মতামত

কঠোর সাধনার শেষ দশক

পবিত্র মাহে রমজানকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে, তথা রহমত, মাগফেরাত ও নাজাত। দেখতে দেখতে আমাদের মাঝ থেকে রহমত ও মাগফিরাতের দিনগুলি অতিবাহিত হয়েছে। শুধু তাই না নাজাতের দশকের ৫ম দিনের রোজা আজ আমরা অতিবাহিত করছি।

Advertisement

রমজানকে বিদায় দিতে গিয়ে আমাদের প্রিয়নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এমনটি হয়ে থাকতো যে, আধ্যাত্মিক বসন্ত নিজের চমক দেখিয়ে যখন বিদায় নেয়ার ক্ষণে পৌঁছে যেত তখন তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোমর বেঁধে নিতেন আর রমজানের কল্যাণরাজিতে নিজ ডালি ভরে নিতে কোন ত্রুটি করতেন না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেষ দশকের ইবাদত সম্পর্কে হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণিত একটি হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি রমজানের শেষ দশকে প্রবেশ করলে তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিভাবে রাতগুলো ইবাদতের মাধ্যমে জীবিত করতেন এবং তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার পরিবার পরিজনকেও জাগাতেন (বুখারি)।

শেষ দশকে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইতিকাফে বসতেন এবং লাইলাতুল কদরের অন্বেষণে রাতগুলো ইবাদতের মাধ্যমে জাগিয়ে রাখতেন। ইতিকাফের আভিধানিক অর্থ হলো কোনো স্থানে আবদ্ধ হয়ে যাওয়া বা অবস্থান করা। ইসলামি পরিভাষায় ‘ইবাদতের সংকল্প নিয়ে রোজা রেখে মসজিদে অবস্থান করার নাম ইতিকাফ’ (হিদায়া, বাবুল ইতিকাফ)।

রমজান মাসের শেষ দশকে ইতিকাফে বসা সুন্নতসম্মত। হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত এক হাদিস থেকে জানা যায়, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র স্ত্রীগণও এ সুন্নতের অনুসরণ করতেন (সহি মুসলিম, কিতাবুল ইতিকাফ)।

Advertisement

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান মাসে ১০ দিনই ইতিকাফে বসতেন। উল্লেখ্য, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনের শেষ রমজানে ২০ দিন ইতিকাফ করেছিলেন। ২০শে রমজান ফজরের নামাজের পর ইতিকাফ আরম্ভ করা উচিত। এজন্যে ১৯শে রমজান বাদ মাগরিব ইতিকাফস্থলে এসে যাওয়াই অনেকে ভাল মনে করে থাকেন।

ইতিকাফে বসে মুতাকিফরা একাগ্রচিত্তে ব্যক্তিগত দোয়া ছাড়াও সবার জন্য সময়োপযোগী দোয়া করেন। ইতিকাফের জন্য উপযুক্ত স্থান হলো জামে মসজিদ। এ প্রসঙ্গে কুরআনে উল্লেখ রয়েছে- ‘তোমরা মসজিদে ইতিকাফ কর।’ (সুরা বাকারা: আয়াত: ১৮৭)

হাদিসেও নির্দেশ এসেছে হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘জামে মসজিদ ছাড়া ইতিকাফ নেই।’ (আবুদাউদ, কিতাবুল ইতিকাফ, পৃঃ ৩৩৫)।

ইমামগণ এ বিষয়ে ঐকমত্য সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তবে বিভিন্ন অসুবিধার কারণে ইতিকাফ যে কোনো মসজিদে বা একান্ত অপারগতার কারণে মসজিদের বাইরেও ইতিকাফ হতে পারে। মহিলারা ঘরে নামাজের জন্য একটি বিশেষ স্থান নির্ধারণ করে সেখানে ইতিকাফে বসা তাদের জন্য উত্তম (হিদায়া, বাবুল ই’তিকাফ, পৃষ্ঠা ১৯০)।

