অ্যাকাউন্টিং বা হিসাববিজ্ঞানের ইতিহাস প্রাচীন সভ্যতা থেকে চিহ্নিত করা হয়। হিসাবরক্ষণের প্রাথমিক বিকাশ প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, প্রাচীন মিশরীয় এবং ব্যাবিলনীয়দের মধ্যে ছিল। এটি আর্থিক লেনদেন,অর্থ গণনা এবং প্রাথমিক অডিটিং সিস্টেমের বিকাশের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। রোমান সাম্রাজ্যের সময়,সরকারের বিস্তারিত আর্থিক তথ্যের অ্যাক্সেস ছিল। ইটালিয়ান লুকা প্যাসিওলি,যিনি অ্যাকাউন্টিং-এর জনক হিসেবে স্বীকৃত,তিনিই প্রথম ডাবল-এন্ট্রি বুককিপিং প্রকাশ করেছিলেন এবং ইতালিতে এই বিষয়টি চালু করেছিলেন। বাংলাদেশে হিসাববিজ্ঞান পেশা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে গড়ে উঠে।
Advertisement
কখন শুরু হয় এবং কারা পড়তে পারেঃবিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাববিজ্ঞান বিভাগ চালু হয়। যদিও অনেক কলেজে এর আগে হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশুনা শুরু হয়। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সকল পাবলিক এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাববিজ্ঞান কোর্সটি চালু রয়েছে।
যদিও এটা ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের অন্তর্ভুক্ত বিষয়,কিন্তু সব শাখা-অর্থাৎ বিজ্ঞান,মানবিক এবং ব্যবসায় শিক্ষা থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে এই বিষয়ে ভর্তি হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে মিনিমাম যোগ্যতা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্ন ভিন্নভাবে নির্ধারিত করা হয়। উল্লেখ্য যে প্রথমে হিসাববিজ্ঞান নামে চালু হলেও এখন প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ নামে কোর্সটি চালু আছে।
কী কী পড়ানো হয়ঃএকজন শিক্ষার্থী এই বিভাগের ছাত্রছাত্রী হলে, উক্ত শিক্ষার্থী হিসাববিজ্ঞানের বেসিক নীতি,উৎপত্তি, ব্যয় হিসাববিজ্ঞান,ব্যবস্থাপনা হিসাববিজ্ঞান, হিসাববিজ্ঞানের বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড,ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত করণ,অর্থনীতি,একাউন্টিং তত্ত্বের নানাবিষয়,পরিসংখ্যান,নিরীক্ষা ব্যবস্থা ও পদ্ধতি, কর নির্ণয় ও করের নানা দিক,ব্যবস্থাপনা, বীমা পদ্ধতি,অর্থায়ন এবং মার্কেটিং বিষয়ে পড়াশুনা করে থাকে।
Advertisement
হিসাববিজ্ঞানে আর্থিক লেনদেন নিয়ে পড়ানো হয়। হিসাববিজ্ঞান বিভাগে ভালো ফলাফল করতে হলে গণিত বিষয়ে দক্ষ থাকতে হয়। হিসাববিজ্ঞান মানুষের নিত্য দিনের নানা বিষয়ে শিক্ষার্থীকে জ্ঞান দিয়ে থাকে। কিভাবে আমরা দৈনন্দিন জীবনে আর্থিক ব্যবস্থাপনা করবো, সেই বিষয়ে সার্বিক দিক নির্দেশনা দেয়।
হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগের প্রয়োজনীয়তাঃ অ্যাকাউন্টিং ব্যবসা পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ,এটি আয় এবং ব্যয় ট্র্যাক করতে,সংবিধিবদ্ধ সম্মতি নিশ্চিত করতে সহযোগিতা করে। এছাড়া এটি ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বিনিয়োগকারীদের, ব্যবস্থাপনা এবং সরকারকে প্রয়োজনীয় আর্থিক তথ্য সরবরাহ করতে সহায়তা করে।
আজ অ্যাকাউন্টিং হল ব্যবসার ভাষা। যে কেউ ব্যবসায়িক ক্যারিয়ারের জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলে,তাঁকে কিছুটা হলেও এই ভাষাটি শিখতে ও বলতে হবে। অ্যাকাউন্টিং ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
হিসাববিজ্ঞান নীতি এমনভাবে কার্যকর করতে হবে যাতে সব পর্যায়ে শতভাগ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়। দেশে যে দুর্নীতি হচ্ছে তার মূল কারণ হিসাবে গড়মিল। আর হিসাব ঠিকমত রেকর্ড করলে দুর্নীতি অনেক কমে আসে। হিসাবে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারলে অধিকাংশ দুর্নীতি হ্রাস পাবে।
Advertisement
