ফিচার

দক্ষিণারঞ্জন মিত্রের জন্ম

দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার ছিলেন বাংলার খ্যাতিমান শিশু সাহিত্যিক ও লোককথার সংগ্রাহক। যার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা রূপকথাগুলোকে যথাসম্ভব অবিকৃত রেখে সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করা। সেগুলো মুখের কথার ধাঁচাতে হয়ে উঠেছে কথাসাহিত্যে তথা বাংলার সংস্কৃতিতে এক মূল্যবান সম্পদ।

Advertisement

১৮৭৭ সালের ১৫ এপ্রিল বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা জেলার সাভারের কাছে উলাইল গ্রামে অভিজাত মিত্র মজুমদার পরিবারে রূপকথার এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী লেখক জন্মগ্রহণ করেন। পিতা রমদারঞ্জন মিত্র মজুমদার। প্রথমে মা কুসুমময়ী দেবীর কাছে এবং তার মৃত্যুর পর পিসিমা রাজলক্ষ্মী দেবীর কাছে রূপকথার আনন্দের জগতের সন্ধান লাভ করেন।

১৮৯৩ সালে ঢাকা জগন্নাথ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। পড়ালেখায় ভালো করতে না পারায়, তার পিতা টাঙ্গাইলে বোন (দক্ষিণারঞ্জনের পিসী) রাজলক্ষ্মী চৌধুরানীর কাছে রেখে টাঙ্গাইলের সন্তোষ জাহ্নবী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। এই বিদ্যালয়ের বোর্ডিংয়ে থেকে তিনি দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এখানেই তার সাহিত্য জীবনের সূত্রপাত। পঁচিশ বছর বয়সে তার প্রথম বই উত্থান কাব্য প্রকাশিত হয়। এর আগেই পিতার সঙ্গে কিছুদিন মুর্শিদাবাদে কাটানোর সময় সুধা মাসিক পত্রিকার সম্পাদনা করেন।

মুর্শিদাবাদে অবস্থানকালে ‘সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা’, ‘প্রদীপ’ প্রভৃতি পত্রিকাতে প্রবন্ধাবলি প্রকাশ করেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি ময়মনসিংহে পিসিমার কাছে চলে যান এবং গ্রাম্যপ্রকৃতি ও জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে রূপকথার প্রায় হারিয়ে যাওয়া সম্পদটিকে তিনি পুনরুদ্ধার করেন। গীতিকথা, ব্রতকথা, রূপকথা ও রসকথার চতুবর্গে তিনি কাহিনিগুলোকে বিন্যস্ত করেন।

Advertisement

১৯০৬ সালে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। স্বদেশি যুগে পিসিমার অর্থসাহায্যে কলকাতায় তিনি একটি প্রেস খুলেছিলেন। এছাড়াও তিনি প্রদীপ, প্রকৃতি, ভারতী, সারথি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় লেখালেখি করেছেন। ১৯০৭ সালের দীনেশচন্দ্র সেনের আগ্রহে ‘ভট্টাচার্য এন্ড সন্স’ থেকে ঠাকুরমার ঝুলি প্রকাশিত হয়। দীনেশচন্দ্রের কাছেই রবীন্দ্রনাথ দক্ষিণারঞ্জনের কথা শোনেন এবং ঠাকুরমার ঝুলি গ্রন্থের ভূমিকা রচনা করেন।

১৯০৮ সালে তার স্বদেশি গানের সংকলন যা বা আহুতি প্রকাশিত হয়। ১৯১০ সালে ভারতীয় নারীচরিত্রের মহিযাজ্ঞাপক গ্রন্থ আর্থনারী (২ খণ্ড) এবং প্রাচীন ভারতের ধর্মচিন্তা বিষয়ক শিশুপাঠ্য গ্রন্থ সচিত্র সরল চন্ডীপ্রকাশিত হয়। ঢাকা থেকে প্রকাশিত তোষণী পত্রিকায় তার লেখা চারু ও হারু নামক কিশোর উপন্যাসটি ধারাবাহিক আকারে প্রকাশিত হয়। শিশু-কিশোরদের সার্বিক বিকাশের লক্ষ্যে তিনি অজস্র কবিতা, গল্প, জীবনী রচনা করেন।

তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্য-ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদাদার ঝুলি, ঠানদিদির থলে, দাদামশায়ের থলে, খোকাবাবুর খেলা, আমাল বই চারু ও হারু, ফার্স্ট বয়, লাস্ট বয়, বাংলার ব্রতকথা, সবুজ লেখা, আমার দেশ, সরল চন্ডী, পুবার কথা, উৎপল ও রবি, কিশোরদের মন, কর্মের মূর্তি, বাংলার সোনার ছেলে ইত্যাদি।

তার বিভিন্ন গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র ও নাটক। যেমন তার ‘সাত ভাই চম্পা’ গল্প অনুসারে ১৯৭৮ সালে চিত্রসাথী পরিচালিত ভারতীয় বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র ‘সাত ভাই চম্পা’মুক্তি পায়। ‘কিরণমালা’ গল্প অনুসারে ১৯৭৯ সালে বরুন কাবাসি পরিচালিত ভারতীয় ফ্যান্টাসি ফিল্ম ‘অরুণ বরুণ ও কিরণমালা’ মুক্তি পায়। তার গল্পগ্রন্থ ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ অনুসারে একটি ভারতীয় নৃতত্ত্ব টেলিভিশন সিরিজ ‘ঠাকুমার ঝুলি’ নির্মিত হয়। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র ১৯৫৭ সালের ৩০ মার্চ কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

Advertisement

কেএসকে/জিকেএস