Advertisement

ইতিকাফকারী দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে আল্লাহর দিকে ঝুঁকে পড়ে যেন তিনি তার অভীষ্ট মনোবাসনা পূর্ণ করে তবে ইতিকাফ থেকে উঠতে পারেন। এটা কঠিন সাধনার বিষয়। তাই মুতাকিফকে এমন কোনো কাজকর্ম বা আচার আচরণ করা উচিত নয় যাতে তার এ সাধনা ব্যাহত হয় বা প্রশ্নবিদ্ধ হয় অথবা ক্রুটিপূর্ণ হয়ে যায় বা তার মনোবাসনা অপূর্ণ থেকে যায়। একজন তাপস সাধনের ন্যায় একাগ্রতা, ঐকান্তিকতা শৃঙ্খলা ও পবিত্রতার লাগাম যেন হাত ছাড়া হতে না দেন।

রমজানের এই শেষ দশকের একটি রাতে এসে থাকে লাইলাতুল কদর। লাইলাতুল কদর বা সৌভাগ্য রজনী লাভ বোধ করি মুমিনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। সারাজীবন কঠোর সাধনা, ত্যাগ ও তিতিক্ষার মাধ্যমে শয়তানী প্রবৃত্তিরূপে দৈত্যকে নিধন করার পর মুমিনের কাছে আসে সেই মুহূর্তটি-সেই পাওয়ার মুহূর্তটি যা আল কুরআনের সুরা কদরে ‘লাইলাতুল কদর’ নামে আখ্যায়িত হয়েছে। হাজার মাসের চেয়েও উত্তম এ মুহূর্তটি। হাজার মাস অর্থাৎ প্রায় ৮০ বছর। একজন মুমিন সাধারণত ৮০ বছর বেঁচে থাকেন। সুতরাং তার সারাজীবনের সাধনার ফল লাভের মুহূর্তটি তার গোটা জীবনের চেয়েও কদরের তথা কল্যাণের ও মর্যাদার।

লাইলাতুল কদর বলতে আমরা সাধারণত একটি রাতকে মনে করে থাকি। ভৌগোলিক কারণে সারা দুনিয়ায় যেহেতু একই সময়ে রাত থাকে না সেজন্যে লাইলাতুল কদরকে আমাদের গণনার একটি রাত নির্ধারণ করা সঠিক বলে মনে হয় না। লাইলাতুল কদর এমন একটি সময় মুমিনের ব্যক্তিগত জীবন বা জাতীয় তথা মিল্লাতী জীবনে রাতের ন্যায় কাজ করে থাকে। মুমিন সাধনার শেষ লগ্নে তার প্রভুর দিদার বা দর্শন ও সান্নিধ্য লাভ করে বাক্যালাপে ভূষিত হয়। এ মুহূর্তটিই আসলে তার জীবনে লাইলাতুল কদর। তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, এ মুহূর্তটি অবশ্যই মুমিনের জীবনে আসে রমজানের কঠোর সাধানার শেষ দশকে।

রোজার সাধনার মাধ্যমে মুমিন পানাহার ত্যাগ করে, নিদ্রাকে কম করে দিয়ে এবং নিজের প্রজননকে সাময়িকভাবে হলেও স্বীকার করে আল্লাহর রঙে রঙিন হয়। তাই সে আল্লাহর সাথে নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী বাক্যালাপ করার সৌভাগ্য লাভ করে।

হাদিস পাঠে জানা যায় হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত- মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কদরের রাত্রি সম্বন্ধে বলেছেন ‘রমজান মাসের শেষের দশ রাত্রিসমূহে লাইলাতুল কদরের অনুসন্ধান কর।’ (বুখারি) তাই আমাদেরকে এই শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদরের অন্বেষণ করতে হবে।

আল্লাহতায়ালার কাছে এ দোয়াই করি তিনি যেন এই পবিত্র রমজানে আমাদের সবাইকে নাজাত দান করেন এবং তার রহমতের ছায়ায় আবৃত করে রাখেন, আমিন।

লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম