারা নতুন নয়। স্বয়ং বাণিজ্যমন্ত্রীও দাম না কমে বাড়ার বিষয়টি স্বীকার করে দায়সারা বক্তব্য দিয়েছেন।
Advertisement
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি রোববার (১৬ এপ্রিল) বলেন, আমরা সম্প্রতি লক্ষ্য করেছি চিনির দাম একটু ঊর্ধ্বমুখী। আমরা বলেছিলাম চিনির দাম পাঁচ টাকা কমানো হোক। পরবর্তীকালে হিসাব-নিকাশ করে দেখা যায় তিন টাকা ৫০ পয়সা কমানো যায়। যখনই এটা আলোচনা চলছিল তখনই চিনির দাম আবার বাড়ানো হয়। রমজানের শেষ দিকে ঈদ ঘিরে চিনির চাহিদা বেড়েছে। যে কারণে দামও বেড়েছে। দাম যে বেড়েছে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
আরও পড়ুন>> চাহিদা বাড়ায় চিনির দাম বেড়ে গেছে: বাণিজ্যমন্ত্রী
চিনি নিয়ে দীর্ঘদিনের ছিনিমিনি খেলা চলছেই। ঈদের বাড়তি চাহিদাও কোম্পানিগুলোর বাড়তি মুনাফার একটি কৌশল। জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন পক্ষ একে অপরকে দায়ী করছেন। মিলমালিকদের দাবি, তারা সরকার নির্ধারিত দামে মিলগেটে চিনি বিক্রি করছেন, সেটা বাজারে নিয়ে বাড়তি দামে বিক্রি করছেন পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা।
Advertisement
বিক্রেতারা বলছেন, মিল থেকে ইনভয়েসে সরকার নির্ধারিত দাম নেওয়া হলেও আন্ডার ইনভয়েস বাড়তি দাম নেওয়া হচ্ছে। বেশি দামে কেনা বলেই তারা বাধ্য হয়ে বাজারে বেশি দামে বিক্রি করছেন।
আরও পড়ুন>> ভোজ্যতেল ৩ লাখ, চিনি সোয়া ২ লাখ টন মজুত
সব মিলে দেশের চিনির বাজার এখনো অস্থিতিশীল। শুধু দাম কমানো নয়, ২৬ ফেব্রুয়ারি চিনি আমদানিতে যে শুল্ক প্রত্যাহার হয়, তারও কোনো সুফল মিলছে না। ওই সময় আমদানি করা অপরিশোধিত চিনির ওপর থেকে কেজিপ্রতি সাত টাকা এবং পরিশোধিত চিনি থেকে ১০ টাকা শুল্ক প্রত্যাহার হয়।
বাজারের পণ্যমূল্যের হিসাব সংরক্ষণ করা সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, গত এক বছরের ব্যবধানে চিনির দাম বেড়েছে ৪৯ শতাংশ। গত বছর (২০২২) এই সময়ে দেশে প্রতি কেজি চিনি ৭৮-৮০ টাকার মধ্যে পাওয়া যেত।
Advertisement
সামনে ঈদুল ফিতর। রমজানের মতো এসময়ও চিনির চাহিদা বেড়ে যায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, রোজার মাস ও ঈদে চিনির চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় তিন লাখ টন। আর এই সুযোগটা লুফে নেন দেশের ব্যবসায়ীরা। ফলে এখন রমজানকে কেন্দ্র করে অধিক মুনাফাপ্রত্যাশী ব্যবসায়ীরা চিনির বাজারে বাড়তি সুবিধা নিচ্ছেন।
আরও পড়ুন>> চিনির দাম নতুন করে নির্ধারণ করলো সরকার
এদিকে শুরুতে দাম নিয়ন্ত্রণে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু তৎপরতা দেখা গেলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা শিথিল হয়ে যায়। ফলে চলতি রমজানে স্বাভাবিক দরে চিনি খেতে পারেনি সাধারণ মানুষ, ঈদেও গুনতে হবে বাড়তি দাম।
চিনির দামের বিষয়ে খোঁজ নিতে রাজধানীর রামপুরা, মালিবাগ ও খিলগাঁও তালতলা বাজারে গেলে দেখা যায়, সেখানে প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হয়েছে ১১৫-১২০ টাকায়। আর প্যাকেটজাত চিনি ব্র্যান্ডভেদে ১২০-১৪০ টাকা এবং দেশি মিলগুলোর আখের চিনি ১৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতে দেখা গেছে।
এর মধ্যে আবার খুচরা বাজারে প্রায়ই দেখা যায় চিনির সংকট। ফলে দাম বাড়িয়ে বিক্রেতারা যে যার মতো বিক্রি করেন। বেশি দামে চিনি বিক্রি করতে যেন খুচরা বিক্রেতাদের সমস্যা না হয়, সেজন্য কিছু কোম্পানি তাদের প্যাকেটের গায়ে লেখা সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য মুছে দেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
দেশে মূলত সিটি গ্রুপ তীর ব্র্যান্ডে, মেঘনা গ্রুপ ফ্রেশ ব্র্যান্ডে, আব্দুল মোনেম গ্রুপ ইগলু ব্র্যান্ডে বাজারজাত করে চিনি। এছাড়া টিকে গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, দেশবন্ধু গ্রুপ চিনির বড় ব্যবসায়ী।
আরও পড়ুন>> ফের বেড়েছে চিনি-ব্রয়লার মুরগির দাম
চিনির দামের বিষয়ে দেশবন্ধু গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা জাগো নিউজকে বলেন, চিনির শুল্ক প্রত্যাহার হলেও বিশ্ববাজারে দাম স্থিতিশীল নয়। তারপরও মিল থেকে চিনি সরকার নির্ধারিত দামে সরবরাহ করা হচ্ছে।
গোলাম মোস্তফা বলেন, মার্কেটিংয়ের সমস্যায় সেই সুফল ভোক্তারা পান না। ট্রেডারদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তারা মিল থেকে নিয়ে মার্কেটে বেশি দামে বিক্রি করছে।
এদিকে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে তারা চিনি কিনতে পারছেন না। এ বিষয়ে পাইকারি চিনি ব্যবসায়ী ও মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা জাগো নিউজকে বলেন, ভ্যাট কমানোর পর মিল থেকে চিনির দাম কমেনি, উল্টো বেড়েছে। এখন সরকার নির্ধারিত দামে ডিও দিলেও আন্ডার ইনভয়েসে বাড়তি দাম নিচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা এ অভিযোগ সরকারের বিভিন্ন মহলে করেছি। কিন্তু কোনো প্রতিকার হয়নি। দাম বাড়ার জন্য কয়েকটি চিনিমিলের সিন্ডিকেট দায়ী।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, দেশে বছরে চিনির চাহিদা ১৮-২০ লাখ টন। রোজায় এ চাহিদা আরও বেড়ে যায়। অথচ দেশে সব মিলিয়ে উৎপাদিত হয় মাত্র ৩০-৩৫ হাজার টন। শুধু রোজার মাসে চিনির চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় আড়াই থেকে তিন লাখ টন। দেশে উৎপাদন না থাকায় চাহিদার বড় অংশই জোগান দেওয়া হয় আমদানির মাধ্যমে।
এনএইচ/এএসএ/এমএস