অ্যাকাউন্টিং প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ব্যবহারকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অভ্যন্তরীণ ব্যবহারকারী ঐসব ব্যক্তিদের বুঝানো হচ্ছে,যারা পরিকল্পনা করে,সংগঠিত করে এবং কোম্পানি পরিচালনা করে। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ম্যানেজমেন্ট টিমের অ্যাকাউন্টিং প্রয়োজন। হিসাববিজ্ঞান ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তগুলো ভৌগলিক সম্প্রসারণ থেকে শুরু করে পরিচালন দক্ষতার উন্নতি পর্যন্ত করতে পারে।
যথাযথ অ্যাকাউন্টিং আর্থিক সম্পদ এবং দায়গুলোর সঠিক প্রতিবেদন নিশ্চিত করতে সংস্থাগুলোকে সহায়তা করে। কর কর্তৃপক্ষ একটি কোম্পানির আর্থিক অবস্থান মূল্যায়ন করার জন্য প্রমিত অ্যাকাউন্টিং আর্থিক বিবৃতি ব্যবহার করে। অ্যাকাউন্টিং সিস্টেম কোম্পানির আর্থিক বিবৃতি আইনত এবং সঠিকভাবে রিপোর্ট ও নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। একজন হিসাবরক্ষকের ভূমিকা হল আর্থিক রেকর্ডগুলোকে দায়িত্বের সাথে রিপোর্ট এবং ব্যাখ্যা করা। ছোট ব্যবসায় শুধু একজন হিসাবরক্ষক নিয়োগ করলেই চলে। কিন্তু বড় কোম্পানি একটি সম্পূর্ণ অ্যাকাউন্টিং বিভাগ চালু করতে পারে।
১৯ শতকের মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া ব্যবসা ও অর্থের ক্ষেত্রে হিসাববিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা এবং চাহিদার তীব্রতা দেখতে পাওয়া যায়। শিল্প বিপ্লব বিশ্বব্যাপী কোম্পানির সংখ্যা এবং আকারকে এক অভূতপূর্ব মাত্রায় বৃদ্ধি করে। যা কর্পোরেশনগুলোর জন্য ব্যবসায়িক ক্রিয়াকলাপের সমস্ত দিকগুলোতে অংশ নেওয়ার জন্য শক্তিশালী অ্যাকাউন্টিং বিভাগ বজায় রাখা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
ব্যবসার উন্নতি করতে,অর্থনীতিকে সচল রাখতে এবং আর্থিক জটিলতা হ্রাস করতে সরকার ও ব্যবসায়িকে সাহায্য করার জন্য হিসাবরক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম। ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য অ্যাকাউন্টিং অত্যাবশ্যক।
চাকরির সুযোগঃ অ্যাকাউন্টিংয়ে ক্যারিয়ারের অনেক সুযোগ রয়েছে। "নির্বাহী, প্রশাসনিক, এবং ব্যবস্থাপক" হিসেবে,হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে একজন গ্র্যাজুয়েট হিসাবরক্ষক এবং নিরীক্ষকের চাকরি করার সুযোগ আছে। একজন শিক্ষার্থী এই বিষয়ে পড়াশুনা সমাপ্ত করে হিসাব ব্যবস্থাপক,হিসাববিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ,হিসাব নিরীক্ষক,বাজেট বিশ্লেষক,প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকর্তা,খরচ হিসাবরক্ষক,হিসাবরক্ষণ পরিচালক, আর্থিক প্রতিবেদনের পরিচালক,আর্থিক বিশ্লেষক,অভ্যন্তরীণ অডিটর,ব্যবস্থাপনা হিসাবরক্ষক,ব্যবস্থাপনা বিশ্লেষক,ব্যক্তিগত আর্থিক উপদেষ্টা,প্রকল্প এবং সরকারী হিসাব বিশ্লেষক,কর হিসাবরক্ষক,কর পরীক্ষক ইত্যাদি পজিশনে জব করতে পারে।
উচ্চ শিক্ষায় সম্ভাবনাঃহিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগে পড়াশুনা শেষ করে নিজস্ব যোগ্যতার ভিত্তিতে আমেরিকা, ইউরোপের অনেক দেশ যেমন-যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি,সুইডেন,স্পেন,এশিয়ার দেশ-চীন,জাপান,থাইল্যান্ড,সিঙ্গাপুর এবং কানাডা থেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এসব দেশের টপ র্যাংকিং বিশ্ববিদ্যাল্যগুলোতে স্কলারশিপের ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এই স্কলারশিপ পেতে হলে আপনাকে ভালো রেজাল্টসহ ইংরেজি বিষয়ে মানে আইইএলটিএস এবং টফেল পরীক্ষায় ভালো স্কোর থাকতে হবে।
এই স্কলারশিপ শিক্ষার্থীদেরকে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে। এখানে যেকোন শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষা-মাস্টার্স এবং পিএইচডি ডিগ্রিতে ভর্তি হয়ে ক্যারিয়ার উন্নতি করতে পারে। এজন্য শিক্ষার্থীকে স্নাতকে ভর্তি হয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে হবে। এছাড়া অ্যাকাউন্টিং এ বিভিন্ন প্রফেশনাল ডিগ্রি করার সুযোগ রয়েছে। যেমন-সিএ,সিপিএ এবং সিএমএ ইত্যাদি।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।
এইচআর/জিকেএস