বেসরকারি জীবন বিমা কোম্পানি হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন খোদ কোম্পানিটির কিছু পরিচালক। তাদের অভিযোগ ক্ষতিয়ে দেখতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করে। তবে সেই তদন্ত কমিটিই বলছে- অভিযোগ সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করার জন্য যে বিশেষায়িত জ্ঞান প্রয়োজন তা কমিটির নেই!
Advertisement
গত বছরের ডিসেম্বরে অর্থমন্ত্রী, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এবং আইডিআরএ চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দিয়ে হোমল্যান্ড লাইফে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তোলেন কোম্পানিটির কিছু পরিচালক। একই সঙ্গে এসব অনিয়ম তদন্তের দাবি জানান তারা। এ সংক্রান্ত চিঠিতে সই করেন হোমল্যান্ড লাইফের ভাইস চেয়ারম্যান জামাল মিয়া, পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক, জামাল উদ্দিন, আব্দুল হাই এবং আব্দুল আহাদ।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি তদন্তে চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে আইডিআরএ। তদন্ত কমিটির দলনেতা করা হয় নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমকে। আর সদস্য হিসেবে রাখা হয় কর্মকর্তা মুহাম্মদ শামছুল আলমকে। এরপর গত ১৪ মার্চ এই তদন্ত কমিটি আইডিআরএ চেয়ারম্যান বরাবর তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
আরও পড়ুন>>> বিমা দাবির টাকা দিতে গড়িমসি করছে হোমল্যান্ড লাইফ
Advertisement
এতে তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অভিযোগপত্রে কোম্পানির শুরু থেকে বিভিন্ন খাতের আর্থিক দুর্নীতি সংক্রান্ত ১৫টি অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগগুলো দীর্ঘ মেয়াদের, জটিল এবং বিভিন্ন খাত ও প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিষয় সংশ্লিষ্ট। বিষয়গুলো তদন্ত করে সঠিক তথ্য উদঘাটন করার জন্য দক্ষ চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট ও ফিল্ড ফোর্স প্রয়োজন। ২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দুর্নীতি, অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে কোম্পানির বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব রিকনসিলেশন (পুনরায় মেলানো) করা এবং ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আর্থিক পর্যালোচনা) মাধ্যমে অভিযোগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত করার জন্য হিসাব বিজ্ঞানের যে বিশেষায়িত জ্ঞান প্রয়োজন তা এ কমিটির নেই।
এতে আরও বলা হয়েছে, অভিযোগপত্রের ১২ নম্বর ক্রমিকে কোম্পানিকে স্বতন্ত্র অডিট করানোর অনুরোধ জানানো হয়েছে। কোনো অডিট ফার্ম দিয়ে বিশেষ অডিট করানো হলে অনিয়ম ও দুর্নীতি উদঘাটনের বিষয়টি ফলপ্রসূ হবে। পাশাপাশি অন্য কোনো অনিয়ম সংগঠিত হয়ে থাকলে তাও উদঘাটনের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
তদন্ত কমিটির এ ধরনের মতামতের বিষয়ে জানতে চাইলে একাধিক বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জাগো নিউজকে বলেন, আইডিআরএ গঠন করা হয় বিমা খাতের উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠনের এক যুগ পার হলেও এখানে দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে চলছে। ফলে বিমা খাতের উন্নয়নও হচ্ছে না। বরাবরের মতো বিমা খাত অবহেলিতই থেকে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন>> শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর আশ্বাস বিমা কোম্পানির
Advertisement
