লালমনিরহাট জেলা প্রতি বছর ভুট্টা চাষের অঞ্চল হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে। তিস্তা-ধরলা নদীর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলসহ ৫ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রতি বছরই বাড়ছে এর চাষ। বীজ লাগানোর পর থেকে শুরু করে গাছ বেড়ে ওঠা পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। কিন্তু যখন গাছে মোচা ধরেছে; ঠিক তখনই দেখা দিয়েছে বিপত্তি। প্রতিটি গাছেই মোচা আছে কিন্তু নেই ভুট্টার দানা। চড়া দামের সার, বীজ ও তেল কিনে চাষাবাদ করে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা।
Advertisement
সরেজমিনে জানা যায়, হাতীবান্ধা উপজেলার ডাউয়াবাড়ী, পাটিকাপাড়া ইউনিয়নের তিস্তার চর এলাকার কৃষক জোবেদুল ঋণের টাকায় ৪ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে লাগান হাইব্রিড হিরো জাতের ভুট্টা বীজ। তিন মাস পরেই তা চোখের পানিতে পরিণত হয়েছে। গাছে মোচা আছে কিন্তু শস্যদানা নেই। এ ফলন দেখে নীরবে কাঁদছেন তিনি।
শুধু কৃষক জোবেদুল নন, তার মতো তিস্তা চরাঞ্চলের প্রায় ৫-১০ জন ভুট্টা চাষির একই অবস্থা। ভুট্টার বীজ ডিলার ও কোম্পানির প্রতিনিধির বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টদের কাছে বিচার দাবি করেছেন তারা। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা বলেন, ‘বাজারে যেভাবে ভুট্টার বীজ কোম্পানি বাড়ে। তাতে আসল-নকল চেনা বড় দায়। প্রতি বছর এভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে এর দায় কে নেবে?’
আরও পড়ুন: ঠাকুরগাঁওয়ে ভুট্টা চাষে স্বপ্ন দেখছেন কৃষকরা
Advertisement
জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, দেশের বৃহৎ ভুট্টার চাহিদা এ জেলা থেকে সরবরাহ করা হয়। বিশেষ করে লালমনিরহাটের তিস্তাপারের বিস্তীর্ণ এলাকায় এ ফসলের চাষাবাদ বেশি হয়। জেলার ব্র্যান্ডিং ফসল ভুট্টা। গত বছর ভুট্টা চাষ হয়েছিল ১ লাখ ৬ হাজার ২৫৭ মেট্রিক টন। এ বছর লালমনিরহাটে ভুট্টা চাষ হয়েছে ৩৩ হাজার হেক্টর জমিতে। জেলায় প্রায় ৭০ শতাংশ ভুট্টা উৎপন্ন হচ্ছে তিস্তার চরাঞ্চলে।
ক্ষতিগ্রস্ত তিস্তার চর এলাকার কৃষক জোবেদুল বলেন, ‘ঋণ নিয়ে ৪ বিঘা জমিতে ভুট্টা লাগিয়েছি। এর মধ্যে হাইব্রিড হিরো ভুট্টার গাছের মোচায় দানা নেই। এই ভুট্টা বীজ লাগিয়ে আমরা শেষ। এখন কীভাবে ঋণ শোধ করব?’
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক তহুবার হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘কালীগঞ্জ উপজেলার চামটারহাটের ডিলার রানা মিয়ার কাছ থেকে ইয়েস এগ্রো সাইন্সের হিরো হাইব্রিড ৪৫২৩ (মাহিকো ইন্টারন্যাশনাল) কিনেছিলাম। এখন জমিতে গিয়ে দেখি ভুট্টার গাছ আছে কিন্তু মোচায় দানা নাই।’
আরও পড়ুন: শার্শায় ভুট্টা চাষে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের
Advertisement
তিনি বলেন, ‘এ বীজ বিক্রেতা ও তার প্রতিনিধি রাশেদুল প্রতি বছর ভুট্টা সংগ্রহ করে নিজেই নকল বীজ প্যাকেজিং করে বাজারে বিক্রি করেন। এই ক্ষতি পূরণের দাবি জানাচ্ছি।’
ভুট্টা বীজ ডিলার রানা ইসলাম ভেজাল বীজ সরবরাহের কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি চামটারহাট এলাকার অনেক পুরাতন ব্যবসায়ী। চরের কৃষকরা প্রতি বছর আমার কাছ থেকে সার ও বীজ কিনে থাকেন। ইয়েস এগ্রো সায়েন্স কোম্পানির প্রতিনিধি রাশেদুলের কথায় কিছু বীজ বিক্রি করেছিলাম। এখন দেখি কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন। কোম্পানির প্রতিনিধিকে একাধিক বার বলেছি সমাধান করে দিতে। তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি।’
ইয়েস এগ্রো সায়েন্সের স্থানীয় প্রতিনিধি রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে সমাধানের চেষ্টা করছি। আমাদের বীজ কোম্পানিকে ফাঁসাতে একটি মহল এমন অপপ্রচার চালাচ্ছেন। তবে ভুট্টায় দানা নেই কথাটি সত্য নয়। আছে, পরিমাণে কম। যা অন্য সমস্যার কারণেও হতে পারে।’
আরও পড়ুন: কুড়িগ্রামে বেড়েছে ভুট্টা চাষ
ইয়েস এগ্রো সায়েন্সের এক্সিকিউটিভ অফিসার আল আমিন বলেন, ‘এ বিষয়ে এখনো কিছু জানা নেই। তবে অনাবৃষ্টির কারণে এ বছর একটু সমস্যা হয়েছে। আমাদের বীজ সরাসরি ভারত থেকে আসে। ভেজাল বীজ বাজারজাত করার প্রশ্নই ওঠে না।’
হাতীবান্ধা উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো. সুমন মিয়া বলেন, ‘বিষয়টি জেনে ভুট্টা ক্ষেত পরিদর্শন করেছি। কী কারণে ভুট্টার দানা আসেনি, তা পরীক্ষা করতে নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণাগারে পাঠানো হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘দুই থেকে তিনজন কৃষকের জমিতে ভুট্টার দানা আসেনি। ভুট্টা বীজ ভেজাল প্রমাণিত হলে আগামীতে যেন ভেজাল ও নিম্নমানের বীজ বাজারে বিক্রি করতে না পারে, তার জন্য কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হবে।’
রবিউল হাসান/এসইউ/জিকেএস