ফিচার

ঈদ কার্ড এখন সোনালি অতীতের সুখস্মৃতি

ইরতিজা জান্নাত মিম

Advertisement

ঈদ কার্ড বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছেই অচেনা একটি বিষয়। তবে ৯০ দশকে যারা বেড়ে উঠেছেন, শৈশব পার করেছেন। তাদের কাছে ঈদ কার্ড আবেগ, অনুভূতি প্রকাশ ও ভালোবাসা বিনিময়ের সুন্দরতম স্মৃতি। প্রথম রোজা থেকেই অপেক্ষা শুরু হয় ঈদের। সময় যত গড়ায়, অপেক্ষা পরিণত হয় উত্তেজনায়। সেই উত্তেজনার পারদে তাপ দেয় ঈদ কার্ড। সে সময় ঈদ এলেই ঈদ কার্ড সংগ্রহের জন্য হিড়িক পড়ে যেত পাড়ার মোড়ে মোড়ে, অলি-গলিতে ঈদ কার্ডের ছোট-বড়, অস্থায়ী দোকানগুলোয়।

নানা বয়সী অনেকেই রঙিন কাপড় দিয়ে তাঁবু টাঙিয়ে ঈদ কার্ডের দোকান দিতেন। বিকেল হলেই সবার ভিড় জমতো সেই দোকানগুলোয়। সবাই তাদের প্রিয়জনদের জন্য পছন্দের ঈদ কার্ড কিনতেন। বড়রা ছোটদের জন্য, বন্ধু বন্ধুর জন্য, অনেকে আবার পরিবারের সদস্যদের জন্য কিনতেন এসব কার্ড। ছোটরা বাবা-মায়ের কাছে অনেক বায়না করে টাকা নিতো ঈদ কার্ড কেনার জন্য। পাঁচ টাকা থেকে শুরু করে ১০০, ১৫০ টাকার মধ্যে কেনা যেত সেই কার্ডগুলো। মধ্যবয়সী কিশোর-কিশোরীরা ঈদ কার্ড কেনার জন্য রমজানের অনেক আগ থেকে টাকা জমাতো। কেউ টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে কেউবা যাতায়াত ভাড়া বাঁচিয়ে টাকা জমাতো। ঈদ কার্ড যেন এক ব্যক্তিগত চিঠিপত্রের মতোই, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

আরও পড়ুন: দেশ এখন স্মার্ট হেলথ বাস্তবায়নের পথে

Advertisement

সময়ের পরিক্রমায় ঈদ কার্ড রূপান্তরিত হয়ে গ্রেটিংস নাম পেয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে তা নিমিষেই পৌঁছে যাচ্ছে অনেক মানুষের কাছে। অনুভূতি আদান-প্রদানের এই মাধ্যম এখন অনেকটাই যন্ত্রনির্ভর। তবে পুরোনো সেই কাগুজে মাধ্যমের স্মৃতির পাতা উল্টে তখনকার আবেগ, অনুভূতির কথা জানালেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কল্যাণ উপদেষ্টা রেহানা আক্তার। ষাট ছুঁই ছুঁই এ নারী নিজের ফেলে আসা শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের ঈদগুলোয় ঈদ কার্ডের প্রতি দুর্বলতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘এখন তো সবাই মোবাইলেই ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করে। মেসেজ বা গ্রেটিংস কার্ড পাঠিয়ে। কিন্তু এর মধ্যে প্রাণের যে একটা টান, মনের যে একটা টান বা ভালো লাগার যে একটা জায়গা। সেটা আমরা তেমনভাবে পাই না। বিশেষ করে আমি পাই না। কিন্তু যখন এসব ছিল না। আমাদের ছোটবেলায়, স্কুল-কলেজে পড়ায় সময় দেখেছি বিভিন্ন ভিউ কার্ড বাজারে। এত সুন্দর সুন্দর ঈদ কার্ড আসতো নায়ক-নায়িকা, পশুপাখি বিশেষ করে দৃশ্যাবলি, বিভিন্ন জায়গার ছবি, হাতে আঁকা সেগুলো থাকতো।’