তারা আরও বলেন, একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদন্ত কমিটি যদি এ ধরনের তদন্ত প্রতিবেদন দেয়, তা নিয়ে হাসাহাসি হতে পারে। বিমা খাতের উন্নয়ন করতে হলে অবশ্যই আইডিআরএতে দক্ষ ও বিমা বিষয়ে অভিজ্ঞ জনবল নিয়োগ দিতে হবে। তাহলেই এ খাতের উন্নয়ন হবে এবং অর্থনীতিতে বিমা খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তদন্ত কমিটির প্রধান ও আইডিআরএ মুখপাত্র মো. জাহাঙ্গীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, হোমল্যান্ডের অভিযোগের বিষয়ে যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেই তদন্ত কমিটি তাদের মতামত দিয়ে দিয়েছে। অডিট ফার্ম দিয়ে অডিট করানোর সুপারিশ করা হয়েছে। এখন হয়তো সেদিকেই যাবে।
অভিযোগুলোর সুষ্ঠু তদন্তের জন্য যে বিশেষায়িত জ্ঞান প্রয়োজন তা কমিটির নেই। তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে এমন একটি মতামত দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ কি আইডিআরএতে দক্ষ জনবল নেই? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আইডিআরএ’র দক্ষ জনবলের অভাব আছে। আমরা খুবই সাধারণ। এখানে বিশেষায়িত লোকবল দরকার। আমরা ক্যাডার সার্ভিসের লোক। যেখানে বদলি করে, সেখানেই কাজ করি বা করতে হয়।
এদিকে হোমল্যান্ড লাইফের পরিচালকদের পক্ষ থেকে দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় হোমল্যান্ড লাইফের কেনা ১২০ কাঠা জমি গ্রাহকের দাবি পরিশোধে বিক্রি করা হয়। কিন্তু সঠিকভাবে সম্পূর্ণ টাকা গ্রাহকের দাবি পরিশোধ করা হয়নি। গ্রাহকের টাকা পরিশোধ না হওয়ায় পরিচালকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা পর্যন্ত হয়েছে।
কয়েকজনের দুর্নীতির জন্য এই পরিচালকরা অসম্মানিত হয়েছেন বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কোনো কোনো এরিয়ায় কোনো কোনো গ্রাহককে কত টাকা পরিশোধ করা হয়েছে তার তালিকা এবং জমির বিক্রয়মূল্য সঠিকভাবে নির্ণয় করা হয়েছে কি না? জমি ও বিক্রিতে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না বা কেন একজন ব্যক্তির (পছন্দের ব্যক্তি) মাধ্যমে সম্পূর্ণ জমি বিক্রি করা হয় তা তদন্তের মাধ্যমে দেখা দরকার।
আরও পড়ুন>> হোমল্যান্ড লাইফে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ খোদ পরিচালকদের
জমি বিক্রির টাকা কোন কোন অ্যাকাউন্টে কীভাবে জমা করা হয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ বোর্ডে পেশ করা হয়নি- এমন অভিযোগ করে এতে বলা হয়েছে, জমি বিক্রিতে দাপ্তরিক ও অন্য খরচ দেখিয়ে কোম্পানি থেকে কত টাকা বের করা হয়েছে এবং জমি বিক্রির গেইন ট্যাক্স কীভাবে কত টাকা পরিশোধ করা হয়েছে তার রশিদসহ প্রমাণাদি পেশ করা হয়নি।
এতে আরও বলা হয়েছে, জীবন বিমা তহবিল হ্রাস পাওয়ার সঠিকতা নির্ণয় এবং বর্তমান কোম্পানির জীবন বিমা তহবিল কত তা উপস্থাপন করা হয়নি। আবার কোম্পানির কতগুলো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে এবং বিগত পাঁচ বছর সব ব্যাংকের বিবরণী এফডিআর, বিজিটিভিসহ উপস্থাপন করা হয়নি।
কোম্পানির যে সব মামলা চলমান তার বিবরণ ও প্রত্যেক মামলার বিপরীতে মামলার শুরু থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মামলা অনুযায়ী আইনজীবী ফি, দাপ্তরিক ও টিএ/ডিএ এবং অন্য খরচ যৌক্তিক ভাউচার ছাড়াই এমডি, কোম্পানি সচিব, আইন কর্মকর্তা জুবায়েরের স্বাক্ষরে বিপুল টাকা ব্যয় করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন পরিচালকরা। এটাকে কোম্পানির টাকা কর্মচারীদের আত্মসাৎ বলে মনে করছেন তারা।
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, তথ্য আড়াল করে নিয়মবহির্ভূত বহু টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। গত দুই বছরের বিভিন্ন ব্যয়ের বিপরীতে যে ভাউচার আছে সেগুলো ওই সময়ের ব্যাংক স্টেটমেন্টের সঙ্গে যাচাই করলে জনগণের আমানত খেয়ানত করার প্রমাণ বের হয়ে আসবে।
এছাড়া আরজেএসসিতে রিটার্ন জমা দেওয়ার দাপ্তরিক ও লিগ্যাল ফি বাবদ কত টাকা খরচ করা হয়েছে তার হিসাবের বৈধতা না থাকায় বিবরণী বোর্ডে পেশ করা হচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেছেন এই পরিচালকরা।
তাদের অভিযোগ, ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ভুয়া শত শত কোটি টাকা ব্যবসা দেখিয়ে কমিশন, ইনসেন্টিভ গ্রহণ ও কোম্পানির টাকায় ওমরাহসহ বাইরে ভ্রমণ করা, কোম্পানির অর্থ অপচয় করা হয়েছে। এ কারণে সঠিক পলিসি গ্রাহক অর্থের সংকটে সেবা পেতে বাদাগ্রস্ত হচ্ছে। ভুয়া ব্যবসা বা পলিসির জন্য নবায়ন প্রিমিয়াম না আসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কোম্পানি।
কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয় অতিরিক্ত করার পাশাপাশি কোম্পানির টাকা দিয়ে হাতে-কলমে ভুয়া ব্যবসা করা এবং কোম্পানির হিসাব বিভাগের কারসাজিতে ব্যবসা হাতে-কলমে দেখানো হয় বলেও অভিযোগ তুলেছেন পরিচালকরা। তাদের দাবি, ডিসিএস ফাইলসহ যাচাই-বাছাই করলে দুর্নীতির প্রমাণ মিলবে।
কোম্পানির কতগুলো যানবাহন আছে এবং কোন যানবাহন কার নামে বরাদ্দ, কত টাকা বরাদ্দ ও প্রত্যেক যানবাহনের বিপরীতে বছরে কত টাকা ব্যয় করা হয়েছে তার বিপরীতে রেজিস্টার নেই বলেও অভিযোগ করেছেন হোমল্যান্ড লাইফের পরিচালকরা। এর মাধ্যমে লাখ লাখ আমানতের টাকা লুট করা হয়েছে বলেও অভিযোগ।
কোম্পানির পাঁচ পরিচালকের এ ধরনের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে হোমল্যান্ড লাইফের পরিচালক শামীম আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, কোন পরিচালক কী ধরনের অভিযোগ করেছেন তা আমার জানা নেই। তবে পরিচালনা পর্ষদ সভায় সব সময় সব তথ্য উপস্থাপন করা হয় না, এটা সত্য। অনেক সময় সঠিক তথ্য আমরা পাইনি এটাও সত্য।
এসময় অভিযোগপত্রে সই করা পরিচালকদের নাম উল্লেখ করলে তিনি বলেন, আপনি যেসব পরিচালকের নাম বলছেন তারা সবাই দেশের বাইরে থাকেন। ওনারা বিভিন্ন সময় এসে অনেক কিছু খুঁজেছেন, কিন্তু পাননি। তবে ওনারা কোথায় কী অভিযোগ করেছেন তা আমি জানি না।
পরিচালকদের অভিযোগগুলোর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে হোমল্যান্ড লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বিশ্বজিৎ কুমার মন্ডল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি অল্প কয়েকদিন হয়েছে হোমল্যান্ড লাইফে এসেছি। আমি আসার আগে থেকেই এ কোম্পানিতে সিএমআইসি কমিটি আছে। ক্লেম, অডিট ও ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে কমিটি আছে। প্রতি মাসেই এ কমিটির মিটিং হতো। যেদিন এ কমিটির মিটিং হয়, সেদিন না হয় তার পরের দিন আবার বোর্ড মিটিং হয়। সিএমআইসি কমিটির সব সিদ্ধান্ত বোর্ড মিটিংয়ে উপস্থাপন করা হয়। সুতরাং, ওনারা যেসব অভিযোগ করেছেন তা সঠিক নয়। ভাইস চেয়ারম্যান পদাধিকারবলে সব কমিটির সদস্য। উনি যদি অভিযোগ করেন তথ্য দেওয়া হয় না, তাহলে এটা ঠিক নয়।’
২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ভুয়া ব্যবসা দেখিয়ে কোম্পানি থেকে বড় অঙ্কের টাকা সরিয়ে নেওয়া সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, সে সময় তো আমি ছিলাম না। সুতরাং, এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না। তবে ওনারাই তো অডিট কমিটিতে ছিলেন। তাহলে ওনারা অডিটে কী করেছেন।
এমএএস/এএসএ/এএসএম