কথায় কথায় উঠে এলো, সে সময় বাজারের সব জনপ্রিয় ঈদ কার্ড প্রস্তুতকারকদের নাম। রঙিন কাগজে হাতে এঁকে বানানো কার্ডের গল্প। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আজাদ প্রোডাক্টসের যাত্রাটা শুরু হয়েছিল ঈদ কার্ডের মাধ্যমে। আজাদ প্রোডাক্টের ঈদ কার্ডগুলো খুব এক্সপেন্সিভ ছিল। বন্ধুরা বেশি থাকার ফলে অনেক সময় রঙিন কাগজ কিনে নিজেরাই কার্ড তৈরি করতাম। তৈরি করে মনের ভাব মিশিয়ে সেই ঈদের শুভেচ্ছা জানাতাম সহপাঠীদের বা পরিবারের সবাইকে। এই অনুভূতি আসলে বলে শেষ করা যাবে না। এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতি। স্কুল বন্ধ হওয়ার দিন লুকিয়ে বন্ধুদের খাতার ভেতরে চুপটি করে ঢুকিয়ে দিতাম। যাতে বাড়ি গিয়ে দেখে। তারপর ঈদের দিন এলে সকালে নতুন জামা পরে নির্দিষ্ট কারো বাসায় একত্রিত হয়ে সবাই সবার বাসায় ঘুরতে যেতাম।’

আরও পড়ুন: শিশুর নিরাপত্তা ও অধিকার: প্রয়োজন আলাদা মন্ত্রণালয়!

প্রেমিক-প্রেমিকারা যে লুকিয়ে ঈদ কার্ড বিনিময় করতেন, হাসতে হাসতে সেটিও বললেন। তবে দেশত্যাগী বন্ধুকে ঈদ কার্ড পাঠানোর গল্পে এসে তিনি বেশ স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লেন, ‘আমার মনে পড়ে এক বান্ধবীর কথা। শিখা নাম তার। ও মাধ্যমিক পাস করে করাচিতে চলে যায়। তাই ঈদের আগে ওকে ডাকযোগে বাংলাদেশ থেকে কার্ড পাঠাতাম। সে-ও আমাদের জন্য কার্ড পাঠাতো করাচি থেকে।’

Advertisement

শুধু যে মুসলিমদের সঙ্গে ঈদ কার্ড আদান-প্রদান হতো, তা কিন্তু নয়। বন্ধু বা প্রতিবেশী হিসেবে কার্ড বিনিময় প্রথা ছিল অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গেও। সেসব কথা জানালেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক একুশে পদ্কপ্রাপ্ত ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘অন্য ধর্মাবলম্বী হলেও ঈদ কার্ডের সঙ্গে আমারও অনেক আবেগী স্মৃতি আছে। আমি ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি ঈদের সময় কাছের মানুষ, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই ঈদ কার্ড বিনিময় করতেন। আমিও পেয়েছি অনেক।’

প্রত্যেক বছর আলাদা আলাদা ডিজাইনের ঈদ কার্ড বাজারে আসতো। সেগুলোর ধরন, প্রকৃতি ও নান্দনিকতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সুন্দর ছবি, লেটারিং, ক্যালিগ্রাফি, অ্যারাবিক লেখা, বাংলায় লেখা নানা ধরনের ডিজাইনের কার্ড ছিল।’ তবে চারুকলার ছাত্রদের হাতে আঁকা কার্ডগুলো একটু অন্যরকম হতো এ কথা জানাতে ভুল করলেন না।

আরও পড়ুন: রমজানে অসহায়দের পাশে তারা

সময়ের পালা বদলে ভাব বিনিময়ের মাধ্যম বদলায়। কিন্তু অনুভূতিগুলো থেকে যায় একই। তাই তো নিজেদের ফেলে আসা সোনালি অতীত এখন সুখস্মৃতি হয়ে বেঁচে আছে কয়েক প্রজন্মের বুকে। এখনো যদি এই যান্ত্রিক মাধ্যমের পাশাপাশি এগুলো চালু রাখা যায়। তাহলে নতুন প্রজন্মও আগের মতো সেই আত্মিক অনুভূতির স্বাদ পাবে বলে বিশ্বাস করেন অনেকেই।

এসইউ/জেআইএম